শনিবার সন্ধ্যা থেকে প্রায় মধ্যরাত অবধি সিডনি মজেছিল নজরুলে। ক’দিন আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম পথ প্রডাকশান্স ও রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ও কলেজের প্রাক্তনিরা মিলে অভিনব কিছু একটা করতে চলেছে। এদের উভয় সংগঠনের কার্যক্রম ইতোমধ্যে প্রমান করেছে তারা চাইলে অনেক কাজ করে দেখাতে পারে। কি পারে কি পারে না, তার হিসেব নিকেশ সমালোচকের কাজ। আমি দেখি তারুণ্য কিভাবে কাজগুলো করছে এবং তাদের ভেতর কতটা শিল্পবোধ আর বাংলাদেশ ক্রিয়াশীল। এবারে তারা কাজী নজরুলকে নিয়ে মেতেছিল। বলাবাহুল্য কবি কাজী আমাদের দেশের জাতীয় কবি। জাতীয় কবি কথাটা শুনতে মধুর। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ শুরুতেই নজরুল ইসলামকে এই অভিধা দিয়ে আপন করে নিয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই । বছর বছর তাঁর জন্ম- মৃত্যুদিন পালন ব্যতিরেকে তেমন কোন কাজ হয় না। দরিরামপুরের নজরুল উৎসব এখন গৎবাঁধা কোন অনুষ্ঠান।

সিডনিতে নজরুল নিয়ে এটাই সমগ্র অনুষ্ঠান । এর আগে যে হয়নি তা নয় । তবে সেগুলো ছিল হয় গান আলোচনা বা কেবল গান নির্ভর।
তাই তাদের গুরুত্ব মেনে নিয়েই বলতে হয় সে অনুষ্ঠানগুলো ছিল খন্ডিত। কিন্তু কালকের আয়োজন ছিল প্রথম পর্বে হ্যাশট্যাগ নজরুল নামে তারুণ্যের পরিবেশনায় নাট্যাংশ । এর রূপকার নাহিদ কামাল রূপসাকে আমি জানি। এ যাবৎ এই তরুণীর যতো কাজ আমি দেখেছি এবং তার গান শুনেছি কখনো সে নিরাশ করেনি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বলতেই হবে নজরুল চরিত্রটিকে আধুনিক তরুণ- তরুণীদের মনমতো করে তোলা সহজ ছিল না।
আধুনিক ডিজিটাল জগতে নজরুল থাকলে কেমন হতো বা তিনি কি করতেন তার একটা খসড়া দেখানোর চেষ্টা করেছিল তারা । কাজটা সহজ ছিলো না । আমার মনে পড়ছিল চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্যগোষ্ঠীর একটি নাটকের কথা। যেখানে পাক বাহিনী একাত্তর সালে নজরুল ইসলাম নামের এক যুবককে ধরে নিয়ে যায় । তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল এই যুবকই সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা কবি কাজী নজরুল ইসলাম । সৈয়দ শামসুল হকের লেখা নাটকটির মতো গতসন্ধ্যায় পথ প্রডাকশনের তারুণ্য কাল যা করার চেষ্টা ছিল তার দুটি অংশ আমার অনেকদিন মনে থাকবে। একটি তে রূপসা যখন নজরুল ইসলামকে টক শোতে ডেকে আনে । তখন নজরুলরূপী মৃত্তিক অভিনয় আমাকে স্পর্শ করে গেছে। আর একটি সেই হুজুর ফতোয়াধারী যিনি নজরুলকে মুরতাদ ঘোষণা করতে ব্যস্ত। সে হুজুর চরিত্রে শুভজিৎ ছিল অনবদ্য। শুভজিৎ যখনই এসেছিল তখনই দর্শক শ্রোতা ভেসে গেছিল আনন্দবন্যায় । কালকের অনুষ্ঠানে এসব তারুন্য মোটামুটি সবকিছু করে দেখিয়েছে । দিতি’র মনোমুগ্ধকর নাচের কোরিওগ্রাফি ছিল অভিনব। এলিসন গোমেজ, চাঁদনি, ঋতুসহ সবাই ছিল যথাযথ। তবে অংশটুকু আর একটু ছোট আর পরিমিত হলে দর্শকদের মনসংযোগ গভীর হতে পারতো। ভবিষ্যতে এটুকু মনে রাখার কথা বলব।

পরবর্তি পর্বে গানর অনুষ্ঠান ছিল বহুল আলোচিত। নজরুল গবেষক নামে পরিচিত রেসিডেন্সিয়ালের স্কুল ও কলেজের টিচার ইরশাদ আহমেদ শাহিনের ভাবগম্ভীর উপস্থাপনায় নজরুল গীতি শুনিয়েছেন তানভীর আলম সজিব ও প্রিয়াংকা গোপ । তানভীর আলম সজীব রাগাশ্রয়ী গানে নজরুলকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। প্রবাসে এমন গান আমরা সচরাচর শুনতে পাইনা । তাঁর সাথে মঞ্চে থাকা প্রিয়াংকা গোপের নাম আমরা আগেই শুনেছি। বর্তমানে বাংলাদেশে যারা নজরুল চর্চা করেন তিনি তাদের অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি নজরুল সঙ্গীত চর্চায় নিবেদিত এই শিল্পীর প্রত্যেকটি পরিবেশনা ছিল অন্যধরণের । গানের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রাগের খেলা আর ব্যবহার দেখিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাদের মাতৃভূমিতে এখনো কেউ কেউ শুদ্ধচর্চার পথিকৃৎ । প্রিয়াংকার গানে মন ভরেনি। সবার প্রত্যাশা তিনি আবার এসে নজরুল ও পুরনো দিনের গানের ভান্ডার খুলে দেবেন আমাদের জন্য । যা এদেশে বড় হওয়া তারুণ্য আর বয়স্কদের তৃষ্ণা মেটাবে ।
কাজী নজরুল ইসলাম দ্রোহের কবি। যে সাম্য আর শান্তির কথা তিনি বলেছিলেন আজও তা প্রাসঙ্গিক। কবি কাজী রাজনীতি করতেন । রাজনীতি সচেতন ছিলেন । সেসব কারণে তাঁকে নীপিড়ন জুলুমের সম্মুখীন হতে হয়েছিল । কিন্তু রাজনীতি এখনো সে তিমির অতিক্রম করতে পারেনি। নাট্যাংশে তারুণ্য দেশবন্ধু সি আর দাশকে এনে যে সম্ভাবনা তৈরী করলো তার জন্য ভালোবাসা। কিন্তু সি আর দাশের ব্যক্তিত্ব আর দেশপ্রেম কত গভীর ছিল বা তিনি তখন খ্যাতির মধ্যগগণে কোথায় অবস্থান করতেন সেটা বোধকরি তাদের জানা নাই । সে কারণে চরিত্রটিকে ম্রিয়মান মনে হয়েছে। দেশবন্ধু চিত্তরন্জন দাশের কাপড় ধোলাই হয়ে আসতো ফরাসী দেশ থেকে। যেদিন থেকে তিনি স্বদেশব্রত গ্রহণ করেছিলেন সেদিন থেকে তাঁর পরিধেয় ছিল খদ্দের ও দেশী কাপড় ।

আমাদের জাতীয় জীবনের অনেককিছুই প্রবাসে খাপ খায় না। খাবার কথাও না। সম্পুর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে থাকি আমরা । কিন্তু ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কারণেই আমরা বিশিষ্ট । আমাদের জাতিসত্তার অহংকার রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালনের মতো মহিরুহ। এঁরা আমাদের সাথে থাকেন বলেই বাঙালি বলিয়া লজ্জা নাই। ধারণা ছিল হয়তো আমাদের প্রজন্মের পর সে ধারা আগের মত থাকবে না । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ধারা অবিনাশী। দিনের পর দিন সে কথা সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে । যে তারুন্যকে আমরা লস্ট জেনারেশান মনে করতে শুরু করেছিলাম তাদের বুকে যে দেশপ্রেম এতো গভীর ভাবে লুকিয়ে তা হয়তো এ অনুষ্ঠান না দেখলে বোঝা সম্ভব হতো না । পথ প্রডাকশান আর রেসিডেনশিয়াল মডেলের প্রাক্তনীদের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে সকলের ।
সিডনিকে এখন আমরা উৎসবের নগরী বলতে পারি। এই অনুষ্ঠানের আগের রাতে সিডনি মাতিয়ে গেছে বাঙালি গায়ক শান। হিন্দি বাংলা উভয় গানে আসর মাত করা শিল্পী। তার আগের সপ্তায় দেখা হয়েছিল এসময়কালের আধুনিক কবি শ্রীজাত’র সাথে। কলকাতা থেকে উড়ে এসেছিলেন কবি। সাথে কবি তন্ময় চক্রবর্তী । তাঁর মতো বাচিক শিল্পী আমি কম দেখেছি। কবি শ্রীজাত ও তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিনী দুর্বার যৌথ অনুষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রমী এক পরিবেশনা। সব মিলিয়ে সিডনি এখন জমজমাট আয়োজনের নগরী।
বাংলাদেশের বাঙালির সাধের কবি কাজী নজরুলকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কাজটি করে যারা আমাদের অভিভূত ও কৃতজ্ঞ করেছে তাদের জন্য শুভকামনা।
অজয় দাশগুপ্ত
ছড়াকার, কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।