[ সময়ের নন্দিত কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক বদরুজ্জামান আলমগীর জন্মেছেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। বহু বছর ধরে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। ২১ শে অক্টোবরে বদরুজ্জামান আলমগীরের জন্মদিনে প্রশান্তিকার আয়োজন “ বদরুজ্জামান আলমগীরঃ বৃক্ষ একটি মনোহর” এ লিখেছেন তাঁর নিত্য শুভার্থী কবি, লেখক ও সম্পাদক লালন নূর।]
যিনি মন ও মননে সদাই খুলে রাখেন এক সুরেলা আরশি – তিনি বদরুজ্জামান আলমগীর। গ্রামীণ রাতের শোকাতুর ঝিঁঝিঁ পোকারা সদা জাগ্রত তাঁর নাগরিক চেতনার বৈভবে। বদরুজ্জামান আলমগীর পুষ্প আর প্রসাদের বিহ্বলতায় প্রতিনিয়ত ফুটে ওঠেন মায়াবী মূলের সারল্যে। সেখানে ঝুলে থাকে হৃদয়ের টান আর শিহরিত পাখিদের মুখরতা। গদ্য, কবিতা কিংবা নাটকে তিনি যেন জল ছলছল নদী, কলমের ডগায় ডুবে দিয়ে জেগে থাকা অতল শিকড়ের বাংলাদেশি মূল। একেবারে বাংলাদেশি ভাষা ও শব্দের সহজিয়া সরল বিন্যাসে আড়ষ্টতাকে ঝেড়ে ফেলে তাই তিনি লিখে ফেলেন মরমীয়া বাঙালির নিজস্ব সংবেদ –
‘আমি কোনভাবেই মোকাম করে উঠতে পারি না পূর্বজন্মের স্মৃতি আর আগামী জন্মের পিছুটানের মাঝখানে একটি লোকগীতির সুরের মধ্যে কে তুমি ফুটে থাকো এমন পদ্মফুল – লোটাস, লোটাস!’
(আনন্দধারা বহিছে । হৃদপেয়ারার সুবাস)
যা কিছু অতীত, যা কিছু পুরাতন — সেখানেই প্রোথিত মানুষের প্রার্থণার ভাষা-উপভাষা। বাংলা সাহিত্যের উৎস থেকে উতসবমুখরতা, সবকিছুই সাবলীল প্রকাশে বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখায় মূর্তিমান, সরব। চর্যাপদের জীবনভাস্য থেকে তিনি খুঁজে তুলেন বোধের বিস্তার, মধ্যযুগীয় ধর্ম-ধারনা থেকে প্রসারিত হয় তাঁর ভাবনার শাখা-প্রশাখা; যা এসে আধুনিকতায় হয় বহু-বিস্তারী আলোক-বিচ্ছুরণ। কিভাবে যে তিনি প্রাচীন সাহিত্যের আলো-অন্ধকার থেকে মধ্যযুগের ধর্মীয় ভাবনা মাড়িয়ে আধুনিকতার আলোয় উঠে আসেন তাঁর কথার কারিগরি দক্ষতায়- সেটা ভাবলে এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন তাড়িত করে শিল্পের স্মারক। চেতনার দুয়ারে করাঘাত করে রাবীন্দ্র ভাবানুরণনঃ
“কত অজানারে জানাইলে তুমি,/কত ঘরে দিলে ঠাঁই —
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু,/পরকে করিলে ভাই ।
পুরানো আবাস ছেড়ে যাই তবে,/মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে ,
নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন/সে কথা যে ভুলে যাই ।
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু,/পরকে করিলে ভাই।” [গীতাঞ্জলী, ৩]
ভাব ও ভাষার ভারবাহী ভাবনাগুলো মন্থন করে বদরুজ্জামান আলমগীর বানাতে পারেন উপশমের মলম; যা বোধকে করে বহ্নিময়, চেতনাকে করে দীপ্তিমান। উৎস থেকে বহ্নি থেকে জীবনের যাত্রাপথে যাতনাময় যে জ্বালা, তাকে এক অনাবিল আলোয় তিনি করে তোলেন জোছনামুখর। তাই তো সাহিত্যের উৎস থেকে বহ্নিময় শিখাকে তিনি প্রজ্জ্বলিত করে তোলেন মৌখিক শব্দের মশালে। নিজেকে সকল প্রাপ্তির উর্ধে রেখে লোভহীন নির্লিপ্ত প্রকাশ সাহিত্যের মূল সৌন্দর্য। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলছেন—“মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, উপলক্ষের দ্বারা লক্ষ্য প্রায়ই চাপা পড়ে; সে গান শিখিতে চায়, ওস্তাদি শিখিয়া বসে; ধনী হইতে চায়, টাকা জমাইয়া কৃপাপাত্র হইয়া ওঠে; দেশের হিত চায়, কমিটিতে রেজোল্যুশন পাস করিয়াই নিজেকে কৃতার্থ মনে করে (সাহিত্য, সৌন্দর্যবোধ)। বদরুজ্জামান আলমগীর এখানে সর্বান্তকরনে সফল এক সারথির নাম। যে কোন শৈল্পিক প্রয়োজনে সর্বজনীন তিনি। অবলীলায় মিশে যান সর্ব-মানুষের কাতারে; কিন্তু সেখানেও তিনি নিজস্বতায়, স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল। সেলিম আল দীনকে নিয়ে লিখতে গিয়ে নোবেল পুরস্কার প্রসঙ্গে বদরুজ্জামান আলমগীর বলেছেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক, করপোরেট অর্থনৈতিক দুনিয়ার প্রকল্প। কত বড় লেখককে তুমি ডুবাইলা, কত মাঝারি লেখককে তুমি ভাসাইলারে…তা একটু চোখকান খোলা রাখলে প্রতিবছরই চোখে পড়ে’। তাঁর লেখনীর ধার যেন তীব্র শেল হয়ে ঢুকে যায় মর্মের মূলেঃ
‘একটি মানব শিশু যে-মুহূর্তে জন্ম নেয় ঠিক সেই মুহূর্তেই তার সম্পূর্ণ জন্মগ্রহণের ঘটনাটি ঘটে না।
প্রত্যেকটি জন্মই একটি ইতিহাস ও পরম্পরার ঘনীভূত রূপ: সেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত একবিন্দুতে এসে একান্নবর্তী হয়; — আমাদের আলাদা আলাদা কোন জন্মদিন নেই; আমরা সবাই জন্মেছি একদিনে- আমাদের একটাই জন্মদিন- ১৬ই ডিসেম্বর।’
(৫৬ হাজার বর্গমাইল, বদরুজ্জামান আলমগীর)

বদরুজ্জামান আলমগীরের অনন্যতা হলো তাঁর নিজস্ব স্বর, বাচনভঙ্গি ও চয়িত শব্দের যোজনা। তিনি যেন শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে দেন বুননকৌশলের চমৎকারিত্বে; আর তা থেকে বের হয়ে আসে যাদুকরী জামদানি। বদরুজ্জামান আলমগীর কবিতা লেখেন না; বরং তিনি যা-ই লেখেন তা-ই কবিতা হয়ে যায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতিদিনের অতি পরিচিত ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে তিনি দিয়েছেন কবিতার মহান অথচ ঘরোয়া শরীর। বাঙালি জীবনের অনিবার্য লোহাকে তিনি কাঁচা সোনায় রূপান্তরিত করেছেন। অনিবার্য অথচ অতি চেনা ঘটনার চরিত্রগুলো আবার কথাও বলে তাদেরই নিজস্ব ভাব, ভাষা, শব্দ ও আঙ্গিকের স্থানিক বিচারে। আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার সঙ্গে সুফিবাদী মরমিয়ার যোগসাধনে নতুন এক সম্পূর্ণ সাদাকালো বাংলাদেশি চিত্রকল্প ও ভাষাভঙ্গিমার উপস্থাপন বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখায় জ্বলন্ত আগুনের ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। মৃত্তিকাবতী বাঙালির মর্মের ভিতরে তিনি এক করে মিশিয়ে দেন কৃষ্ণ, কার্ল মার্ক্স ও মনসুর হাল্লাজের জীবন-দর্শন –
‘মেঘে মেঘে আগুন আছে হিয়ার ডলক
সবা মাঝে কৃষ্ণ থাকে আয়নাল হক’।
(জন্মাষ্টমী । সঙ্গে প্রাণের খেলা )
যন্ত্রজীবনের মন্ত্রময় দিনযাপণ লেখকের সাংস্কৃতিক উদযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে জীবন আর দৈনন্দিনতার তীব্র টান শাণিত হয় শিল্পের ছোঁয়ায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক অসাম্য আর অসঙ্গতিতে বদরুজ্জামান আলমগীর সর্বদাই সোচ্চার, নম্রতায় উচ্চকণ্ঠ। লেখনীতে তিনি রৌদ্রের ডানা দিয়ে ঢেকে দেন ধর্ম ও সমাজের গ্রহণ। রসবোধ আর রসদের সমাহারে তিনি আবার সতত ভাসমান। একদিকে শ্বাসত বাংলা আর সর্বজনীন সংস্কৃতির নিরেট উপস্থাপন, অন্যদিকে জীবনের অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয় – এই দ্বিবিধ সংশ্লেষ ও সংযোজনে তিনি রেখে যান দক্ষতার ছাপ। ঠাট্টা-মশকরার ভঙ্গিতে সজোরে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তোলেন আমাদের বিবেকের বোধঃ
‘আমি দুর্গা, আমিই মা দুর্গা হয়ে গ্যাছি,
আমার ১০ হাত,
১০ হাত বাড়িয়ে আছি তোমাকে আগলে নেবো বলে
আমার মাথা যে নেই, চোখ উপড়ে নিয়েছে অসুর
আমি দেখতে পাচ্ছি না,
তোমাকে বুকে আগলে যে নেবো-
তোমাকে ছুঁতে পারছি না
আমার পুত্র, ও কন্যা আমার,
আমার দুচোখ বিদ্ধ করেছে অসুর!’
(আমিই মা দুর্গা, বদরুজ্জামান আলমগীর)
বোধ ও বোধির দীর্ঘকালের সাধনা ও সৃষ্টির প্রবাহ ও সংরক্ষণ বদরুজ্জামান আলমগীরকে দিয়েছে পেলব অনন্যতা। গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলছেন-“জন্মের সময় আমরা একটি জন্তু হয়ে জন্মাই। কিন্তু সংস্কৃতিই আমাদের মানুষে পরিণত করে; পরিণত করে সামাজিক জীবে। সংস্কৃতি দিয়েই একটা মূল্যবোধ, মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণার অধিকারী হই। বিদগ্ধ রুচির সুশীল মানুষে পরিণত হই”। এই বিদগ্ধ চেতনার স্ফুরণ মেলে বদরুজ্জামান আলমগীরের সবগুলো লেখায়। জন্মদিনে লেখকের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
