ফিরে দেখা একাত্তর । শেষ পর্ব ।এস এম জাকির হোসেন

  
    

[ ১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধে বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিলেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য বুদ্ধিজীবির প্রাণ। ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, ঘাতকদের। বিজয়ের এই মাসে আমরা প্রশান্তিকায় শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। কথাসাহিত্যিক ও গবেষক এস এম জাকির হোসেন লিখেছেন ‘ফিরে দেখা একাত্তর’ শিরোনামের এই মূল্যবান লেখাটি। বিজয়ের এই মাসে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ পড়ুন তৃতীয় এবং শেষ পর্ব।]

শেষ পর্ব:
একাত্তরে এদেশের নারীদের উপর যে বিভৎস নির্যাতন চালিয়েছিল পাক বাহিনী তা মানব ইতিহাসে বিরল। এই যুদ্ধে একটি বড় ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল নারী ধর্ষণ। যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ধর্ষণ ছিল পাক বাহিনীর একটি ‘অস্ত্র’। এটি ছিল পাকিদের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, অত্যন্ত সুকৌশলে এ দেশের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের “উত্তরসূরি” রেখে যাওয়া, যাতে এরা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে। দেশের কোন অঞ্চলই বাদ পড়েনি, তারা সারা দেশে যত্রতত্র এই কার্যক্রম চালায়। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। যাতে পালাতে না পারে তাই বিবস্ত্র করে রাখা হত, মাথায় চুল পেচিয়ে যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে তাই তাদের মাথার চুল কেটে ফেলা হত। নির্যাতন এবং ধর্ষণ করা হত দিনের পর দিন। এর ফলশ্রুতিতে এই বিশাল সংখ্যক ধর্ষিতা নারীদের একটি বড় অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার পর এইসব নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে তাদের পরিবারগুলি। তাদের স্বাভাবিক জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজব্যবস্থা এবং বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেককেই তাদের এমন কি অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বামীরাও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঐ পরিস্থিতিতে অনেককেই বেছে নিতে বাধ্য করে আত্মহত্যার পথ। আবার অনেকে গর্ভপাতের মাধ্যমে মুক্ত হতে চেয়েছে এই আপদ থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের গর্ভপাত ঘটাতে চিকিৎসা সহায়তা দিতে ১৯৭২ সালে এগিয়ে আসেন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস। অস্ট্রেলীয় ইতিহাস গবেষক ড. বিনা ডি কস্তা কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাতকার থেকে উঠে আসে এক বাস্তব চিত্র। সাক্ষাতকারের বিভিন্ন অংশে ডঃ ডেভিস বলেন-
“আমি দেশের অন্য শহরগুলোতেও কাজ করেছি যেখানে হাসপাতালের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি সেখানকার অনেক মানুষকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরপর দেখলাম এর সংখ্যা আরো বেড়েই চলেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হাল ধরলে আমি সে স্থান ছেড়ে অন্য স্থানে ছুটে গেছি।”

“সবচেয়ে সুন্দরী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে বাকিদের সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হতো। এদেরকে খুব কষ্ট দেয়া হতো এবং পর্যাপ্ত খাবারও দেয়া হতো না। অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেয়ার ফলে অনেকেই ক্যাম্পের মধ্যে মারা গেছে।”

“ওই সময় কেবল নারী ধর্ষণের বিষয়টিই মুখ্য ছিল না; যুদ্ধশিশু বিষয়টিও প্রধান হয়ে ওঠে। এসব যুদ্ধশিশুর লালন-পালনের ভার তুলে দেয়া যাচ্ছিল না কারো ওপর। সে সময় কয়েকটি সংগঠন এসব যুদ্ধশিশুদের ইউরোপে পাঠাতে তৎপর হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে তাদের দেখভালের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আর যেসব হোমস ছিল সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসব যুদ্ধশিশু দত্তক নিতো।”


ডা. ডেভিস সাড়া দেশে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং বিভিন্ন জেলায় চালানো নমুনা জরিপের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান তৈরি করেন। তাঁর সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশী। তিনি আরও জানান শুধুমাত্র অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই প্রায় ২ লাখ।

একাত্তর- বাঙালির কাছে আনন্দ বেদনার অন্যরকম এক অনুভূতি। একদিকে যেমন বিজয়ের আনন্দ ঠিক তার আড়ালেই জমে আছে অনেক হারানোর বেদনা। একাত্তরের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বরের আগের দিন পর্যন্ত পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে তথাকথিত পাকিস্তানী মুসলিম রাস্ট্রজান্তা এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর গোষ্ঠী দীর্ঘ নয় মাস ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিরীহ মানুষের উপর চালায় ভয়ঙ্কর গনহত্যা। এই গণহত্যায় কত লোকের প্রাণ হারিয়েছে এই নিয়ে আজও চলছে নানা বিতর্ক। বাংলাদেশের দাবী এই সংখ্যা কমপক্ষে ত্রিশ লাখ, রাশিয়া ও ভারতের মতেও মৃতের সংখ্যা এরকমই আর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজার! বিশ্ববিখ্যাত গণহত্যা বিশেষজ্ঞ LEO KUPER তাঁর ‘GENOCIDE’ বইয়ে লিখেছেন ১৯৭১ সালে নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাংলাদেশীকে হত্যা করে হয়েছিল।

তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সে সংখ্যাতত্বই দেয়া হোক নয় মাসের যুদ্ধে হত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, বাড়িঘরে আগুন দেয়াসহ যে পরিমাণ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তা কোন সংখ্যা দিয়েই বিচার করা সম্ভব নয়। পাক সেনা এবং দেশীয় রাজাকার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোটিরও উপরে মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যায়। খাবার, ঔষধের অভাব, রোগ-শোকে ভুগে একসময় এইসব মানুষের কাছে যেন কাম্য হয়ে ওঠে- মৃত্যু।

এই মৃত্যুর মিছিল এখনও চলছে। এ জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে আর এখন প্রাণ দেয় স্বাধীনতার চেতনা অন্তরে ধারন করার অপরাধে। হরিপদরা তখন জীবন দিয়েছে, ভিটেছাড়া হয়েছে, দেশ ছাড়া হয়েছে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধের জন্য, আর এখন তাদের ভিটেয় ধ্বংসের আগুন জ্বলে, এখনও ঘুমন্ত হরিপদরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শুধুমাত্র স্ব-পরিচয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্খায়।
তখন তাদের চারপাশে ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল আর এখন লোভ, হিংস্রতা এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল- পার্থক্য শুধু এটুকুই।

তথ্য সুত্রঃ
১. Newspaper Report: Bangladesh Genocide Archive
২. দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ-অ্যান্থনী মাসকারেনহাস
৩. অস্ট্রেলীয় ইতিহাস গবেষক ড. বিনা ডি কস্তা কর্তৃক গৃহীত ডা. জিওফ্রে ডেভিসের সাক্ষাতকার (1971: Rape and its consequences- Bina D’Costa)
৪. বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ কুলদা রায় এবং এম এম আর জালাল।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments