অনেক অনেক দিন আগের কথা। বগার বাগ নামে একটি গ্রাম ছিল। ঐ গ্রামে ছিল আম বাগান, কাঁঠাল বাগান, তাল-নারকেল, খেজুর এবং সুপারী বাগান। ছিল প্রচুর বট গাছও।কথিত আছে গাছগাছালি পরিবৃত থাকায় এই গ্রামে সন্ধ্যা হলেই ঝাঁকেঝাঁকে বকপাখি এসে রাতযাপন করত। এই জন্য এই গ্রামের নাম বলা হতো বগার বাগ। তবে এটাও লোকশ্রুতি ছিল ঐ গ্রামে বাস করত এক ধনী কৃপণ গৃহস্থ। তার অঢেল জমিজমা ছিল। কিন্তু তিনি কৃপণ হলেও ছিলেন সৌখিন। সততাও ছিল। ছিল না কোন ছল-চাতুরী। বাগান করা ছিল তার সখ। তাই তিনি বছরবছর জমি কিনতেন আর বাগান করতেন।
এই যে গ্রামে এত্ত এত্ত বাগান এগুলো তার হাতেই গড়া। তিনি এতটাই কৃপণ ছিলেন যে, সারাজীবন চারটি শার্ট দিয়ে জনম পার করেছেন। জন্মগ্রহণ করার পর একবার, মক্তবে কোরান শরীফ পাঠ নেওয়ার সময় একবার। সুন্নতে খাৎনা এবং যৌবনে বিয়ের সময় একবার করে নতুন শার্ট কেনা হয়েছিল। শার্ট কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন হাটে-বাজারে বা বেড়াতে গেলে। জরুরী মুহূর্ত অল্প সময়ের জন্য পরতেন। বাড়িতে এনে শার্ট সাবান-সোডা দিয়ে ধুয়ে পাটের শিকায় ঝুলানো মাটির হাঁড়িতে ভরে রাখতেন। তার কৃপণতার মজার লোকশ্রুতি এখনো লোকমুখ প্রচলিত আছে। আধাকেজি দুধ পনেরজন লোককে খাওয়ানোর পরও বাকী দুধ দিয়ে তিনি দই পাততেন। তার একটি মাত্র পুত্র সন্তান ছিল। সে এতটাই লম্বা ছিল যে সবসময় পিঠ বেঁকে থাকত। আর গলা ছিল বকের মতো লম্বা। তাই মানুষ তাকে বগা বলে ডাকত। সেই সুবাদে কৃপণ গৃহস্থকে বগার বাপ বলে ডাকা হত। কথিত আছে, তিনি বগার নামে তার সহায়-সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ উইল করে দেন। বাকী তিন ভাগের এক ভাগ জনসাধারণেরর জন্য উইল করে দেন।
অনেকেই বলাবলি করত সেই থেকেই গ্রামের নাম বগার বাগ নামে পরিচিতি পায়। আজ বগার বাগ নিবাসী, সেই কৃপণ বগার বাপের কিচ্ছা বলব। বগার বাপের স্ত্রীও স্বামীর মতোই হাড় কৃপটিনী ছিল। ছিল অপূর্ব সুন্দরীও। একদিনের ঘটনা বলছি। তখনকার দিনে এক পয়সার অনেক মূল্য ছিল। তিনি তার স্ত্রীকে এক পয়সার সরিষার তেল কিনে দিলেন। বললেন, এই তেল দিয়ে যেন রান্না-বান্না আর ঘরের সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো হয়। উল্লেখ্য যে, সে যুগে তখনও কুপি বা হ্যারিকেনের প্রচলন ছিল না। এমন কী কেরোসিনের প্রচলনও ছিল না। ফলে তারা মাটির তৈরি তৈলদানীতে সরিষার তৈল ভরত। তাতে পুরাতন কাপড়ের টুকরো প্যাঁচিয়ে সলতে তৈরি করত। তৈলদানীতে তৈল ঢেলে সলতে চুবিয়ে কুপির কাজ চালাতো। কৃপণ বলে সন্ধ্যায়ই তারা ভাত খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তেন। তবে গৃহস্থ এবং তার স্ত্রী দু’জনই সামান্য লেখাপড়া জানতেন। তাদের মধ্যে প্রগার ভালোবাসাও ছিল। এটাতে গৃহস্থের কোন কার্পণ্যতা ছিল না। জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক ছিল। তাই তারা প্রায়ই সখের বশে বা রোমান্টিক মুহূর্তে কবিতার ভাষায় কথা বলাবলি করতেন। আজ রান্নার তৈল শেষ। তাই স্ত্রী স্বামীকে খিলি পান মুখে পুরে দিল খোশ মেজাজে। আবার স্বামীও স্ত্রীর মুখে খিলি পান পুরে দিল। পানের ভেতর ছিল নানা পদের খুশবু জর্দা। দুজনে জোশ মুডে পান চিবুচ্ছে। খুশবু জর্দার সুঘ্রাণে মুখরিত ঘরময়। এমনই রোমান্টিক মুহূর্তে গিন্নী তার স্বামীকে বললেন,
ঘরের তৈল অইল গো শেষ,
সোয়ামির তরে করছি পেশ।
এই কথা শুনে কৃপণ গৃহস্থ স্ত্রী প্রেমে গদগদ। এমন পুলকিত মুহূর্তে গৃহস্থও কৃপণ স্বভাব সুলভ আচরণ ভুলে গেল। উপরুন্তু মুচকী হাসি দিয়ে স্ত্রীর থুতনীতে টোকা দিয়ে বলল,
এক পয়সার তৈল
কী সে খরচ অইল?
তারপর গৃহস্থ গিন্নীও কম রসিক নন। স্বামীর মুখের কাছে গিয়ে পানভরা গালে চিমটি কেটে বললেন,
আমার মাথা, তোমার পায়
আরও দিলাম ছেলের গায়।
এ ঘরে বাত্তি, ঐ ঘরেও বাত্তি
মইধ্যে রানলাম সালুন পাত্তি।
সাত রাত্রিভর গান অইল
কোন অভাগী ঘরে আইল
বাকী তৈলটুকু ঢাইল্যা নিল।
গৃহস্থ ভদ্রলোক তার স্ত্রীর মুখে এমন সুন্দর কাব্যরসে সিক্ত হলেন। গিন্নীর মুখে তৈল খরচের চুলচেরা হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করায় তিনি মুগ্ধ । তাই আর টুশব্দটি পর্যন্ত করতে পারে নি। বরং রাগ না করে মনে মনে স্ত্রীর তারিফ করলেন। পান খাওয়া লালরঙা ঠোঁটে একটু আদরও করলেন। আগে বেশি বেশি খরচ করার জন্য রাগারাগি করতেন।
তারপর স্ত্রীক বললেন, তৈলের ঝুলনা বোতলখানা দাও তে গিন্নী। বগার মা স্বামীর এক হাতে ঝুলনা বোতল অন্য হাতে ছাতা তুলে দিলেন। সাথেসাথে আরেকটি খিলি পানও মুখে পুরে দিলেন। স্ত্রীর মহব্বতের হাতের খিলি পান চিবুতে চিবুতে তৈল আনতে তখনই রওয়ানা হলেন হাটে। তবে পুরানো তিলপড়া শার্ট কাঁধে ঝুলাতে ভুল করেন নি তিনি। বগার বাপে কৃপণ হলেও ছায়াঢাকা, পাখিডাকা বগার বাগের তিন ভাগের এক ভাগ সম্পত্তি মানুষকে দান করে গেছেন। আজো বিশাল ঘাটলা বাঁধা দীঘি, পুকুর আর তাল-সুপারী, নারকেল গাছের সারিসারি বাগান মানুষের নজর কাড়ে।
পিয়ারা বেগম
কথাসাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক
তারাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।