[ ১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধে বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিলেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য বুদ্ধিজীবির প্রাণ। ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, ঘাতকদের। বিজয়ের এই মাসে আমরা প্রশান্তিকায় শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। কথাসাহিত্যিক ও গবেষক এস এম জাকির হোসেন লিখেছেন ‘ফিরে দেখা একাত্তর’ শিরোনামের এই মূল্যবান লেখাটি। বিজয়ের এই মাসে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।]
দ্বিতীয় পর্ব:
অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তার “দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ” গ্রন্থের আরেকটি জায়গায় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বাংলার গ্রামাঞ্চলের বর্ননা করেছেন এভাবে- “এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল খুবই আকর্ষনীয়। হাঁটু উঁচু ধানের সবুজ কার্পেট, মধ্যে মধ্যে কাঁচ স্বচ্ছ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়, দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উঁচু কুটিরের সারি সোভা পাচ্ছিল। রাস্তার উভয় পার্শ্বে লাল বর্ণের চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল চিত্র দেখে মনে হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন পূর্নতা লাভ করেছে। আম কাঁঠালের গাছগুলো ফলভারে নুয়ে পড়েছে। চাঁপা ফুলের মন মাতানো সৌরভে বাতাস পরিপূর্ন। প্রকৃতির যৌবন যেখানে থরে থরে সাজানো, সেখানে হতভাগ্য কেবল মানুষগুলোই বিসদৃশভাবে ছিন্নবিছিন্ন!”
একাত্তরের ৪ঠা এপ্রিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পাক বাহিনীর সেনারা যশোর শহরে এক নারকীয় তাণ্ডব চালায়। ধরে ধরে হত্যা করা হয় নিরীহ মানুষদের। নিহতদের মধ্যে ছিল অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমির আলী ও তাঁর সন্তানরা। এম এম কলেজের অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদসহ ছাত্র বকুল, আজিজুল ইসলাম, শফিকুর রহমান, জিন্নাহ, মোসাদ্দেক আলী, ওমর ফারুক, অধ্যাপক সিরাজুদ্দীন, আব্দুর রঊফ, ডাক্তার অবায়দুল হক, ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ, ক্রিকেটার স্বপন বিশ্বাস, চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম, জেলা ছাত্র ক্যাথলিক গির্জার ফাদারসহ ছয়জন, রেলস্টেশন মাদ্রাসার ২৩ জনসহ প্রায় একশ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা ছিল তখনকার প্রতিদিনের চিত্র। সারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে চলেছে গণহত্যা। ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার সুখনগর নামের একটি ছোট শহর, যেখানে কলকাতা যাবার জন্য জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার শরণার্থী। মে মাসের একদিন সকালে দুই ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানী সেনা সেখানে পৌছে। যদিও সংখ্যায় খুব বেশী সৈন্য ছিল না কিন্তু তাদের হাতে ছিল এলেমজি, সেমি অটোমেটিক রাইফেলের মত অস্ত্র। ফলাফল- কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা জীবন্ত শহর পরিণত হয়ে গেল ‘A City Of Death’ এ।
বিখ্যাত লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক JOHN SAAR একাত্তরের জুনে কলকাতায় এসে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন এলাকা। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে ঘুরে তিনি যুদ্ধের সময়কালীন অনেক লোমহর্ষক ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছেন আর সে সময়ের তার সাথে ক্যামেরাম্যান MARK GODFREY এর তোলা দুর্লভ ছবিগুলি আজও সেই ভয়াল কালো সময়ের সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। JOHN SAAR এর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে অনেক মানুষের, শরনার্থীর সাক্ষাতকার নিয়ে প্রকাশ করেছেন। তাতে ফুটে উঠেছে অনেক নির্মম চিত্র। পাক বাহিনীর অনেক অত্যাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে সেই লেখায়। বেঁচে পালিয়ে সীমান্তের ওপাড়ে পৌছে যাওয়া অনেকের কাছ থেকে জানা যায়- আগুন দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া সহ নিরীহ অসহায় গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু কিশোরও রক্ষা পায়নি তাদের অত্যাচারের হাত থেকে।
একজন ক্রন্দনরত মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন JOHN SAAR। মহিলাটি শরণার্থীদের দলের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে। মহিলাটি বলছিল, “ওরা আমাদের পিছনে তাড়া করেছে,আমাদেরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। আমার শিশু সন্তান ছিল আমার কাঁধের উপরেই। লাঠির আঘাতে ওর মাথা গুড়িয়ে গেছে,এখনো ওর রক্ত লেগে আছে আমার গায়ে। ও নেই, তখুনি মারা গেছে।”
জুন মাসের শুরুতেই বর্ষা আরাম্ভ হয়েছে, সেই সাথে শুরু হয়ে গেছে মানুষের দুর্ভোগ। বৃষ্টি যেন উদ্বাস্তু জীবনকে আরও নির্মম করে তুলেছিল। ক্ষুধা, তৃস্নায় ক্লান্ত মানুষগুলোর কষ্ট আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এই বৃষ্টি। শরনার্থী শিবিরগুলোতে ছোট ছোট খুপরি ঘর আর খোলা আকাশের নিচে পাতলা হোগলার চাটাইয়ের আচ্ছ্বাদন এই বৃষ্টির কাছে কিছুই না। যখন ঝড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি নামে নিমিষেই উড়ে যায় চাটাই। ছোট ছোট খুপরি ঘরগুলিতে গাদাগাদি করে মাথা গোজার চেষ্টা করে, তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। দিন রাত বৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না এই সব ছিন্নমূল মানুষগুলোর। সবচেয়ে বেশী খারাপ অবস্থা বৃদ্ধ ও শিশুদের, মাথার উপর আকাশের বিরামহীন বর্ষনে শিবিরগুলিতে পানি ঢুকে পড়ে। তাপমাত্রা নিচে নেমে এলে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, কাশি, সর্দিতে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। একাত্তরের আগস্টে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের একটি নিউজ ছিল এ রকম-
Dr. Mathis Bromberger, একজন জার্মান চিকিৎসক কলকাতার বাইরের একটি ক্যাম্পে কাজ করছিলেন। তিনি রিপোর্ট লিখেছিলেন এভাবে- “এখানে সমস্ত রাত্রি বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হাজার হাজার মানুষ। পর্যাপ্ত আশ্রয় না থাকায় মহিলারাও তাদের কাঁধে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা শুতে পারছিল না কারণ তাদের হাটু পর্যন্ত পানি চলে আসছিল এবং সকাল হতেই অনেকই অসুস্থ হয়ে পড়ে আর মারা যায় নিউমোনিয়ায়। আমরা সিরিয়াস কলেরা আক্রান্ত রোগীদেরকে হাসপাতালে নিতে পারছিলাম না, তারা একের পর এক পড়ে যাচ্ছিল মাটিতে কিংবা পানিতে। এর প্রকোপ কমাতে উচ্চ মাত্রার কলেরা টিকা দেয়া হচ্ছিল কিন্তু ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকর্মীরা ইতিমধ্যেই ৫০০০ মৃতের সংখ্যা গুনেছে এবং প্রায় ৩৫০০০ বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, যা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এখন কর্মকরতারা এই ভেবে আরও চিন্তিত হয়ে পড়ছে যে নিউমোনিয়া, ডিপথিরিয়া এবং যক্ষ্মা না আবার আরাম্ভ হয়ে যায়। একজন ডাক্তারের ভাষ্য ছিল এমন- ‘মানুষ যেন কান্না করতেও পারছে না’ ”
পাকিস্তানী বাহিনীর তাড়া খেয়ে ছুটে চলা অসহায় মানুষগুলির অনেকেই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায় কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের পিছু ছাড়ে না। তারা জানতেও পারে না সামনে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক ভয়ঙ্কর দানব। এই দানবের নাম কলেরা, যা তখন মহামারি আকারে দেখা দেয়। এ যেন মুর্তিমান আতঙ্ক! চারিদিকে শুধু মৃত্যুর ছায়া। জুন মাসের কোন এক সময়ে JOHN SAAR গিয়েছিলেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের একটি গ্রাম করিমপুরে। তিনি সেখানে দেখতে পেলেন শরনার্থী মানুষের অনেক লম্বা একটি মিছিল যাদের অনেকের মুখই ছিল রুমাল দিয়ে ঢাকা। একজন শরনার্থীর কাছে জিজ্ঞেস করতে লোকটি কেবল বলল- “কলেরা”। আশেপাশের শিবিরগুলিতে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরনার্থীর মধ্যে ‘কলেরা’ নামক কালো থাবার নির্মম আঘাতে অকাতরে মারা পড়ছে শত শত মানুষ! বাকীরা ধুকছে! যে কোন মুহুর্তে তাদেরকেও ছোবল হানবে এই ভয়ঙ্কর দানব।
একজন ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক সাংবাদিক JOHN SAAR কে বলছেন- “তারা সংখ্যায় এত বেশী মরছে যে আমরা হিসাব রাখতে পর্যন্ত পারিনি। এই লোকগুলো জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তাদের কোন দিক নির্দেশনা ছিল না, প্রচন্ড রোদে চলছে তো চলছেই। হাঁটতে হাঁটতে তারা এতটাই ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছে যে পথের পাশের ডোবা থেকে আঁজলা ভরে কলেরা রোগবাহী দুষিত পানি পান করছে। তারা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে যে আক্রান্ত হবার পর একদিনও টিকে থাকতে পারছে না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।”
JOHN SAAR এর বর্ননামতে- “তাদের চলার পথে রাস্তায় সর্বত্রই মৃত মানুষ পড়ে আছে। আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা শকুন মরা মানুষের গা থেকে ছিঁড়ে ফেলছে কাপড়, তখনো তাদের অনেকের শরীর গরম! তীক্ষ্ণ, ধারালো ঠোঁটের ঠোকরে ছিঁড়ে খুবলে খাচ্ছে মরা মানুষের দেহ। এই বিপুল সংখ্যক মৃত মানুষের দেহ ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনও খেয়ে শেষ করতে পারছিল না, তাদেরও খাওয়ায় অরুচি ধরে গেছে। জন সার দেখতে পেলেন রাস্তার পাশের ধান ক্ষেতে শাড়ির অংশ দিয়ে মোড়ানো একটি শিশুর মৃতদেহ। শরনার্থীবাহী ট্রাকে চলার কোন এক সময় অসুস্থ শিশুটি মারা গেছে। চলন্ত ট্রাক আর থামেনি, পুটুলি করা শিশুটির মৃতদেহটি চলন্ত ট্রাক থেকে রাস্তার পাশেই ফেলে দেয়া হয়েছে।”
চলবে।
তথ্য সুত্রঃ
১. Newspaper Report: Bangladesh Genocide Archive
২. দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ-অ্যান্থনী মাসকারেনহাস
৩. অস্ট্রেলীয় ইতিহাস গবেষক ড. বিনা ডি কস্তা কর্তৃক গৃহীত ডা. জিওফ্রে ডেভিসের সাক্ষাতকার (1971: Rape and its consequences- Bina D’Costa)
৪. বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ কুলদা রায় এবং এম এম আর জালাল।