
কোন এক সাক্ষাৎকারে বাংলা সিনেমার অন্যতম দিকপাল নির্মাতা সেলুলয়েডের কবি খ্যাত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ছবির ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন। থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার ছবিটি দেখে তাঁর খুব ভালো লেগেছিলো। হয়ত তাঁর নিজের ছবির মতো ফারুকীর ছবিতেও তিনি সেই ম্যাজিক রিয়েলেটি দেখতে পেয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি ফারুকীকে নির্মান অব্যাহত রাখার উপদেশ দিয়েছিলেন।
আমরা আজ কথা বলব ভালো সিনেমা এবং বাংলাদেশের নিউ ওয়েভ অব সিনেমা নিয়ে; আর্ট ফিল্ম, প্যারালাল ফিল্ম বা বানিজ্যিক কোন ক্যাটেগরিতে না ফেলে শুধু ভালো ছবি বা মন্দ ছবি বলতে পারি আমরা। ইদানিং বাংলাদেশের ছবিতে তৌকির আহমেদ, সরওয়ার ফারুকী বা কিছুটা আগে তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেলরা নিয়মিত ছবি করে আসছিলেন।শিহাব শাহীন, বিজন ইমতিয়াজ, রুবাইয়্যাত, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা প্রমুখ ফিল্মমেকাররা একটা বা দুটি ছবি বানিয়েই দম নিচ্ছেন। কিন্তু আমি কখনই ভাবিনা এই সব নির্মাতা আর কোন ছবি করতে চাইলে প্রডিউসারের অভাব পড়বে। আমার তো মনে হয় এক অমিতাভ রেজা যদি ছবি বানাতে চান অন্তত দশজন প্রডিউসার অর্থলগ্নী করার জন্য তাঁর দরজায় কড়া নাড়বেন। তবে কি আয়নাবাজি’র মতো সফল ছবি আর বানাতে পারবেন না বা সেরকম নির্মানে তার দক্ষতার অভাব রয়েছে বা তার আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেনি বলে তিনি দ্বিতীয় ছবিতে হাত দিচ্ছেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একটা দুটি ছবি করে তারা থেমে যাচ্ছেন কেনো ? আমার তো মনে হয় তাঁরা ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে নতুন ছবি যদি প্রথমটার মতো দর্শকনন্দিত বা ব্যবসা সফল না হয়। আর একারনেই মনপুরা’র মতো সুপার ডুপার হিট ছবি উপহার দিয়ে ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে ‘কাজলরেখা’ ছবিটির বারবার ঘোষণা দিয়েও গিয়াস উদ্দীন সেলিম তা বানাতে পারলেন না। অথচ সেই সময় তাঁর দর্শক কাজলরেখা’র জন্য অপেক্ষা করেছিলো। তিনি তা না করে অনেক পরে বানালেন ‘স্বপ্নজাল’ যা দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়েছিলো। গিয়াস উদ্দীন সেলিমের এই অভিজ্ঞতা হয়তো অমিতাভ রেজাদের মতো পরিচালককে ভাবনায় ফেলেছে। অথচ পৃথিবীর তাবৎ নন্দিত পরিচালকেরা একের পর এক ছবি বানিয়ে গেছেন।

অন্যদিকে সরওয়ার ফারুকী তাঁর নির্মান অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর নো ম্যান্স ল্যান্ড ছবিটির চিত্রনাট্য তৈরি হওয়ার পর পৃথিবীর বড় বড় প্রযোজকদের সাথে নিয়ে ফারুকী কাজ শুরু করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। হঠাৎ ঘোষণা দিলেন ইন দ্য মিন টাইম ‘সাটারডে আফটারনুন’ বা শনিবার বিকেল নির্মাণ করবেন। দেশে বিদেশের নামকরা অভিনেতাদের নিয়ে ছবিটা শেষ করলেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে দেশে সেন্সর পেলোনা কিন্তু বিদেশের মাটিতে বা ফেস্টিভ্যালগুলোতে ভূয়শী প্রশংসা এবং পুরষ্কার কুড়ালো। আমরা ভেবেই নিয়েছিলাম নো ম্যান্স ল্যান্ড আর হচ্ছেনা। কিন্তু সবার ভুল ভেঙ্গে দিয়ে উপমহাদেশের অন্যতম সেরা অভিনেতা নেওয়াজ উদ্দীন সিদ্দিকীকে প্রধান চরিত্র দিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এর আগে ডুব ছবিতে তখনকার সেরা অভিনেতা ইরফান খানকেও তিনি এভাবে কাস্ট করেছেন। ছবি ভালো হোক মন্দ হোক তাঁর সৃষ্টি কিন্ত থেমে নেই। যেমন থেমে নেই আমাদের অভিনেতা ও পরিচালক তৌকির আহমেদ। অজ্ঞাতনামা, হালদা’র মতো ভালো ছবি তিনি আমাদের পরপর উপহার দিয়েছেন। তবুও বলব বাংলাদেশে ছবি বানানোর হিরীক পরেনি। কোনভাবেই আমাদের চলচ্চিত্র সমৃদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশে সিনেমার নিউ ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে বলে আমরা যে দাবী করছি সেটা সত্যিই ভুল দাবী। আমরা এখন যেটা দেখছি গুণী নির্মাতারা টেলিভিশনে ফিকশনের নামে নাটক বা অনলাইনে ওয়েব সিরিজ বানাচ্ছেন। অথচ অন্তত মাসে একটি ভালো ছবি বড় পর্দা পেলে আমরা সেই নিউ ওয়েভ অব সিনেমার দাবীটি করতে পারতাম।
ওপার বাংলার গুণী পরিচালক অপর্ণা সেনতো সবসময় বলেন তিনি আরও আগে থেকে কেনো ছবি পরিচালনায় আসেননি। সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় ৩৫টি ছবি বানিয়েছেন। একমাত্র সত্যজিতের ন্যারেটিভের মতো করেই হাজার হাজার ছবি নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীতে মৃনাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত,তরুন মজুমদার, তপন সিনহা, গৌতম ঘোষ বা হালের ঋতুপর্ণ ঘোষ (যদিও তিনি নেই), কৌশিক গাঙ্গুলী, শ্রীজিত, অতনু ঘোষ প্রমুখ নির্মাতারা কাজ করেই চলেছেন। এমনকি বুদ্ধদেব বুড়ো বয়সেও বানালেন টোপ নামের সিনেমাটি। প্রতিমাসেই এই সিডনিতে ওপার বাংলার অনেক ছবিই মুক্তি পাচ্ছে। সুতরাং সেই বিবেচনায় ওপার বাংলায় রীতিমত নিউ অয়েভ অব সিনেমা চলছে। বাংলাদেশের পরিচালকরা তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নন, আমরা মুখিয়ে থাকি আপনাদের নির্মিত ছবি দেখবো বলে। আপনাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দূর করে নির্মাণে আসুন। আমাদের প্রয়াত যাদুকরী লেখক হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু একের পর এক ছবি উপহার দিয়েছেন। নয় নম্বর বিপদ সংকেতের মতো কাতুকুতু হাসির ছবি বানাতেও তিনি রিস্ক মনে করেননি। তাঁর হাতেই আমরা পেয়েছি আগুনের পরশমনি কিংবা ঘেটুপুত্র কমলা’র মতো নান্দনিক চলচ্চিত্র। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই আমাদের তারেক মাসুদ এবং ওপার বাংলার ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু বাংলা সিনেমার নান্দনিক নির্মানে বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে।ছবি বানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিচালকরা ভালো গল্প বা ভালো স্ক্রিপ্টের অভাবকে দায়ী করেন। আমার এ প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছে করে তারা কি আমাদের সমৃদ্ধশালী সাহিত্যের দিকে তাকান না। আমাদের রয়েছে শওকত আলী, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক কিংবা হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখের অসাধারন সব গল্প ও উপন্যাস। সত্যজিৎ রায় তো কেবল বিভূতিভুশনের কাহিনী নিয়ে অসাধারণ অপুর ট্রিলজি বানালেন। লালসালু বা লালন কে নিয়ে তানভীর মোকাম্মেল যে অবিচার করেছেন আপনারা সেরা কাজ দিয়ে সেটা তুলে আনেন। এক্ষেত্রে তৌকির আহমেদ তাঁর ফাগুন হাওয়ায় জনৈক গল্পকার টিটো রহমানের ছোট গল্প বউ কথা কও থেকে কি অসাধারণ চিত্রনাট্য এবং ছবি করে ফেলেছেন। সুতরাং চাইলেই সম্ভব।
বাংলাদেশ ও কলকাতার বাইরে আমরা যদি তাকাই তাহলে দেখি পৃথিবীর নামিদামী চলচ্চিত্রকাররা একটা দুটি ছবি বানিয়ে বসে থাকেননি। উদাহরণ দিতে পারি ইরানের। মজিদ মাজিদি, আজগর ফারহাদী, আব্বাস কিরোস্তামী, জাফর পানাহী, সামিরা মাখমালবাফ প্রমুখ নির্মাতাকে নিউ ওয়েভ সিনেমার জনক বলা হয়। তাদের অসংখ্য ছবি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। মজিদ মাজিদি’র চিল্ড্রেন্স অব হ্যাভেন, টারটেল ক্যান ফ্লাই বা কান্দাহার ছবিগুলো দর্শক বারবার দেখেছে। অাজগর ফারহাদী’র সেপারেশন এবং দ্য সেল্স ম্যান পরপর দু’বছর অস্কার জিতেছে।
যে দেশে নারীরা হিজাব ছাড়া বাইরে যেতে পারেনা, যে দেশে একসময় নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করাও নিষিদ্ধ ছিলো। সেই দেশের ফিল্মমেকাররা তাদের ছবি দিয়ে বিশ্ব কাঁপিয়ে দিচ্ছে কল্পনা করা যায়। আমার বাসায় নতুন কেউ এলে আমি তাকে ‘চিল্ড্রেনস অব হেভেন’ দেখাই, এটা ভালো লাগলে বুদ্ধদেবের ‘উত্তরা’, তারপর গৌতম ঘোষের ‘দেখা’ ছেড়ে দেই।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আমি দেখেছি বাংলাদেশে যাদেরকে নিউ ওয়েভ সিনেমার নির্মাতা বলা হয় তারা অধিকাংশই ইরানী নিউ ওয়েভ সিনেমার গুনগ্রাহী। এমনকি মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর অনেক সিনেমায় সেই আভাস স্পষ্ট। সুতরাং বাংলাদেশও একদিন সেই চিহ্ন থেকে যাবে।শেষ করছি একটি সুখকর ঘটনা দিয়ে। সিডনিতে শুরু হয়েছে সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভাল। বিশ্বের অসংখ্য নামকরা সিনেমার সাথে আমাদের সরওয়ার ফারুকীর ‘সাটারডে আফটারনুন’ নির্বাচিত হয়েছে। সেদিন গিয়েছিলাম ডেন্ডি সিনেমায় যেখানে ছবিটি চলবে সেই উৎসবের কর্মযজ্ঞ দেখতে। কথা হচ্ছিলো অস্ট্রেলিয়া’র এক বৃদ্ধ দম্পতির সাথে। তাঁরা এই উৎসবের সব মাস্ট সি ফিল্মের অগ্রিম টিকেট কিনে ফেলেছেন। আমার দেখে ভালো লাগলো যে তাদের সেই তালিকায় আমাদের ছবিটিও আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম তারা পরিচালকের অন্যান্য কাজ সম্পর্কে জানেন কিনা? তারা উত্তর দিলেন, “we have seen his Television before, brilliant film.”
আমি আর কথা বাড়াইনি। আনন্দ অশ্রু নিয়ে সেদিন ডেন্ডি সিনেমা থেকে চলে এসেছি।
বাংলাদেশে এক সময় সিনেমার স্বর্ণযুগ ছিলো। মাঝে এক দীর্ঘ বিরতি। একদিন সরওয়ার ফারুকী, তৌকির আহমেদ, গিয়াস উদ্দীন সেলিম কিংবা অমিতাভ রেজাদের মতো অসংখ্য ট্যালেন্টেড নির্মাতাদের হাত ধরেই আবার সেই স্বর্ণযুগ ফিরে আসবে। সেটাই প্রত্যাশা।
সিডনি, ৮ জুন ২০১৯।
আতিকুর রহমান শুভ
সম্পাদক, প্রশান্তিকা।