বাংলাদেশের কাঁধ থেকে রোহিঙ্গারা নামবে কবে? -এস এম আলী আকবর

  
    

পাঁচ কোটি মানুষের বিশাল (২.৬২ লক্ষ বর্গমাইল) মিয়ানমারে অতিরিক্ত আরো ৭০ কোটি মানব ঢুকালেও, ওদের মানব ঘনত্ব প্রতিবেশী বাংলাদেশের সমান হবে না! সেই মিয়ানমার হতে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে উল্টো, বাংলাদেশ নামক ‘মানব সুতিকাগার’ এ ঢুকিয়ে, এর দক্ষিন-পূর্বঞ্চলীয় জেলাটির সমতল-পাহাড়ী পুরো অঞ্চলটাই একেবারে ছাড়খাঁড় করে ফেলা হয়েছে! অথচ কোথাও কোনো উচ্চ-বাচ্য নেই!
বাংলাদেশের অবস্থা এতটাই বিপন্ন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং (২৬ জুন-২০১৯) জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে বলেছেন, “অতি দ্রুত রোহিঙ্গাদেরকে ফেরৎ পাঠাতে না পারলে দেশের ‘স্থিতি ও নিরাপত্তা’ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে!” সম্প্রতি বাঙ্গালী-রোহিঙ্গা বিরোধসহ নানা উপস্বর্গ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে!
অথচ আমরা বুঁদ হয়ে আছি এই ভেবে যে চীন, ভারত ও রাশিয়া ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেই মিয়ানমারের অপকর্মে সমর্থন দিচ্ছে, তাই তাঁরা নির্দোষ! আর মিয়ানমার যেহেতু আমাদের কোনো কথাই শুনছে না, সুতরাং ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হজম করা ছাড়া আর উপায় কি?
আশ্চর্যজনকভাবে, কারো মনেই প্রশ্নের উদয় হচ্ছে না যে-
• মিয়ানমার, চীন, ভারত ও রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ও দহরম-মহরমের দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে কেন?
• কোন কারণে, মিয়ানমারের মত এক অসামাজিক রাষ্ট্রের সহিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার নামে আমরা ওদের ভেলকি-বাজিতে ঘুরপাক খাচ্ছি? এখানে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা, দায় বা দুর্বলতাটা আসলে কি?
• খোদ মিয়ানমারসহ সারা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল ভূমি বিরান পড়ে থাকতে, ভিটেচ্যুত রোহিঙ্গাদের যায়গা কেন আরেক ‘অভিশপ্ত মানব কারখানা’য়? সেদিকে সভ্য দুনিয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কেন?
• যে ‘উদ্ভট ইস্যু’তে জন্মগত অধিকার প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের উপর গজব নেমে এসছে, একই ইস্যুতে সেখানকার চীনা, তিব্বতী ও মঙ্গোলীয়সহ অন্যান্যদের ক্ষেত্রে কি হচ্ছে? অদ্ভুত সেই জিকির চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে, দুনিয়ায় কি নির্মম ‘কিয়ামত যজ্ঞ’ নেমে আসতে
• সত্যি সত্যি উল্টো অভিবাসন শুরু হয়ে গেলে, উত্তর-দক্ষিণ গোটা আমেরিকায় মানব বলতে অবশিষ্ট থাকবে কারা? সুবিশাল অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটিকেই বা পাহারা দেবে কারা?
• ব্যাপক জনচাপে পিষ্ট বাংলাদেশ কি পেরেছে, একই ইস্যুতে পাকিস্তানী বিহারীদেরকে ফেরৎ পাঠাতে?
• অথবা ১৯৪৬ সালে সংগঠিত রক্তক্ষয়ী রায়টে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া ভারতীয় মুসলমানদেরকে ভারতে ফেরৎ পাঠানো যাবে কি? (তখন ক্ষুদ্র পূর্ববঙ্গ হতে মূলত বর্ণ-হিন্দুদের দেশ ত্যাগের বিপরীতে, তিন দিকে ঘেরা পূর্বভারতীয় ১০/১২টি রাজ্য হতে দলে দলে ঢুকে পড়েছে অন্তত ১০ গুন নির্যাতিত মুসলমান, যা দেশটির অধিক ঘনবসতির অন্যতম মূল কারণ!)
• এছাড়া শতেক বছর পূর্বে মগ-দস্যুদের তাড়া খেয়ে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঠাঁই নেয়া বিপুল সংখ্যক আরাকানী মুসলমানদেরকে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব হবে কি?
• কোনো অস্বাভাবিকতা বা বৈষম্য নিয়েই কোথাও কোনো টু-শব্দটি নেই! অথচ দুই/তিন শত বছর ধরে বাস করা রোহিঙ্গাদের গ্রাসের মাত্র ১৪/১৫ হাজার বর্গমাইল আরাকান ভুমি কেঁড়ে নিতে এত নষ্টামি?
• চারিদিক হতে তাড়া করা মুসলিম দিয়ে দেশ ভরে, প্রজনন ক্ষমতা নিয়ে তামাশা সত্যি দুঃখজনক! যেখানে সারা দেশ ঘুরে এক, দুই বা তিন এর অধিক সন্তানযুক্ত পরিবার আর চোখেই পড়ে না!
• বিশ্ব কি আজ সত্যি সত্যি দানবদের কবলে?

নইলে সবল মোড়লদের ঘষাঘষির বলি শুধুই নিরীহরা (রোহিঙ্গা, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, আফ্রিকা … …) কেন? শক্তিমত্তা ও ঐশ্বর্যের আতিশয্যে যারা বিশ্বে আধমরা আর উদ্বাস্তু সৃষ্টির খেলায় মেতে আছেন, তারা কি ‘দানব’ নয়?
কক্সবাজারের সকল ভুক্তভোগীসহ দেশটির আম জনতা এমনতর হাজারো প্রশ্ন আর কান্না ঠেকিয়ে গুমরে মরছে, অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না! আমরা কি ভুলে গেছি, ‘৭১ এর দুঃসময়ে ভারত মাতা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং বিশ্বব্যাপী দৌড়ে, অখ্যাত ও আক্রান্ত এক বাংলাদেশকে কত দ্রুত সকলের নজরে আনতে পেরেছিলেন?
মহান ইন্দিরা গান্ধীর মত সারা বিশ্ব না হোক, ১৭ কোটি জনসমৃদ্ধ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষ হতে মাত্র তিনটি পরাশক্তি বন্ধু(?) রাষ্ট্রকে লজ্জাজনক মানবিক বিপর্যয়ের এক আজগুবি বিষয় বুঝানো সম্ভব হচ্ছে না! এও কি ভাবা যায়?

ড. ইউনুস, স্যার ফজলে হোসেন আবেদ, ব্যা. রফিকুল হক, ড. রেহমান সোবহান, ড. সিরাজুল ইসলামসহ শত শত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীবৃন্দের পক্ষ হতে এই ‘মহা ঘিঞ্জি’র সতের কোটি হতভাগার জন্য কি কিছুই করার নেই? ন্যাক্কার জনক এক গজবে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ সমর্থন/মৌনতা অবলম্বনকারী বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বরাবরে, ‘আমরা বিপদগ্রস্থ’ আহ্বানটি ‘বিনয় ও বুদ্ধিদীপ্ত’ উপস্থাপনে, তাঁদের দিবা-নিদ্রা ভাঙ্গানোর প্রচেষ্টা কি খুবই দুরূহ কোনো কাজ?
বিশ্বাস ঐ তিন রাষ্ট্রসহ অন্যান্য বরেণ্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ফেরাউন, হিটলার বা নমরূদ প্রকৃতির না হলে, তাঁরা নিশ্চয়ই মানবিক বিপর্যয়ের এ নিকৃষ্ট বিষয়টি যথাযথ উপস্থাপনে লজ্জিত হবেন!

এটা অনস্বীকার্য যে, আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহকে ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতি এমনিতেই দুর্বল করে রেখেছে! যে কারণে, প্রায় সকল শাসক বৃন্দকেই অন্ত-বহিঃস্থ নানাবিধ চাপের বিষয়ে সর্বদা সজাগ থাকতে হয়! মিয়ানমারের একগুঁয়েমির বিপরীতে চলমান রাষ্ট্রিয় কার্যক্রমের অবস্থা কম-বেশী সকলেরই জানা! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতোমধ্যে ‘কিছুটা হলেও আশা জাগানিয়া’ চীন সফর সেরে এসেছেন।
আমজনতা জানেনা বাংলাদেশের সুস্পষ্ট ও জোড়ালো অবস্থানের বিপরীতে বর্বর মিয়ানমার, কোন যুক্তি বলে বিশ্বকে বশে রেখেছে? যেহেতু আমাদেরকে সভ্য ও ভদ্র থাকতেই হবে! সুতরাং আগ্রাসীর সাথে দুর্ব্যবহারতো নয়ই, ‘শান্তি’ ভিন্ন অন্যথা মানা! তাই বলে নিষ্ঠুরতার অকারণ বলি হয়ে উহ্ আহ্টুকুও না করলে, এত বড় মানবিক বিপর্যয় সাধারণ বিশ্ববাসীর নজরে আসবে কিভাবে? আমরা কি চিৎকার করাটাও ভুলে গেছি?
মানবে সয়লাব যে দেশ থেকে শুধু কাজ করে বাঁচার আশায়, সুপথে-বেপথে প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষ প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে পাড়ি জমানোর লাইনে কিউ দিয়ে আছে! যার পরিণতিতে সাগরে ডুবে অথবা বন-জঙ্গলে আটকা পড়ে শত শত মৃত্যু জনিত মর্মান্তিক খবর সমুহে, বাংলাদেশের নাম থাকছে সবার উপরে! অস্বাভাবিক জন-চাপে যেখানে এমনিতেই বড় ধরণের ‘বিপর্যয়’ ঘটে যেতে পারে! সেইরকম একটি মানবে জর্জরিত দেশে তিন পরাশক্তি কথিত বন্ধু রাষ্ট্রের নিস্পৃহতায় আরো মানুষ ঢুকিয়ে দেশটির সবকিছু একেবারে তছনছ করে ফেলা! এ কোন সভ্য দুনিয়া?

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের একাংশ

একটু ইচ্ছে’তেই যেখানে শান্তি হাতের মুঠোয়! সেখানে বিশ্ব মোড়লদের অহেতুক আগুন নিয়ে খেলা সত্যি দুঃখজনক!
সমাধানের ব্যাখ্যায়, প্রযুক্তির একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাতে চাই,
• মাত্র ১৫ লক্ষ হতদরিদ্র ও মূর্খ রোহিঙ্গা অর্থনীতি বনাম মিয়ানমার ও তিন পরাশক্তিসহ অন্যান্যদের সম্মিলিত অর্থনীতির দ্বন্দ্ব কোনো বিচারেই ‘যুক্তিযুক্ত’ নয়! এটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক ‘লজ্জা’র বিষয়!
• ভীত সন্ত্রস্ত একদল বিড়ালের গ্রাস নিয়ে বাঘ-সিংহ-হায়েনা’দের একাট্টা হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা, যেখানে প্রাণীকুলেই বেমানান! সেই চটুল-কর্ম মানব সমাজে ঠাই পেতে পারে না! বিশ্ব কি আজ সত্যি মুরুব্বিহীন?
• সর্বহারা রোহিঙ্গা! যাদের ভিটে-মাটি সমান করে দখলদারদের শ্রাদ্ধ-মন্ডপ প্রায় সম্পন্ন! ওদেরকে এখনো কারো ভু-রাজনৈতিক শত্রু ভাববার কোনো যুক্তিই আর অবশিষ্ট নেই!
• এখন সহজেই, বৃন্তচ্যুত ঐসব বাস্তুহারাদেরকে জাতি সংঘের মধ্যস্থতায় ‘নাগরিকত্ব’ ও ‘দ্বিগুণ ভুমি বরাদ্ধ’ জাতীয় শান্তনার বাণী শুনিয়ে, লক্ষাধিক বর্গমাইল বার্মিজ বিরান ভুমির নিয়ন্ত্রনযোগ্য কোনো অঞ্চলে নিয়ে, ইউএন শান্তিরক্ষীর নজরদারীতে, রাষ্ট্রীয় কৃষি ও শিল্প উন্নয়নে লাগিয়ে দেয়া যেতে পারে! এতে দখলদারদের ‘নির্লজ্জ স্বার্থ’ আর মানবতাবাদীদের ‘মূখ রক্ষা’র ষোল-কলা যুগপৎ পূর্ণ হয়ে যেত!
• মুসলমান হওয়াটাই যদি রোঙ্গিাদের অপরাধ হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে আসন্ন কিয়ামত ভিন্ন সমাধান দেখি না! নয়তো কেবল রোহিঙ্গা কেন, প্রস্তাবিত ‘ভুমি-ব্যবস্থাপনা’য় বিরান ভুমিবহুল বর্তমান দুনিয়ার ৪/৫ কোটি যুদ্ধ-উদ্বাস্তু আর অভিশপ্ত বাংলার ৪/৫ কোটি উদ্বৃত্ত মানব মিলিয়ে মাত্র ৮/১০ কোটি হতভাগার জীবিকা সংস্থানের মাধ্যমে, ‘ঠান্ডা-লড়াই’ নামক বিশ্ব-আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বন্ধের প্রথম ধাপটিও অতিক্রম কত সহজ!

রোহিঙ্গা ছাড়াও, মূলত মানব আধিক্যের কারণেই একের পর এক অদ্ভুত অদ্ভুত সব ইস্যুর (ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ডেঙ্গু, চামড়া, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যাসিনো, … !) আবির্ভাবে এমনিতেই যেখানে দিশাহারা অবস্থা! ন্যুনতম ঠাঁই বিহীন সেই অভাগা দেশটির দিকেই আঙ্গুল উঁচিয়ে প্রতিবেশী পরাশক্তির ক্ষমতাসীন নেতা যখন ৪০ লক্ষ অসমীয়কে টেনে হুঙ্কার ছাড়েন, তখন কেমন লাগে? বিশ্বে কি মানবতার ছিটে-ফোটাও অবশিষ্ট নেই?
বিনা কারণে চারিদিক থেকে চেপে ধরা এই মহা ক্রান্তি লগ্নে, দেশপ্রেমিক সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও প্রবাসী মিলে, শুধুই ‘ন্যায্যতা’র দাবীতে সকলের আরেকবার ‘গর্জ্জে উঠা’ আর কতদুরে?

প্রকৌ.এস এম আলী আকবর (তিতাস গ্যাস টি এন্ড ডি কোং এর অবসররত ডিজিএম)
ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments