প্রেম বা ভালোবাসা মূলত মানব জীবনের মস্তিষ্ক প্রসূত একটি বিশুদ্ধ চেতনাসমৃদ্ধ অনুভূতি। কেউ কেউ বলেন, এটি একটি কল্পনাপ্রসূত বিভ্রান্তিকর অবচেতনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কেউ আবার বলেন, প্রেম বা ভালোবাসা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য চেতনাগুলোর মধ্যে অন্যতম বিচিন্তা।
তবে যে যা-ই বলুক, প্রেমের স্বরূপ প্রেমই। এর কাঠামোগত অনুভূতির বিকল্প কিছুই নেই। এটি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত মানব-মানবীর একটি আবেগীয় প্রকাশের চিরন্তন-শাশ্বত রূপ।
প্রেম বা ভালোবাসা মূলত চিরআবেদনীয়। তাই সেকাল-একালের এর আবেদন আগেও যা ছিল এখনও তা-ই। তবে পার্থক্যটা অনুভবে, আচরণিক রকমফের আর প্রকাশভঙ্গির ধরন-ধারণে এবং লালনে। যুগ-শতাব্দি পেরিয়ে গেলেও প্রেমের মাধুর্যে কোন প্রভাব পড়েনি। তাই তো, প্রেমই প্রাচীন অনুভূতিগুলোর মধ্যে এমন একটি অনুভূতি যা আজো সমাজে টিকে আছে বহাল তরিয়তে।
প্রেম ভালোবাসার সেকালঃ পৌরাণিক আখ্যানমূলক কাহিনীকাব্যের মধ্যে প্রচলিত আছে লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রুমিও-জুলিয়েট, চণ্ডিদাস- রজকিনী, রাধা-কৃষ্ণ, বেহুলা-লখিন্দর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তখন তাদের মধ্যে গাঢ় প্রেমের জ্বলন্ত নিদর্শন ফুটে ওঠেছে অতি আবেগময় রাগ-অনুরাগের ভেতর দিয়ে। সে যুগেও প্রেমে বিরহ ছিল। ছিল ব্যর্থতাও। কিন্তু কেউ কাকে ভুল বুঝে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়নি। খুন করার মতো হিংস্রতা দেখায়নি। তারা নিজেরা নিগৃহীত হয়েছে। আরাধ্য মানুষটিকে না পাওয়ার কষ্টে অনেকেই কুমারী থেকেছে। একজনের দুঃখকষ্ট অন্যজন ভাগাভাগি করে নিয়েছে। যত নিন্দা, অপবাদ নিজে মাথা পেতে নিয়েছে। তবুও ভালোবাসার মানুষটিকে জড়ায় নি। কণ্ঠ শিল্পী ফরীদা পারভীনের গানটি তখনকার যুগের কালজয়ী প্রেমিক-প্রেমিকাদের বেলায় প্রণিধানযোগ্য।
“নিন্দার কাটা যদি না বিঁধিল গায়/ প্রেমের কি স্বাদ আছে বল।”
এমন কী নিজেদের মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করার ইতিহাসও আছে।
পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-দশক বা তারও আগে প্রেম ছিল আপাতমধুর টকঝালমিষ্টি। তবে আগের মত অতটা নিঃস্বার্থের উপমায় ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনি। তখনকার প্রেমের চিঠিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। যদিও যুগেযুগে, কালে-কালে প্রেমের সূত্রপাত ঘটে চারিচক্ষের মিলনে। কারণ, মনের কথা বলার এই এক অন্যরকম ভাষা। চোখের ভাষা, যা বেরিয়ে আসে হৃদয় থেকে, চোখের তারা নাড়িয়ে। নির্বাক মুহূর্তে, অনেক ভিরেও প্রেমিক-প্রেমিকেরা গোপনে চোখের ভাষা বিনিময় করছে। আবহমান কাল থেকে বলে গেছেন তাদের মনের কথা। যেখানে কোন শব্দের ব্যবহার নেই, নেই কোন ব্যাকরণিক নিয়মনীতি।
তাই তো কথাসাহিত্যিক সাখাওয়াত নয়ন বলেছেন, “চোখের ভাষায় বানান ভুল নাই।” ফলে পলকহীন দৃষ্টি হেনে অকপটে বলা যেত হাজারো না বলা কথা। তখন, কী এক অনিঃশেষ ভালো লাগা অনুভূত হতো দুজনার দৃষ্টি বিনিময়ের বহিঃপ্রকাশে। আহা! সেকি স্মৃতিমেদুর মধুরিমা মাহেন্দ্রক্ষণ! সমস্ত সত্তায় ভালোবাসার পুলকসঞ্চার করত গভীর আকর্ষণে। কারণ, চোখের ভাষা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর বহুল প্রচারিত ভাষা। যা সব ভাষাভাষাী প্রেমিক-প্রেমিকেরা সবারটাই সবাই বুঝতে পারে৷ তাতে কি সব ব্যক্ত হতো ? নাহ! তাই অব্যক্ত কথা বলার প্রয়োজনেই শুরু হলো চিঠি বিনিময় প্রথা। তাই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতো সেই চিঠির কলেবর৷
নীলখামে, “ভুলনা আমায়” লেখা রঙিন কাগজে চিঠি লিখত প্রেমিক-প্রেমিকারা। ছোট ভাই-বোনেদেরকে লেবানচুস খাওয়ায়ে হাত করত। তাদের মারফত পাঠানো হতো প্রেমের চিঠি বা চিরকুট। অনেকেই আঙুল কেটে রক্ত বের করে লিখত প্রেমের ছন্দ। সেই ছন্দমাধুর্যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কোমল হৃদয়ের গভীর থেকে বের হতো প্রেমাবেগের অনুরণন। অনুরণিত সোনাঝরা মুহূর্তগুলো ছিল স্বপ্নরঙিন! তাই তো চিঠি পাঠে ওরা বিনিদ্র রজনী পার করে দিতে অনায়াসে। কিন্তু তাতে কি পাঠের আবেদন কিছু কমেছে? মোটেও না! যতবার পাঠ করত ততোবারই যেন নতুন করে প্রেম রসোত্তমে টইটম্বুর ক্যাফে রেস্তোরাঁর মধুর পানীয়ের মতোই ছিল তৃপ্তিকর।
চিঠির ভাঁজে ভাঁজে লাল গোলাপ বা বেলি ফুলের পাপড়ির মৌ মৌ গন্ধে ভরপুর থাকত। কেউবা আতর ছিটিয়ে দিত। ডাকযোগে চিঠি পাওয়ার অপেক্ষার প্রতিটি প্রহর! উহ! সে কি আর বলতে? মনে হতো ৩৬৫ দিনের মতো দীর্ঘ !! চিঠি পেয়ে চুমোয় চুমোয় ভেজাত রঙিন খাম। পড়তে গিয়ে নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেত প্রেমিক-প্রেমিকেরা। ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়তে হতো। বুকের ভেতর কামারশালার হাফরের মতো উঠানামা করত বেরসিক শ্বাসপ্রশ্বাস!
সেসময়ও মেয়েদের প্রতি অভিভাবকদের মনোভঙ্গি ছিল রক্ষণশীল। স্কুল-কলেজ শিক্ষকরা রাখতেন কঠিন নজরদারিতে। ক্লাস শেষে মেয়েদের আলাদা কমনরুমে বসার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। কিছু সময়ের জন্য চোখ ফেরানো হয়তো বন্ধ রাখা যেত। তাই কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠের গানের ভাষায় বলতে চাই,
“চোখ ফেরানো যায় গো তবু মন ফেরানো যায় না
কেমন করে বেধে রাখি মনের খোলা আয়না।
কঠোর নজরদারিতেও আটকানো যেতনা প্রেমের দূর্বার গতিময়তা।
তবে ভয়ভীতি আর ধুকপুকানি ছিল প্রেমিকযুগলের নিত্যসহচর। এতে প্রেমের মধুরতায় যোগ হতো এক অমৃতর অনুভূতি! সাক্ষাতের মুহূর্তটা? উহ! তা ছিল আরো আপাতমধুর রোমাঞ্চকর!
বাড়িতে এলো টেলিফোন সংযোগ! এলো দূরালাপনি। খুশিতে ডগমগ প্রেমিক-প্রেমিকেরা। এবার বুঝি মিটবে মনের পিপাসা। নির্বিঘ্নে জমবে আলাপচারিতা। নাহ! যুৎসই হলোনা এবারও। অভিভাবকের কড়া চোখ রাঙানীতে জমতে থাকে না বলা কথার ফিরিস্তি। স্মৃতিমেদুর প্রেমিক যুগল বুকের জমা কথা নিয়ে ছটফটিয়ে তড়পায়।
একালের প্রেমঃ একাল বলতে বুঝি মূলত ডিজিটাল বাংলাদেশ। আধুনিক প্রযুক্তি স্মার্ট ফোন যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক অবারিত দ্বার উম্মুক্ত করেছে। প্রেম এখন তুঙ্গে! লুকোচুরি নেই। চিরকুট চালাচালি নেই। নেই নীল খামের মোড়া রঙিন কাগজের চিঠিও। প্রেমিকার দেওয়া সূই সূতোয় বোনা “ভুলনা আমায়” রুমালও নেই। তাই “প্রেমিক পুরুষ বড়মিয়া আতরমাখা রুমাল নিয়া” অপেক্ষায় থাকে না নদীর ঘাটে। বাঁশির মনমোহিনী সুরের মূর্ছনায় পাগল করে না বিরহিণীর মন! তাই পানির ছলে খালি কলসি কাখে ছুটে আসে না গৃহবধূ। এখন রাত ভোর করে মোবাইলে কথা বলে। মেসেজের পর মেসেজ বিনিময় চলে নির্বিঘ্নে। পার্কে ডেটিং, ক্যাফেতে ড্রিংকিং, চাইনিজে ইটিং সবই চলছে অবাধে।
একালের প্রেম মূলত বহুরৈখিক। এই বহুমুখী প্রেমের সাথে স্বার্থটাই মূখ্য। এখানে প্রেমের আসল রস-মাধুর্য অনুপস্থিত। দুটি মনের বিনে সূতার মানবিক বন্ধন সেটাও উপেক্ষিত। ফলে যৌনতা মাত্রাতিরিক্তভাবে দখলে নেয় মন-মনন। তাই স্থিতিশীল থাকে না তাদের সম্পর্ক, ধরে আর ছাড়ে। কেননা, প্রেমের মধ্যে লাভ-লোকসান, সফলতা-ব্যর্থতার দরকষাকষি চলে। এটাকে আর যাই হোক সেটেল্ড ভালোবাসা বলা যায় কিন্তু প্রেম নয়। প্রেম বলে-কয়ে আসে না। এর নির্দিষ্ট সময় নেই, বয়স নেই। প্রেমে জাত-কূল, শৈণিবৈষম্য নেই, পদমর্যাদা নেই। প্রেম ধর্ম, সামাজিক অবস্থান বা প্রভাবপ্রতিপত্তির মাপকাঠির বিচারে চলে না। এটি হলে প্রেমে মৌলিকত্ব হারিয়ে যায়। তখনি প্রেম তার আসল খোলস পাল্টিয়ে কৃত্রিম রূপ ধারণ করে। শুরু হয় অভিনয় পর্ব। ওঠতে বসতে খুনসুটি। মনকষাকষি। ইস্! সে এক যন্ত্রণাময় মুহূর্ত!
এখনকার প্রেম-ভালোবাসা তাই পরিকল্পিত মনে হয়। দ্রুত ঘনিষ্ঠতা, ঘুরাঘুরি, হাত ধরাধরি। আকাশ-বাতাস, পাহাড়-সাগর, নদী-ঝর্ণা, চাঁদ-সূর্যকে সাক্ষী রাখা। হাতে হাত, মাথায় হাত রেখে, ছুঁয়ে কতনা শপথের আকাশচুম্বী বাড়াবাড়ি! শুনেছি মনকে কেটে ভাগ করা যায় না। এখন বাজারের মিষ্টি কুমড়ো চিরের মতো ফালি ফালি করে প্রেমিক-প্রেমিকেরা মন দেয়া-নেয়া করে। তেমনি প্রেমের বাজার এখন শীতকালের গরম পিঠা বিক্রির মতো হরদমসে চলছে। চলছে মহামারির মতো প্রতারণা, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ ও যৌন হয়রানিও। ফলে নষ্ট হতে চলেছে আবহমানকালের পরম যত্নে লালিত প্রেমের মূল ভিত্তি বিশ্বাস, আস্থা আর নির্ভরতা। এতে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনবোধের সরলীকরণ। বাড়ছে ব্রেকআপের জটিলতা, হতাশা, বিষণ্ণতা। ঘটছে আত্মহত্যার মতো অপঘটনা।
প্রেমের ভাঙনটা শুরু হয় একপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে। প্রতিশ্রুতি পূরণে অনীহা, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, ধোঁকা দেয়া, মিথ্যা আশ্বাস দেয়া মূলত এখন প্রেমের বেলায় ডাল-ভাত। এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে অনেক প্রেমিকা ঘর ছাড়ে। ফলে ধর্ষিত হয়ে লাশ হয়ে ফেরে। প্রেমের নামে এখন চলছে হিংস্রতা ও প্রতিশোধস্পৃহার মতো জঘন্যতম অপরাধও। যা পবিত্র প্রেমকে করেছে কলুষিত। তরুণ-তরুণীরা নিজেকেই নিজেরা ধ্বংস করেছে বায়বীয় সম্পর্কে জড়ায়ে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রেমের নির্যাসমিশ্রিত মাধুর্য।
প্রেমের সত্যিকারের মাধুর্য ফিরিয়ে আনতে চাই নিজেকে ভালোবাসা। জীবনকে ভালোবাসা। আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বকে সমুন্নত রাখা। প্রেম-ভালোবাসা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বটে কিন্তু অপরিহার্য নয়। জীবন অনেক অনেক মূল্যবান। আসুন, জীবনকে মহৎ করে গড়ে তুলতে নোংরামী পরিহার করে প্রেমের মাধুর্যের নির্যাসটুকু নিংড়ে নিই। সমাজ তথা রাষ্ট্রের বাঁকবদল ঘটাই। তবেই জীবন হবে সুন্দর, মাধুর্যমণ্ডিত ও অর্থবহ ।
পিয়ারা বেগম : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক