বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে শতবর্ষী হতেন এবছর। ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে নিহত হন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ও স্থপতি।জাতীয় শোকদিবসে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত প্রশান্তিকার এই আয়োজনে লিখেছেন মেলবোর্ন প্রবাসী চিত্রশিল্পী এবং লেখক মিতা চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লেখার মতো যে জ্ঞান বা যোগ্যতা লাগে তার কোনোটিই আমার মতো এই ক্ষুদ্র একজনের নেই, প্রশান্তিকার সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ ভাইয়ের অনুরোধেই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। না, আমি রাজনৈতিক কোনো বাখ্যা বা কোনো গবেষণামূলক কিছু বলবোনা। কারণ আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক পরিচয় লাগে না , একজন বাঙালি বা বাংলাদেশী মাত্রই বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেন বা লালন করেন। আমি শুধু আমার নিজ অনুভূতির ব্যাখ্যাই দিবো!
‘বঙ্গবন্ধু’ এই নামটির সঙ্গে ঠিক কবে বা কিভাবে আমার বা আমাদের পরিচয় তা মনে পড়েনা, শুধু এটুকু মনে পড়ে যখন থেকে নিজের স্মৃতি ঠিক তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু নামটি জীবনের সঙ্গে জড়িত। আমার মনে আছে, আমাদের বসার ঘরের দেয়ালে আমার যখন থেকে স্মৃতি ঠিক তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর একটি বিশাল সাদাকালো ছবি সযতনে টাঙানো ছিল। ছবিটা ঠিক কত বড় ছিল আমার জানা নেই, কিন্তু সেই শিশু চোখে বিশাল বঙ্গবন্ধুকে আমার চোখে আরো বিশাল মনে হতো। তার নিচে ছোট্ট একটি লেখা ছিল, একদিন বানান করে পড়তে পারলাম ছবিটার নিচে লেখা, “পুরুষোত্তম পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখেছি!” আমার সেই শিশু বয়সে এই কথাটির ভার বা গুরুত্ব বোঝার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না, কিন্তু দিনদিন যতই বড় হতে লাগলাম ওই লেখাটার ওজন যেনো আমি টের পেতে শুরু করলাম। ছবির নিচের লেখাটা পড়লেই যেনো আমার সেই কিশোরীবেলাতেও আমি এক অন্যরকম উদ্দীপনা হতো, আমার হৃদয়ে এক অন্য রকমের গর্ব বোধ হতো। আমার পরিবার মুক্তিযোদ্ধার পরিবার, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে আমার মা এবং বাবা দুই পরিবারকেই যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছিলো। আমি বড় হয়েছি সেইসব কাহিনী শুনে, আমার বাবা কেমন করে রাতের অন্ধকারে চা বাগান দিয়ে কিশোর যুবক বা তরুণকে পার করে দিতেন সীমান্ত, বা কেমন করে আমার নানী বাড়িতে পাকিস্তানীরা আগুন দিয়েছিলো, নির্বিচারে লুট করেছে গোলাঘরে গোয়ালঘরে আগুন দিয়েছে , কেমন করে আমার মামা প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ও সাংসদ আবদুল্লাহ সরকার বা আমার বৃদ্ধা নানী অন্তঃসত্ত্বা খালা সেই রাতে স্রেফ কপালগুনেই বেঁচে গিয়েছেলন। এইসব কাহিনী শুনতাম আর নিজের অজান্তেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যেত, আর তাই “পুরুষোত্তম পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখেছি”, এই কথাটি যেন আরো গাঢ় ভাবে উপলব্ধি হতো।
আমার যখন থেকে স্মৃতি তখন থেকেই মনে পরে ৭মার্চ আমাদের পরিবারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমার এখনো মনে আছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে বের করা সেই ক্যাসেট’টার কথা, যেখানে বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধের গান ছিলো আর ছিলো ৭মার্চের সম্পূর্ণ ভাষণ। আমার বয়স তখন কত ৬ বা ৭ বোধ করি, কিন্তু সেই সময়েও বঙ্গবন্ধুর সেই দরাজ বজ্রকণ্ঠের ৭মার্চের ভাষণটি আমার সেই শিশু মনে এক অন্য রকম উত্তেজনা তৈরী করতো। মনে হতো আমিও যদি পারতাম সেইদিন ওই বিশাল জনসমুদ্রের একজন হতে ! আমি ওই ভাষণ শুনে শুনে প্রায়ই আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম, “মা তুমি কি সেদিন গেসিলা ভাষণ দেখতে ? আব্বা গেসিলো ?” আম্মার নিয়মিত হতাশার উত্তর , ” না যাইতে পারিনাই, তখন তো তোমার আম্মা সিলেট চাকরি করতো তাই “, উত্তরটা আমার মনে একরকম না পাওয়া বোধ তৈরী করতো, আম্মাকে আমরা বলতাম তোমরা কেউ দেখোনাই? আম্মা বলতো তোমার ছোটমামা , আব্দুল্লাহ মামা তোমার জ্যাঠা উনারা ছিলেন তো ঐদিন, উনারা দেখেছেন। এই উত্তরটায় নিজের মনের না পাওয়া বোধটা কিছুটা হয়তো কমতো এই ভেবে যে যাক আমার আমার বাসার কেউ তো সেদিন ছিল। এ ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার নিখাঁদ শিশু মনের কিছুটা প্রাপ্তির অনুভূতি। তো সেই ক্যাসেটের অনেকগুলো গানের মধ্যে একটি একটি গান ছিল, “শোনো একটি মজিবুরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ ” এই গানটি যা আমার সেই ছোট্ট শিশু মনকেও ভীষণভাবে নাড়া দিতো। আম্মা বলতো, “মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গান স্বাধীন বাংলা বেতারে শুনে কত যে কেঁদেছি “।
আমি এরশাদের শাসনকাল বা তার স্বৈরাচারী সময়কাল খুব একটা দেখিনি, আর যতটুকু দেখেছি তার স্মৃতি বেশ ধূসর, শুধু মনে আছে আমার আম্মা দিনরাত আমার ৪র্থ মামা আব্দুল্লাহ সরকার আর আমার সেজো বোন, এই দুইজনের চিন্তায় অস্থির থাকতেন। তবে বিএনপির প্রথম শাসনামল আমার বেশ ভালোই মনে আছে। সেই সময়টাও যখন নাকি আমাদের গনত্রন্তের যুগ, দেখেছি ৭মার্চ বা ১৫অগাস্ট উৎযাপন করতে লোকজন ভয় পেতো, কেমন যেনো একটা গোপন গোপন ভাবে এই দিনগুলো উৎযাপন করতে হতো। ততদিনে আমি কিশোরী তাই আগ্রহ বা কৌতহলবোধটা বেশি। আমায় বেশ ভাবতো যে মানুষটা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলো, যে মানুষটি তাঁর জীবনের ৫২% সময় জেলে জেলে কাটিয়েছেন তাঁর দেশ বা দেশের মানুষের মুক্তির জন্য তাকেই আমরা কি করে নির্মমভাবে খুন করি আবার তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উৎযাপন করতেও কেনো আমাদের ভয় পেতে হয়? কেনো আমাদের বই পুস্তক সব জায়গায় বঙ্গবন্ধুর নাম অনুপুস্থিত? আমি যেন আরো বেশি করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়তে লাগলাম, তাঁকে জানতে লাগলাম। এবং যতই তাঁকে জানতে লাগলাম ততই বঙ্গবন্ধু আমার কাছে যেন এক মহাকাব্য হয়ে উঠলো। এই মহাকাব্য যতই পড়তে লাগলাম ততই মুগ্ধতা বাড়তে লাগলো। বঙ্গবন্ধুই সেই মহাকাব্য যাকে একনজর দেখার জন্য আবাল বৃদ্ধবণিতা, কৃষক, মজুর, কুলি, ছোট্ট শিশু, টগবগে যুবক ছুটে যেতেন, ছুটে যেতেন তার সেই বজ্রকন্ঠ শুনতে। বঙ্গবন্ধু সেই মহান ব্যক্তি যে এই পলিমাটির বাংলায় সকলের, সকল শ্রেণীর নেতা হয়েছিলেন, এই হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র পংক্তিমালা, অজস্র গান, যিনি হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ধূলিকণার, পলিমাটি স্নাত প্রতিটি সরল হৃদয়। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী আর দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের জনগণ তখন জানেনা কেমন আছেন তাদের সেই নেতা , আমার মা বলেছিলেন তিনি বেশকিছু নফল রোজা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আর এরকম ভালোবাসা বহুলোকেই দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জন্য। এই পোড়া দেশে এমন ভালোবাসা আর কোনো নেতা কোনোদিন পাবেকিনা জানা নাই। আমি খুবই সাধারণ ভাবে মাঝে মাঝে চিন্তা করি যে , একটা মানুষ ও তার আদর্শকে পরাজিত অপশক্তি কতটা ভয় পেলে এমন নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করতে পারে। এই পরাজিত অপশক্তি জেনে গিয়েছিলো যদি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকে তবে এই বাংলার বুকে কোনোদিন কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে অপরাজনীতি করতে পারবে না, কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, তারা জেনে গিয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শাসকদের দলে নয় শোষিতের দলে।
কিউবান নেতা ফিদেল ক্রাস্ত বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি “। আর আমরা সেই অভাগা জাতি যারা সেই হিমালয়কে নিজ হাতে খুন করেছি। ১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার শক্তি কোথায়? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি”। আপনার দুর্বলতা কি? এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি “। আর সেই ভালোবাসা থেকেই তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল তাঁকে তার দেশের মানুষ কোনোদিন কোনো ক্ষতি করবেনা, আর তাইতো বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতেই অতি সাধারণ জীবনই বেছে নিয়েছিলেন। যার চরম মূল্য তিনি দিলেন জীবন দিয়ে। ঘাতক কি শুধু বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারকে খুন করেই ক্ষান্ত ছিলেন? তারা বঙ্গবন্ধু নামটাকেই এত ভয় করতেন যে বঙ্গবন্ধু নামটি মুছে দিতে যত রকমের নোংরামি করা যায় সব করেছিল। তারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলো, বঙ্গবন্ধুর নাম বইয়ের পাতা থেকে মুছে দিতে চাইলো, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে যতরকমের কুৎসা আছে রটালো। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নামটি তারা ঢেকে রাখলো। কিন্তু পারলো না, বাঙ্গালী বাংলাদেশী ঠিকই একদিন সত্য কে সামনে নিয়ে আসলো। ইংরেজরা ২০০ বছরেও পারেনি সিরাজউদ্দৌলাকে ইতিহাসের খলনায়ক বানাতে তেমনি সেই পরাজিত অপশক্তিও পারিনি বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলা আর বাংলাদেশীর হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে।
বঙ্গবন্ধুকে যতই মুছার চেষ্টা করা হয়েছে ততই তিনি এক বিশাল উদার আকাশে রূপ নিয়েছেন যেখানে প্রতিটি বাংলাদেশী মাত্রেরই অধিকার। মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু এই দুই অহংকার কেউ কোনোদিন আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমাকে জানতে চাওয়া হয়েছিল আমার কাছে বঙ্গবন্ধু কি ? আমার কাছে বঙ্গবন্ধু এক মহাকাব্যের নাম, এক বিশাল আকাশের নাম , একটি স্রোতস্বীনি নদীর নাম।
মিতা চৌধুরী
চিত্রশিল্পী, লেখক
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।