বিজয় দিবস কি আসলে সেভাবে উদযাপন করা হয় যেভাবে হওয়া দরকার ছিলো? এই প্রশ্ন আজ প্রত্যেকের নিজেকে অন্তত একবার হলেও করা উচিত। আজকের ডিসেম্বর আর একাত্তরের ডিসেম্বর যে এক না তা বলার কোন কারণ দেখি না। সে কথা তো পরে এমনকি দেশ স্বাধীনের পর এতগুলো সরকার আসলো গেলো তখনো আমাদের বিজয় এমন কঠিন চ্যালেন্জের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। আপনি সুখ নিদ্রা যাচ্ছেন যান, বুদ্ধিবৃত্তি কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় সময় কাটাচ্ছে , কাটাক কিন্তু যখন নয়ন মেলবে তখন কি দেখবে তা বলা কি খুব মুশকিল? আর যাই দেখুক না কেন যে দেশ স্বাধীন করার জন্য তিরিশ লাখ মানুষ জান দিয়েছিলেন লাখ লাখ মা বোনেরা সম্মান হারিয়েছিলেন সে দেশ আর দেখবেন না। আমি মনে করি আজকের বিজয় দিবস এক কঠিন দানব ও দানবীয় সত্যের মুখোমুখি করেছে জাতিকে। দীর্ঘ সময় ধরে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে বা চোখ বুঁজে আত্মতৃপ্তি অনুভব করার দিন আর নাই। আজকের বিজয় দিবস ধর্মের নামে উগ্রবাদ আর আর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুখোমুখি করে এরা কি চায়? সংঘাতপূর্ণ সমাজে কি চাচ্ছে এরা?
এর জবাব সরকার জানলেও দিতে পারবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে সরকারে আওয়ামী লীগে দ্বিতীয় কেউ আছেন যাঁর কথা মানুষ কোন সন্দেহ বা দ্বিধা ছাড়া মেনে নেবে? কতো দিন কতো মাস কতো বছর হয়েছে আওয়ামী লীগের মতো দল কোন বিরোধীর মোকাবেলা করেনি? মোকাবেলা কি সবসময় যুদ্ধ না মারামারি? বিজয় দিবসে যে গণতন্ত্র আর আধুনিক দেশ পাবার কথা তার কি কিছু আছে আসলে? এই যে একতরফা একমুখি সবকিছু তাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে প্রতিরোধ। সবদেশে সব সমাজেই বাধা থাকে। কাজ করে প্রতিক্রিয়াশীলতা। এই প্রতিক্রিয়াশীলতাকে রুখতে চাই বিজয়ী জাতির অঙ্গীকার। যার নাম রাজনীতি। তা ছিলো বলেই তাজউদ্দীন সৈয়দ নজরুলদের মতো নেতা পেয়েছিলাম আমরা। আমাদের ইতিহাসকে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে বাঙালি অসাম্প্রদায়িকতা। আজকের বিজয় দিবস সেগুলো হারিয়ে কেবল এক আনুষ্ঠানিকতা।
মূল কারনগুলো আমরা জানলেও মানতে চাই না। বিভ্রান্ত এই প্রজন্ম তো বটেই আমাদের সমবয়সী বা অনুজদের অনেকেই পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণকে মনে করেন ভারতীয় হিন্দুদের কাছে পরাজয়। যে কথা শুরুতে বলছিলাম স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস দুটোই ততোটা আন্তরিক ভাবে পালন করা হয় না। যতোটা প্রথাগত। গোড়ার কিছু বছর বাদ দিলে সবসময় হয় কূট তর্ক বা ভুল ইতিহাসে আজ এই অবস্থা। সময় প্রায় শেষ। অর্ধশত বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো বিজয় দিবস যা চায় যা তার প্রাপ্য তা দিতে হলে আধুনিক সমাজ অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ আর সরকারের কঠিন অবস্হানের বিকল্প নাই। মনে রাখা প্রয়োজন এমন অনেক স্বাধীন দেশ আছে যাদের স্বাধীনতা পুরনো না হতেই বাঁক পরিবর্তন এমন কি নামও বদলে গেছে। আমরা বিজয় অর্জন করেছি রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে। যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের ইতিহাস বাঙালির প্রথম গৌরবের নাম। এই ইতিহাস একবার হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের মাটি আমাদের মাফ করবে না। মাফ করবেনা আকাশ নদী ফুল পাখি কিংবা ভোরের বাতাস।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানী বাহিনী এই দিনে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। আত্মসমর্পণ দলিলের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:[৩]
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
এতো কিছুর পরও আজ যারা দেশে সম্পদে অর্থে প্রভাবে বলীয়ান তারা কিভাবে বেঈমানী করে? কিভাবে ভুলে যায় এই দেশ স্বাধীন না হলে কি করতেন তারা? আজকের এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই বানিজ্য চলতো? পাকিস্তানীদের কাছে সবকিছু বন্ধক দিয়ে নাকে খত দিয়ে চলতে হতো। এই বিজয় দিবসে তাদের আস্ফালন দেখে একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে এরা কোনদিন কোন ভাবে কি দেশের জন্য কিছু করেছেন? লেখাপড়া খেলাধুলা সংস্কৃতি শিল্প এমন কি ধর্মে ও তাদের কি অবদান? যে মাইক্রোফোনে কথা বলেন যে নেট দুনিয়ায় টাকা কামান জনপ্রিয়তা নিয়ে ব্যবসা করেন তারা করেন এর বিরোধিতা। এদের কথা শুনলে এদেশ স্বাধীন তো হতোই না আজ আমরা থাকতাম চানতারা পতাকার গোলাম।
শুদ্ধ ইতিহাস আর রক্তধারার এই দেশ ৫০ বছরে পা দিতে চলেছে। এখন এসব কোলাহল বন্ধ করা প্রয়োজন। আমাদের সামনে নতুন দিনের হাতছানি। আমি বিশ্বাস করি মানুষ দেশপ্রেমী মানুষ চায় বাংলাদেশের কল্যাণ । আর সেটাই জাতির শক্তি। জাতির আশার জায়গা।
ঘরে ঘরে প্রগতিশীলতার দুর্গ গড়ে তুলুন বাঙালি। এই ছিলো বঙ্গবন্ধুর ডাক। তাঁকে হেয় করা বা তাঁর ভাস্কর্য ভাঙার জন্য এদেশ বিজয় অর্জন করেনি। শুভ হোক বিজয় দিবস।
অজয় দাশগুপ্ত
কবি, কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।