বঙ্গবন্ধু হত্যা: নেতৃত্ব সংকট ও আদর্শিক বিপর্যয় । রণেশ মৈত্র

  
    

দীর্ঘকাল পর সমাবর্তন উৎসবের আয়োজন হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মনিত উপাচার্যও। তাই তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের।
যেহেতু রাষ্ট্রপতি যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই স্বভাবতই কঠোর নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছিল ধানমন্ডীর ৩২ নং বাড়ী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন তাবৎ এলাকায়, ছাত্রাবাস সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলি ও ছাত্রীবাসগুলিও। সেনাবাহিনীর যানবাহনও চলাচল করছিল তাদের ট্যাংকসহ। ট্যাংক যদিও এ জাতীয় কর্মসূচীতে রাজপথে নামানোর কথা নয় তবুও তাকে ততটা অস্বাভাবিক বলে বিবেচনা করেননি অনেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তিনি তো শুধুমাত্র একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশের জনগণের জীবন মরণের সাথী। স্বাধীন এই দেশটির স্থপতি। আজ প্রশ্ন জাগে ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ এ প্রকৃতই কি বাংলাদেশে ভোর হয়েছিল? রাতের নিকষ কালো অন্ধকার কেটে উঠেছিলো কি উজ্জ্বল কোন সূর্য? অন্তত: বাংলাদেশের আকাশে? আকাশে সেদিন কি বাতাস বইতে দেখেছিল বাঙালি? নদীর জল বা সমুদ্রের টেউয়ে কি দোলা ছিলো প্রবল বাতাস তার নিত্যদিনের অভ্যাসমত? পাহাড় কি সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, পাহারা দিচ্ছিল কি বাংলাদেশকে অপর পাড় থেকে কোন শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে? জীব-জন্তু প্রাণীকূল? তারাই বা কি করছিল ঐ ১৫ আগস্টের ভোরে? নিদ্রিত ছিল কি? শত্রুর আগমন টের পেয়ে ‘ঘেউ ঘেউ’ করে আর্তনাদ করে গৃহস্থকে সজাগ করতে সচেষ্ট ছিল কি পোষা কুকুরেরা? ফোঁস ফোঁস করে উঠেছিল ঘরের বেড়ালগুলো? আর বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানুষগুলি? নেতা কর্মী, মুক্তিযোদ্ধারা, কৃষক মজুর, খেটে খাওয়া মানুষেরা? তাঁরা কি রোজকার মত নিরুদ্বিগ্ন স্নিগ্ধ একটি ভোরের সুবাতাস ও প্রাকৃতিক সবুজ দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন।

আকাশ-বাতাস-পাহাড়-পর্বত-নদ-নদী-সমুদ্র সাগর মহাসাগর সবই ছিল নিন্তরঙ্গ, নিস্তব্ধ।
আর হাজার হাজার কর্মীরা? মুক্তিযোদ্ধারা? বেতারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার খবর এক মেজরের কণ্ঠে (মেজর ডালিম) বারবার শুনলেও বিশ্বাস করতে কেউই পারছিলেন না। প্রথমত: শেষ অবধি যখন বুঝাই গেলো সত্যিই ওরা হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুকে। আওয়ামীলীগ কর্মীরা ঘরে বসে হাহুতাশ না করে ছুটলেন একের পর এক নেতার বাড়ীতে। অনেকেই দেখতে পেয়েছেন নিজ নিজ বাসভবনে নেতারা অনুপস্থিত। হয়তো বা তাঁরা কোথাও গোপন কোন সভায় মিলিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন করণীয় নির্ধারণ করছেন। আবার কেউ কেউ হয়তো আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মোট কথা কর্মীরা সারাদিন অতিবাহিত হলেও কোন দিক নির্দেশনা না পেয়ে হতাশা গ্রস্থ হয়ে পড়লেন।
আবার আওয়ামীলীগেরই একটি মহল প্রচার করে বসলেন, বঙ্গবন্ধু নেই বটে, কিন্তু ক্ষমতায় আওয়ামীলীগই আছে কারণ বাকশালের দুই নম্বর নেতা এবং সাবেক আওয়ামীলীগের প্রথম সহ-সভাপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

বস্তুত: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর রক্তাক্ত লাশ ধানমন্ডী ৩২ নম্বরে দ্বিতল বাড়ীর সিঁড়িতে রক্ত ঝরাচ্ছিল একদিকে। অপরদিকে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ শপথ নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। একই দিন একের পর এক সামরিক বাহিনীর প্রধানেরা আনুগত্য প্রকাশ করছিলেন তথাকথিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাকের কাছে। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্যদের সিংহভাগ অংশও মোশতাকের নেতৃত্বাধীন নতুন মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে একের পর এক শপথ নিলেন। অসহনীয় সেই দৃশ্যাবলী বেদনাদায়কও বটে। কিন্তু নেতাদের এহেন আপোষকামিতা ও সুবিধাবাদী ক্রিয়াকলাপ তরুণ কর্মীদের মনে একদিকে যেমন চরম বিভ্রান্তি-অপরদিকে মারাত্মক হতাশাও সৃষ্টি করেছিল। ফলে তাৎক্ষণিক কোন প্রতিবাদ সংগঠিত করতে দেখা যায়নি। প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে কিন্তু তা অনেক দেরীতে।
যাঁরা ঐ মুহুর্তে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে পারতেন সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান প্রমূখ।

তাৎক্ষণিকভাবেই সামরিক বাহিনীর প্রহরাধীনে থাকাবস্থায় স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাকের নির্দেশে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁদের সকলকে আটকে রাখা হয়। প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের তাঁদেরকে একে একে জেলখানার অফিসকক্ষে ডেকে এনে। সবাই তাঁরা এমন প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল। তাঁর নীতি, আদর্শ বাস্তবায়ন করা হবে মর্মে প্রথমে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হোক। তারপর তাঁরা ভেবে দেখবেন। নতুবা নয়।
পরিণতি দাঁড়ালো ৩রা নভেম্বরের মর্মান্তিক হত্যালীলা।

যেদিন ভোরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, ঐ দিনই সন্ধ্যাবেলায় প্রদত্ত আকস্মিক এক বেতার ভাষণে খোন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে দাবী করে বঙ্গবন্ধুকে “গণতন্ত্র ও ইসলাম বিরোধী” ভূমিকা অবলম্বনের দায়ে অভিযুক্ত করে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন অথচ তাঁর নির্দেশেই দেশের সকল প্রথম স্থানের নেতাকে বঙ্গবন্ধুসহ নির্মমভাবে বিনাবিচারে হত্যা আটক ও কারাগারে হত্যা প্রভৃতি চালানো হলো-সমস্ত মিডিয়ার ন্যূনতম স্বাধীনতা হরণ করা হলো। স্তম্ভিত হলো বাঙালি জাতি স্তম্ভিত হলো গোটা বিশ্ব।

বিশ্বস্ত ও নীতিনিষ্ঠ মন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদকে বঙ্গবন্ধু স্বহস্তে ১৯৭৩ এ মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করলেন কিন্তু রেখে দিলেন খোন্দকার মুশতাককে চরমভাবে আদর্শিক শত্রু এ কথা জানা সত্বেও।
সেই সাম্প্রদায়িকতাবাদী দলগুলি আজও দিব্যি ধর্মের নামে সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বজায় আছে, রাষ্ট্রধর্ম দিব্যি নতুন করে সংবিধানে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে, সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ স্থাপন করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াতে ইসলামী-হেফাজতে ইসলাম প্রমূখ ঐ বৈধতার সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে নানা সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম দিয়ে চলেছে বাংলাদেশকে যেন বাংলা-পাকিস্তানী ভাবধারা ও আদর্শ সংবিধানে বজায় না থাকে-মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রকৃত অস্তিত্ব যেন বজায় থাকে।
কোন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক ও চিন্তাশীল দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা কিছুতেই ভুলতে পারেন না যে বাঙালি জাতি কদাপি আপোষ করে না-করেন নি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যদি তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা নিয়ে আপোষ করতেন সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তিনি কিন্তু সে পথে হাঁটেননি। তাই দেশটা স্বাধীন হতে পেরেছে। তবে বঙ্গবন্ধু কিছু মারাত্মক ভুল করে ছিলেন যার মাশুল তাঁকে এবং বাঙালী জাতিকে দিতে হয়েছে-আজও দিতে হচ্ছে।

এখন আমরা কি করবো? আমরাও কি হাঁটবো ভুলের পথে? আপোষের পথে? বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শ বাঁচবে কি তাতে? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে ঐ পথে?
আপোষ দেবে না সমাধান-তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু। ঐ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জিয়া এরশাদের বিসমিল্লাহ, জামায়াত-হেফাজতেদর বৈধতা ও রাষ্ট্রধর্ম সংবিধান থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে ৭২ এর মূল সংবিধান চালু করে গণতন্ত্রের পথে নতুন করে অভিযাত্রা শুরু করা ছাড়া গত্যান্তর নেই।
বঙ্গবন্ধু অমর হোন।
ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক।

রণেশ মৈত্র
: রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট
, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments