শৈশব মাত্রই মানুষ মাতৃলালিত এবং পিতৃপালিত। বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই উভয়ের ওপর নির্ভরশীল। আর বার্ধক্যে প্রচলিত সভ্যতায় সন্তান আশ্রিত। শৈশব-কৈশোরে মানুষের জীবন সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। তারা তখন উচ্ছ্বল আনন্দে মশগুল। যৌবনে অনেকেই বাঁধনহারা, আবেগ তাড়িত। তখন মানুষ থাকে স্বপ্নে বিভোর, মোহচ্ছন্ন। কখনোবা অন্ধ উন্মাদনায় উন্মাতাল। আর বার্ধক্য আসলেই মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কারণে-অকারণে বিরূপ পারিপার্শ্বিকতায় মন থাকে বিমর্ষ। যেহেতু বার্ধক্যের ছাপ শারীরিক গঠনে আসে পরিবর্তন। পাতলা শরীরে জমে মেদ। মুখশ্রীতে আসে মলিনতার ছাপ। চোখের কোণে কালচে দাগ। কপালের বলিরেখার স্পষ্টতা। গায়ের রংয়ে থাকে না সেই টসটসে লালাভ আভা। আপেল রাঙা ভরাট গালের পড়ে মেছতা। আর অপূর্ব রূপ বৈচিত্র্যে আসে ম্লান নিষ্প্রভতা। চলনে-বলনে আসে স্থবিরতা ও জড়তা। আর এমন অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনে মানুষ থাকে হতাশাগ্রস্ত।
ফলে বিক্ষুব্ধ মন বাস্তবতার সাথে আপোষ অপারগতায় ভোগে। তখনি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে হ্যা-পিত্যিস করে। একদিকে বার্ধক্যজনিত শারীরিক-মানসিক নৈরাজ্য ও নিষ্ক্রিয়তা। অন্যদিকে অবসাদে তাদের স্নায়ুভেঙ্গে পড়ে। তাতে হারায় ন্যূনতম সুস্থতা ও শান্তি। কখনো জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে মন। তখনি মানব জন্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হারিয়ে মানবিক ধ্বস নামক সুনামির মুখে পড়েন শ্রেষ্ঠ জীবখ্যাত মানুষ। রাজা-প্রজা, ক্ষমতাধর-দাপুটে প্রতাপশালীও বার্ধ্যকের আত্মনিঃস্বতার দুর্ভোগে পড়তে হয়। কারণ, তখন মানব অস্তিত্বের দুর্জয়তম সম্পদ, অসীম শক্তি বিশ্বাসটুকু ধ্বংস করে দেয় মৃত্যু ভয়।
ডিজিটালাইজড মানুষ তখনই পার্লারের দ্বারস্থ হয়। সৌন্দর্য চর্চায় বয়স ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। প্রকৃতি বিরোধী মেকী প্রচেষ্টার প্রাবাল্যে চেহারায় আসে চাকচিক্যময়তা। দেহ-সৌষ্ঠবে, মুখশ্রীতে আসে লাবন্যতা। ফলে সবকিছুতেই যৌবনোত্তীর্ণ প্রলগভতায় মানুষ থাকে উচ্ছ্বসিত। যা পরবর্তীতে তার মাশুল দিতে গিয়ে অনেকেই অনুতপ্ত হয়েও নিষ্কৃতি মেলে না তাতে। তা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু সময়? জীবন থেকে যে সময়টা চলে গেছে বা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাকে তো আটকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। সময়ের ভয়াল নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচার পথ রূদ্ধ। তাই শত প্রচেষ্টাতেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় তার নির্মম ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি কখনো, কোন দিন, কোন কালেও ওঠবে না এটাও নিশ্চিত। তাহলে কী মানুষ সময়ের কাছে হেরে যাবে? বার্ধক্যের দুর্ভোগে কষ্ট পাবে? স্বজনদের ভোগান্তি বাড়াবে? এটা কী মানা যায়? আর মানা যদি না-ই যায় তবে আসুন খুঁজে বার করি কীভাবে বার্ধক্য জীবনটাকে স্বাভাবিকভাবে উপভোগ করা যায়।
প্রথমত, বার্ধক্য জীবনের সবচেয়ে বড় হতাশা ক্ষমতার পরিবর্তন। সংসার নামক রাজত্বের একচ্ছত্র সম্রাট/সম্রাজ্ঞীর বীনা শর্তে ক্ষমতার হাত বদল! আ হা রে! কী আর বলব? মেনে নিতে কষ্ট হয় অনেকেরই। আসলে পরিবর্তনই প্রকৃতির রীতি। তাই এক সময়ের অর্জনকে তো বিসর্জন দিতেই হবে। তাই ক্ষমতা নিজ দখলে রাখার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতি। জীবন তো একটাই। অনেক সময় নষ্ট করেছি। বাকী সময়টুকু নষ্ট করার কোন যৌক্তিকতা নেই। নবীজী (সা:) বলেছেন, সুস্বাস্থ্য স্রষ্টার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। বার্ধক্যের বড় হাতিয়ার সুস্থতা। সুস্থতাই সবকিছুকে আনন্দময় আর অর্থবহ করে তোলে। আর বার্ধক্যের দ্বিতীয় হতাশা হচ্ছে মৃত্যুভয়! মূলত বার্ধক্যের দুঃখের বড় কারণ এটা। আমরা জানি, মৃত্যু জীবনের মতোই চিরন্তন, শ্বাশত সত্য। কোটি কোটি বছর ধরে সবাই চলে গেছেন মৃত্যুকে বরণ করেই। তাহলে? তাহলে আমাদেরকেও মৃত্যুকে অবধারিত ভেবে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হবে। আর এ সত্যকে যত সহজভাবে আমরা গ্রহণ করব ততোই আমরা বার্ধক্য জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে থাকার নতুন অর্থ খুঁজে পাব। কারণ, এটা তো ব্যক্তিগত কোন বিষয় নয়। এটা সার্বজনীন, সামগ্রিক বিষয়। মূলত গোটা মহাবিশ্বের অমোঘ বিষয়। সুতরাং ব্যথিত না হয়ে সবার মতো আমাদেরকেও মৃত্যুকে সহজে গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়।
তবে স্বাভাবিক মৃত্যু কেন? অস্বাভাবিক মৃত্যুকেও সহজে বরণ করে জীবনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন জ্ঞান সাধক সক্রেটিস। যিনি দর্শন জগতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গুরু বলে আজও তিনি সর্বত্র স্বীকৃত ও সম্মানিত। যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা কতটা নির্মম আমরা জানি। তার চেয়েও পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত অথচ সাহিত্যের অসামান্য আবেগময় এক হৃদয় বিদারক ঘটনা হলো সক্রেটিসের মৃত্যু। এথেন্সের কিছু লোক সক্রেটিসের উপর ঈর্ষান্ধ আর হিংসাকাতর ছিল। তারা তাঁর সম্বন্ধে নানা অভিযোগ এনে তার বিচার করে প্রাণদণ্ড দিয়েছিল। সেখানকার কারারক্ষক সক্রেটিসের বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি সক্রেটিসকে বিষের পাত্র হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন ‘অবশ্যাম্ভাবিকে হালকাভাবেই গ্রহণ করুন।’ সক্রেটিস ঠিক তা-ই করেছিলেন। তিনি স্বাভাবিক, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মৃত্যুকে শান্তভাবে আর অবশ্যাম্ভাবী হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ, তিনি হাসি-মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। তা হলে আমরা কেন পারব না স্রষ্টা প্রদত্ত নিয়মকে মেনে নিতে? আর এমনই একটা প্রার্থনা নিউ ইয়র্কের ব্যবহারিক খ্রীষ্টধর্মের অধ্যাপক ড: রেইনহোল্ড নাইবুর বলেছেন, যা শুনলে আমরাও মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিতে সাহসী হব। তিনি বলেছেন, ‘ঈশ্বর আমাকে সেই শক্তি দিন। যাকে বদল করতে পারব না তাকে যেন মেনে নিতে পারি। আর যা বদল করতে পারি তা করার সাহস দিন এবং আমি যেন এ দুটির পার্থক্য হৃদয়াঙ্গম করতে পারি।’
প্রদত্ত প্রার্থনার আলোকে বলা যায় যে, আমাদের জীবনে সব সময় দু’রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম পরিস্থিতিটাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর দ্বিতীয় পরিস্থিতি হলো সেটাই যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এর প্রধান উদাহরণ হলো মৃত্যু। সুতরাং অবশ্যাম্ভাবীকে মেনে নেয়াটাই তো শ্রেয়। মানছি, বৃদ্ধ বয়সটা একটা বাধা। কিন্তু এ বাধা তো কয়েকটা শারীরিক অক্ষমতার ব্যাপার। যেমন দুর্বলতা, বুদ্ধিশক্তি ক্ষীণ হওয়া, রোগ ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়া। মূলত সক্ষমতা হারানোটাই মূখ্য। তবে এটা ভেবে আমাদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত যে, বার্ধক্য বয়সটাই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সময়, প্রার্থীত চাওয়া। ডেল কার্ণেগীর মতে, “প্রকৃতি কখনো কোন কিছু বিনা পরিবর্তে হরণ করে না। যৌবনের পরিবর্তে প্রকৃতি আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রদান করে।” সুতরাং আমরা আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি, যে পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তার মধ্য দিয়ে।
এ মুহূর্তে আরো একজনের কথা বলব যার কথা শুনলেই আমরা প্রণোদিত হব, উজ্জীবিত হবো। বার্ধক্যের দুঃখকে, হতাশাকে অতিক্রম করতে পারব। দুর্বহ ও বিপর্যস্ত মুহূর্তকে দুঃখ যন্ত্রণাহীন, আনন্দময় করে তুলতে পারব। সর্বোপরি জীবনকে ক্ষান্তিহীন কর্মোদ্যমে প্রজ্জ্বলিত ও আলোকিত আভায় উদ্ভাসিত করতে পারব। আর তিনি হলেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। তাঁর জন্মদিনে পত্রিকার এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “এ মুহূর্তে সিসোরোর একটা কথা মনে পড়ছে। সিসেরো বলেছিলেন‘ বেঁচে থাকাটাই একটা সার্থকতা, বৃদ্ধ হওয়াটাও একটা যোগ্যতা।” তারপর স্যার বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এ কথার মধ্যে সত্যতা আছে। বৃদ্ধ হতে গিয়ে মানুষ যে বহু রকমের তথ্য, জ্ঞান ও বিজ্ঞতা অর্জন করে, সেটা অল্প বয়সে কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা হলো একটি কথা। আরেকটা কথা হলো, সারা জীবন মানুষ যা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, বার্ধক্য তো তা-ই। তাঁর মতে বৃদ্ধ হতে পারাটাও একটা সার্থকতা।
আসলেও তা-ই। সবারই তো চাওয়া থাকে পরিণত বয়স অবধি বেঁচে থাকা। সুতরাং আমাদের আরো গভীরভাবে মহামহিম স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, আমরা শৈশব-কৈশোরে ও যৌবনে মারা যাইনি। এমন কী বার্ধক্যে এখনো বেঁচে আছি।
অতএব, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের প্রাচীরটাকে বিদ্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা না করে আসুন মৃত্যু নামক সত্যটাকে মেনে নিই। আর এই চরম সত্যটাকে উপলব্ধি করতে পারলেই আমরা মৃত্যু চিন্তা থেকে ফিরে আসতে পারব জীবনের চিন্তায়। আর নেতিবাচক চিন্তা থেকে ইতিবাচক চিন্তায়, কল্পনা থেকে বাস্তব জগতে ফিরে আসব।
আসলে তারুণ্য বয়সের নয়। আসল তারুণ্য হলো মনের। তাই-তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘তারুণ্যকে বয়সের ফ্রেমে বাধা যায় না।’ আসলে বয়স যাই হোক না কেন তারুণ্য হলো মনের এক ইতিবাচক অবস্থার নাম। তাই আসুন আমরা ইতিবাচকতায় উদ্দীপ্ত হই। শারীরিক সুস্থতায় এবং সুরক্ষায় মনোযোগী হই। সর্বোপরি অন্যের কল্যাণকামিতায় মনোযোগী হই। নিঃস্বার্থ সম্প্রদানে নিবেদিত হই। নিজের প্রত্যাশাকে কমিয়ে আনি। অন্যের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হই, কোন রকম প্রতিদান বা বিনিময় ছাড়া। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো অন্যের জন্য কিছু করতে পারা। এটা হতে পারে দুঃখক্লিষ্ট বা বিপন্ন মানুষের মনে শান্তির বাণী পৌঁছানো। আত্মবিশ্বাস জোগানো এটাও হতে পারে তাদের জন্য বড় একটি সেবা। যা অর্থ দিয়ে এর পরিমাপ করা যায় না। অন্ততপক্ষে প্রতিদিন একজনের মুখে হাসি ফোটানো হতে পারে একটি ভালো কাজ। মহান কিছু করার জন্যই স্রষ্টা বড় ভালোবেসে আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
অতএব, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে যা করেছি তা আমাদের মৃত্যুর সাথে সাথেই হারিয়ে যাবে। অন্যের জন্য যা করব তাই কীর্তি হিসেবে রয়ে যাবে। তাই কবি কামিনী রায় বলেছেন-
পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি
এ জীবনে মন সকলি দাও;
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পিয়ারা বেগম
কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।