বঙ্গবন্ধু বাঙালীর পরম সম্পদ এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বাংলাদেশের স্থপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গি পাড়ার এক ছায়াঘেরা পল্লীতে জন্ম নিয়েছিলেন। জন্মেই তিঁনি পান সংক্ষুব্ধ স্বদেশ। দেশের কল্যাণে ছাত্র জীবন থেকে হয়ে উঠেন নিবেদিত এক প্রাণ। জেল -জুলুম হুলিয়া কোনকিছুই তাকে দেশপ্রেম থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
জগদ্বল পাথরের মতো ব্রিটিশ -বেনিয়ার দু’শ বছরের শাসন- নিপীড়ন তাড়াতে তিনি কাজ করেছিলেন নিখাদ ভাবে। মুক্ত হয়েছিল ভারত। জন্মেছিলো দ্বিজাতিতত্বের পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র।একথা প্রমাণিত যে লোকাচার -সাহিত্য- সংস্কৃতি বিবর্জিত শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে রাষ্ট্র গঠন হলে তা টিকেনা। বাংলাদেশ তার উৎকৃষ্ট প্রমান। পাকিস্তান জন্মের প্রারম্ভেই হাজার বছরের বাংলা ভাষা-সাহিত্য -সংস্কৃতির উপর চলে আসে তীব্র আঘাত। বাঙালি জনগোষ্ঠীর এই আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মুজিব জেলখানায় থেকেও অনশন ধর্মঘট করেন। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয় সালাম, বরকত, রফিক, শফিক সহ আরো অনেকে। ভাষার এই আন্দোলন বাঙ্গালীকে স্বাধিকার আন্দোলনে ধাবিত করে। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপনের মধ্যদিয়ে বাঙালির স্বাধিকারের দাবি চূড়ান্ত করেন বঙ্গবন্ধু। প্রিয় নেতা তোফায়েল আহমেদের ভাষায় “তিনি আমাদের ছাত্রনেতাদের ডেকে বারবার বলেছেন, সাঁকো দিলাম স্বাধীনতা আদায় করে নাও।”
এরই মধ্যে বিভিন্ন পেশার ৩৫ জন সহ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা। জেল থেকে জেলে বঙ্গবন্ধুর বিচরণ জাতিকে আশান্বিত করে তোলে এক অভীষ্ট লক্ষ্যে যাবার সোপানে। আর জেলখানার অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে। ছাত্র জনতার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলার সমাপ্তি হয়। মুক্তি পান বাঙালির চির কাঙ্খিত স্বজন শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ ফেব্রুয়ারী ১০ লক্ষ ছাত্র জনতার জোয়ারে তিনি ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু খেতাবে। শুরু হয় বাঙালির দাবি আদায়ের প্রহর থেকে প্রহর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা (১৬৭ সিট ৩১০ আসনের মধ্যে ) পেয়েও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে দেয়া হয় নাই। ক্ষমতা হস্তান্তের টালবাহানা জাতিকে অস্থির করে তোলে নিদারুন ভাবে।
৭ মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে যুগশ্রেষ্ঠ এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ছাত্র, শ্রমিক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারী , রাজনীতিক সবাই উদ্ধেলিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে শ্রদ্ধাসিক্ত প্রয়াত অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ৭ মার্চ থেকেই শত্রুমিত্র উভয় পক্ষই তাঁর অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করে। সে অভিপ্রায় স্থান পায় কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।
২৫ মার্চ রাতের গভীর অন্ধকারে বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। তার অবর্তমানে তাঁর সুযোগ্য সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নেতৃত্ব দেন এবং এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সামিয়ানায় বাংলাদেশ জন্মলাভ করেন এবং বিজয় অর্জিত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। প্রয়াত অধ্যাপক ড.আনিসুজ্জামান আরো বলেন মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি নিয়ে বলেন “মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় তারই নামে। এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধের কালে শত্রুপক্ষের সঙ্গে আপস করতে চান, তারাও ব্যবহার করেন তারই নাম। এমনই ছিল তাঁর নামের মহিমা, তাঁর নামের সম্মোহন।”
এই যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হন। আর দুই লাখ নারী তাদের সম্ভ্রম হারায়। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে যে দেশটির স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন এবং জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন। একটি যুদ্ধ-বিধস্ত দেশকে গড়ে তোলার অভিযাত্রায় তিনি নিয়োজিত হন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কাছ থেকে। এই বিয়োগান্তক দিনে জাতি হারায় বঙ্গবন্ধুর সকল কাজের সহযোগী, উৎসাহ, সাহস -সময়উপযোগী সিদ্ধান্ত দেবার চিরন্তন স্বজন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও তাদের নব পরিণীতা বধুদ্বয় ও শেখ রাসেলকে। বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ ও ভাগ্নে- ভাগ্নে শেখ মনি ও আরজু মনিকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম হৃদয় বিদারক ঘটনা একটিও ঘটেনি। সারা বিশ্ব এই ঘটনার জন্য নিন্দা ও আপসোস করেন।
বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক -শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে এ বিয়োগ ব্যথাকে তুলে ধরেছেন, কেউ দেশান্তরী হয়েছেন।
তাঁর মৃত্যুকে নিয়ে নির্মেলন্দু গুণ কথা বলতে না পারায় বলে উঠেন ” সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি-রেসকোর্স পারহয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ -গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।” গুণ বলছেন, হাজারো সাথীদের নিয়ে নানা ভাবে যেমন “১৯৭৫ এ আমি হারিয়েছি আমার প্রতীক- শৌর্য-বীর্য ধারা, অন্ধকারে। তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে একা গৃহ হারা, স্বপ্নহীন ক্ষোভে বসে থেকে, ঘুমে ঘুমে আত্মগোপনে ক্লান্ত। একটা কিছু উপেক্ষা করে দাঁড়াতে চাই, বাংলার মাটি বাংলার জল আমাকে কি নেবে ?”
বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণের পর প্রায় একুশ বছর ক্ষমতায় ছিলোনা আওয়ামী লীগ তবুও বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতিটি মানুষের অন্তরের মনি কোঠায়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে ক্ষমতার পালা বদলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। ইনডেমনিটি বিল বাতিল করে শুরু হয় ঘাতকদের বিচার কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে জেলা জজ আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেন ১৯৯৮ সালে। আপিলের সুরাহা হয় ২০০৯ সালে। জাতি কলঙ্ক মুক্ত হয় -বিচার হীনতা থেকে জাতি বেরিয়ে আসে। বিচার পাবার দীর্ঘসূত্রিতা, বিচারকে অস্বীকার করেনাই। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের মানুষের দুর্গতির অন্ত ছিলোনা। তথাকথিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বাংলদেশ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হয় -বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হন প্রধানমন্ত্রী। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার যেটি ছিল হাজারো সন্তানহারা মায়ের -বোনের-ভাইয়ের আহাজারি। শেখ হাসিনা সরকার এটি শক্ত হাতে মোকাবেলা করছেন।
তরুণ প্রজন্ম আজ বঙ্গবন্ধুকে জানার সুযোগ পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা ভাষায় যে পরিমান লেখালেখি হয়েছে অন্য কাউকে নিয়ে তা হয়নি। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি লাইন সম্পূর্ণ হবেনা শোকাহত দিনগুলো হোক শক্তির অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর জীবন -ত্যাগ নিষ্ঠাবান জীবনের আদর্শিক চেতনা অনুরণিত হোক বাঙালীর হৃদয়ের মর্মে -মর্মে। দেশে বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকে সন্মান জানানো হচ্ছে।
লেনিন, মাও সেতুং, ফিদেল, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর কে নিয়ে আজ পৃথিবী গর্বিত।
পরিশেষে প্রবাসী কবি দাউদ হায়দারের ভাষায় বলব, “তুমি নেই বলে বিপন্ন মানুষ
দু:স্বপ্নের আঘাতে আঘাতে রচিয়েছে এপিটাফ।”
ডক্টর মো: সিরাজুল হক
: আইনজীবী; সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অস্ট্রেলিয়া।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।