পৃথিবীর শেষ বর্ষবরণ উৎসবে

  
    

চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম, লস আ্যঞ্জেলেস থেকে: নুতনকে বরণে দেশ-কাল-সমাজভেদে মানুষের মধ্যে প্রবল উচ্ছ্বাসে কোনো ঘাটতি থাকেনা। ওই যে, কবি বলে গেছেন না, ‘অসীম কালসাগরে ভূবন ভেসে চলেছে/ অমৃতভবন কোথা আছে কে তাহা জানে।’ সেই অমৃতভবনের সন্ধানেই মানুষের এই অপার আকুতি নুতনকে বরণে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকার কথা। থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকাতো এক রকম অবরুদ্ধ শহর হয়ে যায়। রাত ১১টার পর সাধারণের জন্য রাজপথ নিষিদ্ধ। কড়া পুলিশী টহল, দ্রুত ঘরে ফিরে যাওয়ার নির্দেশনা, মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট। যেন রাজধানীজুড়ে অঘোষিত কার্ফ্যু। তারপরও কী মানুষের আবেগের স্রোতে বাঁধ দেওয়া যায়? রাত ১২টা বাজলেই ঢাকার আকাশ আলোকময় আতশবাজিতে। ওড়ানো হয় হাজারো ফানুশ। পটকার শব্দে কানে তালা। পুলিশের নির্দেশনাকে থোরাই কেয়ার। ঘরে ঘরে উৎসবের আয়োজন।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ইংরেজি নববর্ষ বরণের নানা আয়োজন থাকে প্রতি বছরে। মিডিয়ার কল্যাণে সেসব দৃশ্য আমাদের বেশ চেনা-জানা। অবস্থানগত কারণে পৃথিবীতে সবার আগে থার্টিফার্স্ট নাইট আসে নিউজিল্যান্ডে। অকল্যান্ডবাসী প্রথম বরণ করে নুতন বছরকে। এরপর অস্ট্রেলিয়া। বর্ষবরণে সিডনির আয়োজনটা খুবই জনপ্রিয়। সিডনি হারবারের চোখধাঁধানো আতশবাজি পৃথিবী বিখ্যাত। এরপর একে একে এশিয়া আর ইউরোপ শেষে উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক। টাইমস স্কয়ায়ের আয়োজনটা পৃথিবীসেরা। আর নুতন বছর বরণের শেষ অনুষ্ঠানটা হয় প্রশান্তপারের লস অ্যাঞ্জেলেসে। এবছর আমি আছি এই অ্যাঞ্জেলেসে। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি।


লস অ্যাঞ্জেলেসে পার্কিং সমস্যা বিশ্বখ্যাত। তাই ভরসা মেট্রো বাস অথবা সাবওয়ে মানে পাতাল রেল। আমি ট্রেনটাই বেছে নিই। এস্কেলেটর ধরে বেশ গভীরে নেমে টিকেট কাটতে যেতেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাসি এগাল-ওগাল। “টুডে অল রাইডস্ ফ্রি। এনজয়।” আসলেও তাই। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো – আজ লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে বাস-ট্রেন রাইড ফ্রি। এ সুযোগ চলবে ভোর পর্যন্ত। পরমানন্দে ট্রেনে চেপে সিভিক সেন্টার স্টেশন। বাইরে বেরিয়েই হাতের বাঁ পাশে ৫০০ মিটারের মধ্যেই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল পার্ক। সেই পার্ক আর লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি হলকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠানের আয়োজন। কিন্তু সেদিকে এগুনো গেল না। পুলিশ বাহিনী খুব আদবের সঙ্গে উল্টোপথ ধরিয়ে দিলো। কারণ নিরাপত্তা। মোড়ে মোড়ে ইন্ডিকেটর দেখে দেখে ব্লকের পর ব্লক পেরুচ্ছি সবার সঙ্গে। কিন্তু যাত্রাপথটি মোটেও ক্লান্তিকর ছিলনা।ফুটপাতে লাতিনোরা ছোট ছোট টং নিয়ে বসেছে। সেখানে ভাজা হচ্ছে গরম গরম খাবার। আর সমানে তারা হাঁক ছেড়ে চলেছে- হটডগ, বার্গার, ফ্রাইজ, চিকেন, বুরিটোজ, টাকো, নাচোজ…..। আমার চোখে তখন ভাসছে ঢাকার ফুটপাতের দৃশ্য। পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুরচপ, সিঙ্গারা, সামুসা, পুরি আর চায়ের সারি সারি টং দোকানের দৃশ্য। সবই এক, শুধু মানুষগুলো আর আইটেম আলাদা। তবে এগুলো স্থায়ী দোকান নয়। থার্টিফার্স্ট উপলক্ষে সিটি করপোরেশন বিশেষ ছাড় দিয়েছে এক রাতের জন্য। খাবারের গন্ধে পেটের হাঁকডাক বেশ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু তাকে মোটেও পাত্তা দিলাম না। স্রোতের সঙ্গে মিশে পথের দুই পাশে নাইট ক্লাব আর বারের ভেতর থেকে ভেসে আসা কোলাহল আর ধুন্ধুমার মিউজিক শুনতে শুনতে এগুতে থাকলাম।

প্রায় দুই মাইল হাঁটার পর অনুষ্ঠানস্থলে ঢোকার মুখে বিশাল লাইনে পড়লাম। চেকপোস্ট। শুধু কাপড় খুলতে বাকি। অবশেষে রাত ন’টায় সিটি হল প্রাঙ্গণ। ১২ একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত গ্র্যান্ড পার্কে কিছুটা দূরে দূরে করা হয়েছে কয়েকটি স্টেজ। কোথাও চলছে হেভি মেটাল আর রক মিউজিক পারফরমেন্স। মিউজিক বিটে হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগার। একটি স্টেজে চলছিলো আফ্রিকান শো। এশিয়ান মিউজিকের সঙ্গে বেশ মিল, বিশেষ করে মাদল বেশ নস্টালজিক করে তুলছিলো। তবে ফিউশন আর ড্যান্সে বেশ পার্থক্য আছে। আরেক স্টেজে চলছিলো লাতিনো ডিজে শো। লাতিনো মিউজিকের ছন্দে বেশ মাদকতা আছে। আপনি চাইলেও স্থির থাকতে পারবেন না। স্টেজের সামনে জমাট ভিড়টা তাই পারফরমেন্সের সঙ্গে উন্মাতাল নাচছিলো। পুরো স্থানটি জুড়ে দলবদ্ধভাবে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আনন্দ করছে। এর মধ্যে এক দশাশই লোকের ওপর আমার দৃষ্টি আটকে গেলো। ঝাড়া সাড়ে ৬ ফিট লম্বা হবেন। মোটাসোটা, ওজন ধরেন গিয়ে কমপক্ষে আড়াইশো পাউন্ড। চেহারা সুরত বলছে মেক্সিকান। লাতিনো স্টেজের পাশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন গলায় ফিতে বাঁধা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে। তাতে লেখা “ফ্রি হাগ”। যেই আসছেন বিশেষ করে নারীরা, তিনি দু’হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। দু’একজন তার বাহুডোরে ধরা দিচ্ছেন, বাকিরা পড়ি-মরি দৌড়। তার বাড়ানো হাত এড়িয়ে একদল তরুণী ভোঁ দৗড় দিতেই আমি আর হাঁসি চেপে রাখতে পারলাম না। আমার দিকে লোকটির চোখ পড়তেই বললাম, “ইউ নো, সাইজ ইজ দ্য প্রবলেম।” জবাবে তিনি বললেন, “কামঅন ম্যান, দিস ইজ ফ্রি।” উপলদ্ধি হলো- সব ফ্রি আইটমে আসলে চলে না।

১২টা বাজার ২ মিনিট আগে সব মিউজিক থেমে গেলো। সবার দৃষ্টি তখন সিটি হল টাওয়ারে। লেজারের মাধ্যমে তার গায়ে তখন বিগত এক বছরের নানা ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা শুরু হলো। এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শুরু হলো ক্ষণ গণনা। ১০, ৯, ৮………….৪, ৩, ২, ১……২০২০। চারিদিকে তখন তুমুল চিৎকার আর সেলফোনের ফ্ল্যাশ। হ্যাপি নিউ ইয়ার। এরপর বিভিন্ন মঞ্চে আবার অনুষ্ঠান শুরু হলো। আরো কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরলাম। বেশ স্পিডে পাতাল ফুঁড়ে ট্রেনটি ভারমন্ড স্টেশনে এসে থামতেই নেমে পড়লাম। বাইরে বেরুতেই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা। হাঁটতে থাকলাম গাড়িটার সন্ধানে। চারপাশ থেকে তখনও ভেসে আসছে পটকা ফাটার শব্দ। বোঝা যাচ্ছে বরণ উৎসব এখনো থামেনি। সেই যে সামনে ওই অমৃতভবন? তার সন্ধান চলবে সারাটা বছর জুড়ে। তাইতো নুতনের এই আবাহন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments