প্রথাবিরোধী শুদ্ধ মুখ । অজয় দাশগুপ্ত

  
    

প্রথাবিরোধী মানুষ বাংলায় খুব কম জন্মায়। বলা হয়ে থাকে বাঙালি জন্মায় কাল কেউটে হয় মারা যায় বিষহীন ঢোরা সাপ হয়ে। আপোসক্লান্ত সমাজে ইনি ছিলেন ব্যতিক্রম।এমন মানুষ হয়তো মাঝে মধ্যে এসে নাড়া দিয়ে যান। বুঝিয়ে যান আমরা কি বেঁচে আছি না বাঁচার ভান করছি। দেশের বিষয়ে দেশের মানুষকে নিয়ে এমন করলেও গ্যাললিওকে নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস আছে। হাহাকার  আছে।তাঁকে নিয়ে নাটক থিয়েটারও হয়।জোয়ান অব আর্ককে নিয়েও চিন্তা করি, ভাবি আহা রে কি নিষ্ঠুরতা।
এসব ইতিহাস ছাড়িয়ে সে সব দেশও সমাজ এগিয়েছে অনেকদূর। আমরা কি পেরেছি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তমনের মানুষদের বাঁচাতে, না এখনো পারি?

হুমায়ুন আজাদ। জন্ম: ১৯৪৭। মৃত্যু: ২০০৪।

আপনার সাথে আমার, আমার সাথে ওর, ওর সাথে তার সব কথা ও চিন্তার মিল হলেতো দুনিয়াই থেমে যাবে। ঈশ্বর বা প্রকৃতি যাই বিশ্বাস করেন না কেন মেধাই মানুষের গতি। সেই হচ্ছে এগিয়ে চলার হাতিয়ার।
যাঁর কথা লিখছি তিনি অকপটে সত্য বলতেন। যা বিশ্বাস করতেন তাই লিখতেন। সে লেখাগুলো এমন না যে তা কোন রাজনীতির পক্ষে বিপক্ষে। মূলত নারীমুক্তি ধর্মের নামে শোষণ বিজ্ঞান বিষয়ক সমাজ এই যা। কিন্তু মুশকিল কি জানেন, বেগম জিয়া একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হবার পরও তাঁর আমলে এই লেখকের নারী গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি  আওয়ামী বান্ধবও ছিলেন না। বরং তারাও তাঁর মুন্ডুপাত করতে সমান উৎসাহী। তাঁর স্বভাবসুলভ ঠোঁট কাটা কথা বার্তা মানার মতো বুকের পাটা ক’ জনের আছে? তিনি ঠাট্টা করে আলাউদ্দিন আল আজাদকে বলতেন, আপনি কিসের আজাদ ? আপনি তো দাস, এরশাদের সেবা দাস। আজাদ হলাম আমি। (সূত্রঃ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)।

কাউকে ছাড় না দেয়া মানুষটি এই দেশ সমাজ ও জাতির মগজে শুদ্ধ কিছু ঢোকাতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদ বা ম্যানম্যানে ছা পোষা বুদ্ধিজীবীদের মতো ম্যা ম্যা না করে কড়া ভাষায় পাকিস্তানি মনোভাব ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে লিখতেন বলেই ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইটি তাঁর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তাঁকে ফাঁসী বা কারাগারে যেতে হয়নি। মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত নাটক “রক্তাক্ত প্রান্তর” এর মতো বইমেলার আঙিনা রক্তাক্ত প্রান্তর হয়ে গেছিলো তাঁর শুদ্ধ মগজের শোণিত প্রবাহে। সে পাপ কখনো ক্ষমা করবে না আমাদের।
তিনি অবশ্য নিজেই লিখেছিলেন,
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ কিন্তু বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক।
তাঁর প্রবচনগুচ্ছ আমার মতে অসাধারণ ও সত্যের অপার সৌন্দর্যের নগ্ন প্রতিমূর্তি।তাঁর মতো কে বলতে পারে, পুরস্কার অনেকটা প্রেমের মতো। দু’ একবার পাওয়া দরকার, বেশী পাওয়া লাম্পট্য।
শেষ কথাটাও তাঁর, মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে, আর কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।

ভুল দেশে ভুল সমাজে ভুল জাতিতে জন্ম নেয়ার পাপ আপনাকে ছেড়ে কথা বলেনি মিষ্টি বকুলের কবি। আপনি কি আমাদের ক্ষমা করবেন?
আমি জানি তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর মতামতের বিপরীতে অনেক কথা বলা যায়, লেখাও যায়। কিন্তু না ছুরি না চাকু না বন্দুক না চুরি না ডাকাতি শুধু অকপটে লেখা ও বলার জন্য বাঁচতে না দেয়া মানুষকে সমালোচনা অনৈতিক, অগ্রহণযোগ্য।
শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ুন আজাদ। আপনি আমাদের একমাত্র প্রথাবিরোধী শুদ্ধ মুখ।

অজয় দাশগুপ্ত
লেখক ও কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments