আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে সিডনি শহরে এসেছিলেন ফকির আলমগীর আমাদের গান শোনাতে। ফকির আলমগীরের চির বিদায়ের দু:সংবাদ শোনার পর থেকে মনে পড়ছে অনেক স্মৃতি কথা।
ওই সময় সিডনির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেশ থেকে আসা কোনো নামী শিল্পীর সাথে ড্রাম, গীটার কিংবা কি বোর্ড বাজানোর মতো দক্ষ যন্ত্রী তেমন ছিলনা। ফলে প্রশান্ত সাগর পাড়ি দিয়ে এতদূর এসে অনেক শিল্পীই গান গেয়ে পরিতুষ্ট হতেন না, প্রাণ ভরে গান শোনাতে পারতেন না ভক্ত স্রোতাদের। এছাড়া সাথে করে যন্ত্রী নিয়ে আসাটাও আয়োজকদের জন্য ছিল খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ ছিলাম বলে এই ধরণের অনুষ্ঠানে আমি কোনো না কেনোভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়তাম।

যতদূর মনে পড়ে, রকডেলের একটি কমিউনিটি হলে এই সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফকির আলমগীরের অনুষ্ঠানের জন্য যন্ত্রী যোগাড় করাটা ছিল বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। কী-বোর্ড, ড্রামস ভাড়া করা হল। কী-বোর্ড ও ড্রামস কে বাজিয়েছিলেন তা ঠিক মনে করতে পারছিনা। তবে গীটার বাজিয়েছিলো অপু। অপু, হ্যাপী আখন্দের সাথে ব্যান্ড করতো। এছাড়া ফেরদৌস ওয়াহিদ ও একসময় মাইলসের সাথেও গীটার বাজিয়েছে। সব যন্ত্রীদের সাথে নিয়ে কোনো রিহার্সাল না করেও ফকির ভাইয়ের দরাজ ও ভরাট গলার জোরে অনুষ্ঠানটা মোটামুটি উতরে যায়। অবশ্য মনমত গাইতে না পারার জন্যে ফকির আলমগীর বেশ আক্ষেপ করেছিলেন।
আমি তখন প্রকৌশল পেশার পাশাপাশি এসবিএস রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক/সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ হবার পরপরই তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেই। কম্পিউটারের ফাইল ঘাটতে গিয়ে তাঁর সাথে সেইদিনের আলাপচারিতার একছি দূর্লভ ছবিও মিলে যায়। অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হয়। তবে সিডনি সফর খুব একটা সুখকর হয়নি বলেই তিনি জানিয়েছিলেন। তবে সেটা আয়োজকদের বুঝতে দেননি। তিনি শিল্পী হিসেবে যত বড় ছিলেন মানুষ হিসেবেও ততো বড়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা ফকির আলমগীর গানের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখিও করেছেন। সুরও করেছেন আহমদ ছফার লেখা ‘ঘর করলাম নারে আমি’, আলতাফ আলী হাসুর লেখা ‘ও সখিনার’ মত বেশ কিছু কালজয়ী গানের। তাঁর গাওয়া গান গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে এখনো মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। তবে আমার সবচেয়ে ভালোলাগার গানটি হল- ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না। এই গানটিতে বেজে উঠা একাকিত্ব ও না পাওয়ার বেদনার সুর স্রোতাদের কাছে টানে। গানটি বিটিভিতে প্রচারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণীকে ভীষনভাবে আলোড়িত করে। পরবর্তীতে তিনি ফকির আলমগীরের সাথে চিরদিনের সম্পর্কের বাধনে জড়াবার ইচ্ছে প্রকাশ করে। যতদূর জানি, ওই মেয়েটির সাথেই ফকির আলমগীরের বিয়ে হয়।
ফকির আলমগীর হলেন একজন গণ- মানুষের শিল্পী। তিনি গানে গানে সোচ্চার হয়েছেন অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে। একাত্তের মুক্তিযুদ্ধ সহ বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তাঁর গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তার এই বিশেষত্বের জন্যই দেশের আম-জনতার হৃদয়ে তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন
সঙ্গীত শিল্পী ও লেখক, প্রোকৌশলী।
প্রকাশিত গ্রন্থ: কাতারে জীবন যেমন; কাতারে বহতা সময়; খুঁজে পেয়েছি প্রিয়তমা (কাব্যগ্রন্থ)।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।