বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় । অজয় দাশগুপ্ত

  
    

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কঠিন করে তুলেছে হুজুগে বাঙালি। এখন যেদিকে তাকাই খালি মুজিব কোট আর মুজিব সেনা। এই কোট আর সেনার আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। যাঁকে আমাদের জীবদ্দশায় জীবিত দেখেছি এবং করুণ ভাবে নিহত হতেও শুনেছি। তাঁর শেষ বিদায় ছিলো অপ্রত্যাশিত আর বেদনার। সে সময় তিনি তাঁর সহযোগী এবং দলকে নিশ্চিহ্ণ করার ষড়যন্ত্রে ঠেকাতে আমরা ব্যবহার করতাম তাঁর ইমেজ আর তাঁকে। এখন পেছন ফিরে তাকালে বুঝি কী অসীম শক্তি তাঁর। নির্মমভাবে পরিবার পরিজন সহ নিহত মানুষটিকে এতো অপচেষ্টার পরও রুদ্ধ করা যায়নি। বরং তিনি বারবার ফিরে এসেছেন। আর আজ?

আজ এমনই এক হাল তাঁকে ছাড়া সবকিছু অচল। ভালোমন্দ যার যা খুশী লিখছে বলছে এবং এমনও দেখছি তাঁকে নিয়ে চলছে বাণিজ্য। বঙ্গবন্ধুর একটা চমৎকার নাম আছে। শেখ মুজিব, শেখ মুজিবুর রহমান । সে নামটির পাশাপাশি আমাদের অগ্রজ ও অভিভাবকেরা তাঁকে ভালোবেসে ডাকতো শেখের ব্যাটা । কেউ বা শেখ সাহেব। এসব নাম- চিহ্ন মুছে কেবল বঙ্গবন্ধু আমার কেন জানি ভালো লাগে না । কেন তাঁকে শ্রদ্ধা করে বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা যাবে না ?  তিনি তো ছিলেন জনগণের বন্ধু। তাঁর চরম দুশমনও জানে কি আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় তিনি সবাইকে বুকে টেনে নিতেন।
আজ তাঁর জন্মদিনে বাংলা একাডেমির বর্ধিত বই মেলা শেষ হবে। একটা কথা বলা জরুরী মনে করি। এই যে তাঁকে নিয়ে অজস্র পুস্তক, এই যে গল্প কবিতা গদ্যের ঢল এখানে কি একটা প্রশ্ন থেকে যায় না ? আমরা বড় হয়েছি বঙ্গবন্ধু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির শাসনামলে। তখন তাঁর নামও নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রের কোথাও নাই তিনি। অথচ কী আশ্চর্য তখন তিনি ঘরে ঘরে হৃদয়ে হৃদয়ে। তখন যাঁরা সাহস করে একটি বই বা একটা লাইনও লিখেছেন সেগুলোই বুকে ধারণ করেছে মানুষ। আর আজ? তাঁর চিন্তা দর্শন তাঁর ভাবনা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে পন্য হয়ে গেছে কিছু মানুষের। এতো বই আর এতো এতো গবেষণাহীন প্রাণহীন লেখায় মানুষ কি আসলেই আগ্রহী ? না তারা কিছু পাচ্ছেন সেখানে?
আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুকে পোশাকী এসব আচরণ ও নাম থেকে মুক্ত করে যথাযোগ্য ভালোবাসায় সিক্ত করার সময় এসেছে আবার।
এই মানুষটির অবদান সূর্যের আলোর মতো। সোজা কথায় তিনি ও মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সমার্থক। তাহলে এতো আড়ম্বরতার দরকার কোথায়? যে মূল কাজটি করার দরকার সেটি যে আইনের মাধ্যমে অসম্ভব তা সবাই জানেন । আইন করে এদেশে কেন কোন সমাজেই কাউকে প্রতিষ্ঠা বা খারিজ করা যায় না। গেলে ইনডেমিনিটি আইনেই বাতিল হয়ে যেতেন তিনি। আইন যাঁরা করেছেন ভাবছেন সবকিছু হয়ে গেছে তাঁদের সাথে নেতার আদর্শের ফারাক অনেকখানি। মূলত মানুষের মনে ছিলেন বলেই কেউ তাঁকে উপড়ে ফেলতে পারে নি। পারবে ও না। এই সূর্যসম মানুষটিকে গান্ধী এমন কি জিন্নাহ র মতো সর্বজনগ্রাহ্য করা হয়ে ওঠে নি আমাদের। তা করতে পারলে আইনের দরকারই পড়তো না । ভারত পাকিস্তানে কোন দল পাওয়ারে আসে আর কোন দল যায় সেটা বড় কথা না বড় বিষয় তাদের জাতির পিতা একজন ই । এ নিয়ে কেউ তর্ক করে না। এতোবছর দেশশাসনের পরও কি বঙ্গবন্ধুর দল তা নিশ্চিত করতে পেরেছে ? যদি তা না হয়ে থাকে তার জন্য মূল দায়ী জিঘাংসা আর প্রতিশোধের রাজনীতি। সেখান থেকে সবাইকে সরে আসার আ্হবান ও আছে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিতেই । তিনি যে সাধারণ মাফ বা মার্জনা ঘোষণা করেছিলেন তার কারণ ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের সামাজিক সহাবস্হান । যা পরবর্তীকালে একাত্তরের দালালেরাই ভুলে গিয়ে পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছিল। এরপর আর কেউ কথা রাখেনি। তাই আমাদের কায়মনোবাক্যে কামনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এবার সর্বজনীন করে তোলা হোক ।
তাঁর দান অবদান ত্যাগের প্রতি ঝোঁক কম বাঙালির। এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের দেখলে তাঁদের কথা শুনলে কি মনে হয় তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে পারবেন ? পারবেন একমাত্র সাদা পান্জাবী আর পায়জামা পরিধান করে রাজনীতি করতে? আমাদের নেতার পুত্রদের নামগুলো দেখেন। তুর্কী বীর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা কামাল পাশা থেকে উদ্ধুদ্ধ হয়ে কামাল জামাল আবদুল নাসের ছিলেন মিশরের আধুনিক নেতা। তাঁর নাম থেকে জামাল । আর কারাগারে পাঠ করে মুগ্ধ হওয়া দার্শনিক ব্রাটেন্ড রাসেল থেকে রাসেল। এই সব ভাবনা চিন্তার ধারে কাছেও নাই আজকের নেতারা। আজকালের হুজুগে কর্মীরা এসব জানেনও না। তাঁরা এ ও জানেন না শেখ মুজিব বলতেন আমার মৃত্যুর পর কবরে একটা বাঁশের চোঙ্গা দিয়ে দিস। লোকে যেন জানে আমি চুঙ্গা ফুঁকেই রাজনীতি করতাম। এই সরলতা এখন উধাও।
সিডনির একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সাথে লেখক।
অথচ এই মানুষটিকে দেশ বিদেশে সবাই  ভালোবাসতো। বৃটেন আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত এমনকি পাকিস্তানের সুধিমহলে ও তাঁর সুনাম । কারণ তিনি ভন্ডামী পছন্দ করতেন না। এবং বাকশাল গঠন করলেও তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক। এমন কি ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে সংখ্যায় একজন হলেও আমরা তা মেনে নেব? এই যে ন্যায্যতা মানা সেটাই এখন উধাও। তা ছাড়া উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ও তিনি হতে পারেন উত্তরণের হাতিয়ার। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের মতে: দুর্দিনে পথনির্দেশ এবং প্রেরণার জন্য আমাদের বঙ্গবন্ধুর কাছে সাহায্য চাইবার যথেষ্ট কারণ আছে। শেখ মুজিবের চিন্তা এবং বিচার-বিশ্লেষণ যে সব দিক থেকে আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, উল্লেখ করতে চাই।
প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হিসেবে শেখ মুজিব ছিলেন অগ্রগণ্য। তার দৃষ্টান্ত থেকে এই বিষয়ে সব দেশেরই শেখার আছে। বর্তমান ভারতের পক্ষে তো বটেই, বঙ্গবন্ধুর ধারণা ও চিন্তা উপমহাদেশের সব দেশের পক্ষেই শিক্ষণীয়। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বাংলাদেশ অনেক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিনি কেমন বাংলাদেশ চান, বঙ্গবন্ধু সে কথা পরিষ্কার করে বলেছিলেন। তাই আমরা খুব সহজেই ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে তার অবস্থানটা বুঝে নিতে পারি।
বঙ্গবন্ধুকে কেউ ছোট বড় কোনটাই করতে পারবে না। এটা যেমন তাঁর চরম বিরোধীদের বুঝতে হবে তেমনি জানতে হবে বিশ্বাস করতে হবে তাঁর দলের নেতাদেরও । তাদের ভয় কাটানো আর বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হলেই তিনি থাকবেন তাঁর নির্দিষ্ট আসনে স্বমহিমায়। সে বঙ্গবন্ধু অথবা শেখ মুজিবকে কেউ কখনো হটাতে পারবে না । আমাদের দেশ ও জাতির জন্য এমন নেতা জরুরী। আর সে কাজ করতে হলে স্তাবকতা আর বাহুল্য বাদ দিয়ে তাঁকে অনুসরণ তাঁর জন্য ভালোবাসা এবং আদর্শ মেনে রাজনীতি করার কোন বিকল্প আছে?
উত্তরটা সবারই জানা।
অজয় দাশগুপ্ত
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। 
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments