পুড়ে যাওয়া বুক, আর দূরারোগ্য অসুখ-সাদাত হোসাইন

  
    

এক গল্পের ফেরিওয়ালা। মাদারীপুরের, কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া গ্রামের গাঁ ঘেঁষে তিরতির করে বয়ে যায় ছোট্ট নদীর অসংখ্য ঢেউয়ের মতই, সেই ছোট্ট ছেলেটি বুকের ভেতর পুষে রাখতো অসংখ্য গল্প। সেইসব গল্পই ক্রমশই ডানা মেলে ছড়িয়ে যেতে থাকলো মানুষ থেকে মানুষে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম তরুণ কথা সাহিত্যিক তিনি। আরশিনগর, অন্দরমহল, মানবজনম ও নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মতো উপন্যাস দিয়ে চমকে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী বাংলা পাঠকদের। গল্প বলে চলেছেন চলচ্চিত্রেও। তার নির্মিত বোধ, দ্যা শ্যুজ, প্রযত্নে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলোও ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের হৃদয়। জিতেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বেস্ট ফিল্ম মেকার এওয়ার্ড, এসবিএসপি-আরপি ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। সম্প্রতি নির্মাণ করছেন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গহীনের গান’।
সাদাত হোসাইন, আগামীর বাংলাদেশ, আগামীর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পতাকা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এক ঝলমলে তারুণ্যের প্রতীক। প্রশান্তিকায় নিয়মিত লিখছেন বিস্ময়লেখক সাদাত হোসাইন।

মায়েদের আঁচলে ঘ্রাণ থাকে, মায়ার ঘ্রাণ, এই কথা কত শুনেছি! শুধু যে শুনেছি, তা-ই না, উপলদ্ধিও করেছি। ছেলেবেলায় অসুখ হলে মনে হতো আম্মা একটু পাশে এসে বসলেইতো হয়। তার গায়ের একটু ঘ্রাণ, আঁচলের একটু স্পর্শ, তাতেই কেমন অসুখ সেরে যায়। অথচ শুধু শুধু রাজ্যের ডাক্তার, কবিরাজ, ওষুধ! একটু এসে পাশে বসে থাকুক না আম্মা! সেই একটুতে অবশ্য আমার পোষায় না। তেষ্টা বাড়ে, আরও কিছুক্ষণ। কিংবা দিনভর। কিন্তু সারাক্ষণ বসে থাকার যে জো ছিলো না আম্মার। দিনভর কত কাজ!

সেই আমি যখন বড় হয়ে গেলাম, তখন একবার রহিমা বুয়াকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ। তখন মেসে থাকি। রহিমা বুয়া আমাদের  রান্নার বুয়া। কিন্তু তার রান্না আমাদের মুখে রোচে না।  গা ঘিনঘিনে চেহারা তার। শেষ কবে গোসল করেছে কে জানে! ঘরে ঢুকতে বিশ্রি গন্ধে বমি আসার জোগাড়। পরনের ময়লা-ঘামে তেল চিটচিটে শাড়িখানাও সে শেষ কবে ধুয়েছে কে জানে! বকাঝকায়ও কাজ হয়না। আমরা রহিমা বুয়াকে ছাড়িয়ে দিলাম। তার সাথে দেখা নেই বহুদিন। কিন্তু আচমকা একদিন সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। তার বড় মেয়ের অসুখ। জরুরী কিছু টাকা চাই।

রহিমা বুয়া হরহামেশা মিথ্যে বলে। তাছাড়া তার উপর নানা কারণে ভয়ানক বিরক্ত আমি। আমি তাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, ‘টাকা নেই’। রহিমা বুয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘বেয়ান বেলা টাকার খোঁজে বাইর হইছি মামা, কোথাও ট্যাহা পাই নাই। আল্লাহরস্তে মামা…’।
আমি তাকে কথা শেষ করতে দেই না, ধমকে উঠি, ‘আপনারে আমার চেনা আছে। মিথ্যা বলে এযাবৎ কতবার টাকা নিছেন?’
সে অসহায় ভঙ্গীতে বলে, ‘বিশ্বাস করেন মামা…’।

আমি ঘরে ঢুকে যাই। রহিমা বুয়া আচমকা ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে, ‘মামাগো, আপনের পায়ে পড়ি। মাইয়াডারে একলা ঘরে থুইয়া আইছি। সেই বেয়ান বেলা, এহন দুপার পার হইয়া যাইতেছে। মামা…!’
আমি গা রি রি করে ওঠে। কী বিশ্রি বোটকা গন্ধ! আমার বমি পেয়ে যায়। যেন মাছের আঁশটে গন্ধে আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে। আমি আচমকা বলি, ‘চলেন, আমি যাবো আপনের সাথে!’
রহিমা বুয়া খানিক অবাক হয়! তার ধরা পড়ে যাওয়া হতভম্ব মুখ দেখে আমি বিমলানন্দ উপভোগ করি। উপায় না দেখে রহিমা বুয়া রাজি হয়। সে হেঁটে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি রিকশা নেই। দু’খানা রিকশা। আমি তার সাথে এক রিকশায় উঠতে পারবোনা। মরেই যাবো। উফ, একটা মানুষ এতো নোংরা, এতো গা ঘিনঘিনে কী করে হয়!
রহিমা বুয়ার ঘুপচি বস্তির সামনে এসে রিকশা থাকে। চারপাশে রাজ্যের ময়লা-আবর্জনা। বিকট গন্ধে পেট উলটে বমি আসার যোগাড়। ঘরে ঢুকতেই নাকে এসে ধাক্কা দেয় গা গোলানো গন্ধ। আমি বা হাতে নাক চেপে ধরি। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বিকেলের এক চিলতে তেরছা আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই আলোয় পাঁচ- ছ বছরের একটা শীর্ণ মেয়েকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখি। দরজা খোলার শব্দে সে চোখ মেলে তাকায়। রক্ত জবার মতন টকটকে লাল চোখ। শুকনো ফ্যাকাশে মুখ।
রহিমা বুয়াকে দেখে সে আচমকা চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘তুই কই গেছিলি মোরে থুইয়া, ও মা, মা’রে, তুই মোরে থুইয়া কই গেছিলি, ও মা, মা, মারে…’
রহিমা বুয়া ছুটে মেয়ের কাছে যান, ‘ওষুধের ট্যাহা জোগাড়ে গেছিলাম গো মা’।
মেয়েটা উঠে বসে। তারপর বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে রহিমা বুয়ার কোলে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদে, ‘তুই মোরে থুইয়া গেলি ক্যা মা? তুই ক্যা গেলি? ক্যা গেলি? মুই যদি মইর‍্যা যাইতাম। মোর ওষুধ লাগবো না। তুই আর যাবি না, তুই মোর ধারের তন কোনহানে যাবি না। কোনহানেই না। কোনদিন যাবি না। এ মা, ক, তুই যাবি না! যাবি নাআআআ…’।

মেয়েটা কাঁদে। হাউমাউ করে কাঁদে। আমি তার কান্না শুনতে পাই না। আমি যা দেখতে পাই, বিশ্রি মাছের আঁশটে গন্ধওয়ালা রহিমা বুয়ার কোলের ভেতর, বুকের ভেতর, শরীরের ভেতর মেয়েটা যেন তার নাক, মুখ, চোখ দিয়ে কী খোঁজে? কী? গায়ের ঘ্রাণ? ওই ঘিনঘিনে শরীরে সে কী করে অমন ডুবে গেলো!
মেয়েটার শরীর কাঁপছে। কেঁপে কেঁপে সে যেন রহিমা বুয়ার শরীর থেকে শুষে নিচ্ছে ওষুধ- পথ্য, ডাক্তার-কবিরাজ, সব। আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকি! মেয়েটা কী রহিমা বুয়ার ওই তেল চিটচিটে না ধোয়া শাড়ি, নোংরা শরীরের বিশ্রি গন্ধ টের পাচ্ছে না? একটুও না!
আমি তাকিয়ে রইলাম। রহিমা বুয়া মেয়েটার মুখ ফেরালো তার দিকে। তারপর বললো, ‘দ্যাখ, কেডায় আইছে! তর লাইগ্যা ওষুধের ট্যাহা লইয়া আইছে!’
মেয়েটা আমার দিকে খানিক তাকায়। কিন্তু পাত্তা দেয় না। সে তার মায়ের ঘাম চিটচিটে বুকে, গলায়, ঘাড়ে, গালে মুখ ঘসতে থাকে, নাক ঘষতে থাকে, ঠোঁট, গাল, চিবুক ঘষতে থাকে। তার সারা শরীর, তার চোখ, মুখ এক অপার্থিব আলোয় ভেসে যাচ্ছে, আনন্দে ঝলমল করছে। আমি বিস্মিত চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকি!
আহা, মা! আহা ঘ্রাণ। আহা, সন্তান!

আমার হঠাৎ মনে হতে থাকে, এই ঘরে সেই বিশ্রি গন্ধটা আর নেই। ঘর জুড়ে যেন অদ্ভুত আদুরে এক সুবাস। আমি চোখ বন্ধ করে সেই সুবাস বুকভরে টেনে নিতে থাকি। আমার কেন যেন মনে হয়, এখানে কোথাও আমার মায়ের শাড়ির আঁচল সুবাস ছড়িয়ে আমাকে বুঁদ করে দিচ্ছে। আমি সেই সুবাসে ভেসে ভেসে যাচ্ছি। ডুবে ডুবে যাচ্ছি। আমি রহিমা বুয়া আর আমার মাকে আর আলাদা করতে পারি না। তারা যেন কোথায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছেন। একাকার।
আমি সেই প্রথম উপলদ্ধি করি, মায়েদের শরীর সন্তানের জন্য যত্ন করে তার গোপন সুবাস লুকিয়ে রাখে। সেই সুবাস শুধুমাত্র সন্তান টের পায়। আর কেউ টের পায় না। সেই ঘ্রাণ মায়ার ঘ্রাণ, মমতার ঘ্রাণ।

যত বড় হয়েছি, তত সেই সুবাসের জন্য বুকের ভেতর হাহাকার বেড়েছে। কারণ বড় হলে দূরে যেতে হয়। আর দূরে গেলে পুড়ে যেতে হয়। আমরা তাই রোজ পুড়ে যাই। আমরা সবাই। মায়ের আঁচল ছেড়ে যত দূরে যাই, তত পুড়ে যাই। কিন্তু আমাদের যেতে হয়। ঘর থেকে বাহির, বাহির থেকে পথ, পথ থেকে পথে। শহর, গ্রাম, দেশ, দেশান্তর। তারপর আরও দূরে, বহু দূরে। পুড়ে যাওয়া বুক, আর দূরারোগ্য অসুখ নিয়ে। সেই অসুখের নাম সুবাস। ওষুধের নামও। মায়ের সুবাস। সুবাসের তেষ্টা!
আচ্ছা, মা কী?
এই প্রশ্ন আমি খুঁজেছি প্রথম যেদিন গ্রাম থেকে হোস্টেলে চলে গেলাম পড়তে, ঠিক সেই দিন। মা কী কেবল মা? রক্ত মাংসের ওই সুবাসওয়ালা মানুষটিই? প্রথম দু চারদিন তেমনই মনে হলো। তারপর হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতো। বাড়ির উঠান, উঠোনের পাশে লাল গাই, পুকুর পাড়ের ছাতিম গাছ, গাছের তলায় শুকনো পাতার শব্দ। বিকেল বেলার মাঠ, মাঠের পাশে নদী, নদীর পারে খেয়া, খেয়ার ধারে মন কেমনের দুপুর! বুকের ভেতর হাহাকারের শব্দ! তেষ্টা ভীষণ বুক।
আমার তখন কান্না কান্না লাগে। এক মাঝরাত্তিরে আমি সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে চলে আসি খেয়া নৌকার ধারে। তারপর নদী পেরিয়ে সুবহে সাদিকের অদ্ভুত আলোয় শুয়ে থাকি স্কুলের মাঠে। আহা, জীবন! আহা! আমার বুকের ভেতর তখন ঘ্রাণ। মায়ের, মাটির, মানুষের, মনের। সেই ঘ্রাণ আমি যত্ন করে রেখে দেই। ছুঁয়ে দেই। তারপর ভাবি, এরাওতো মা-ই। মায়েরই মতন।
তারপর?
তারপর বড় হতে হতে জানি, দূরে যেতে যেতে, পুড়ে যেতে যেতে জানি, আমরা কী সীমাহীন তেষ্টা নিয়ে পার করে দেই জীবন। ঘুরে বেড়াই জগত। অথচ সেই তেষ্টা আমাদের পুড়িয়ে দিতে থাকে খা খা রোদে।
এই তেষ্টা, এই সুবাস, এই মা, মানুষ আর মনের গল্পগুলো আমি তাই বুকে পুষে বেড়াই বলবো বলে। কিন্তু কাকে বলবো? যার বুকে ঠিক একইরকম বয়ে চলে স্মৃতির নদী, বিষাদের বাতাস আর মাটির ঘ্রাণ।
এই গল্পগুলো আমার, আমাদের। যারা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে বকুলগন্ধা বুকে এমন জলজ জীবনের তেষ্টায় ছটফট করছেন, ঠিক তাদের।

আমি তাই আসছি, সেই গল্প বলতেই। গল্পের ভেতর গল্প, মায়ার স্পর্শ, জীবনের যাপন, আর মন ও মানুষের ছোঁয়া নিয়ে সিডনীতে। সেখানে এইসব গল্প হয়ে উঠবে সেইসব মন ও মানুষের আকন্ঠ তেষ্টার জল, অশ্রু টলমল, জীবনের গান, মমতার ঘ্রাণ। ১৬ ই মার্চ, ২০১৯, সিডনিতে, গল্পের জীবন, জীবনের গল্পে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments