বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম গত ২০ বছরে অনেক কষ্ট করে আজ এই পর্যন্ত এসেছে। আমাদের ক্রিকেট টিম অনেক সময়ে মাঠে নামে ‘জেতার জন্য না’, ‘না হারার জন্য’। আমাদের ক্রিকেট ডিফেন্সিভ, এটাকিং না। আমাদের তামিম বা জোর করে মুশফিক ছাড়া ঊঠায়ে মারার মতো ক্রিকেটার খুব কম বা নাই বললেই চলে। এই ধরনের ‘হিসেবী মাথা গরম’ করা হিটার বাংলাদেশ ক্রিকেট তৈরি করে কিনা জানি না। আমরা আবার স্পিন পিচে খেলতে পছন্দ করি, কারন ট্রেডিশনালী বাংলাদেশের মাঠগুলা আদ্রতার জন্য তুলনামুলক ভাবে নরম হয়, আমাদের ক্রিকেটাররাও সারাদেশে এভাবেই বেড়ে উঠে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা বা পাকিস্তানের মাটির কারনে পিচ বাউন্সি হয়, তাদের ক্রিকেটাররাও সেই উম্মাদনা নিয়ে মাঠে আসে। আমাদের এই জাতের হিটার তৈরি করতে তৃনমূল পর্যায় থেকে প্ল্যান্ লাগবে বা মাঝে মাঝে পাঠ পর্যায় থেকে প্রতিভার ঝলকে কাউকে কাউকে নিয়ে আসতে হবে।
হিটার না থাকার কারনটা আমাদের ‘জিনগত’। আমরা খেলায় না জিততে পারলেও হারাটা ঠেকাতে চাই। এটাই আমাদের ক্রিকেট বোর্ড আর খেলোয়াড়দের ইগো আর ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে বেঁচে থাকার মূলসূত্র। তারা মচকাতে রাজি আছে ভাঙতে না। আমরা স্পিন পিচ তৈরী করে আমাদের ব্যাটিং-এর দূর্বলতা ঢেকে বোলিংএ বেশী ভরসা খুঁজে পাই। এতে হয়ত হোম গ্রাউন্ডে আমাদের বেশ জয় আসে, কিন্তু সর্বশ্বান্ত হয়ে পড়ি। তাতে কি? ঐ যে, মচকালেও ভেঙ্গেতো যাই নি, দেশের মাটিতে আমরা অন্তত টাইগার! ভারতও এক সময় দেশের মাটিতেই জিততো, এই স্পিন নির্ভর পিচ তৈরি করে। অনেক সমালোচনা আর দেশ জুড়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বহু সাধনার পর আজ তারা সত্যিকার সফল, এমনকি প্রতিবছর একঝাক তারুন্য নির্ভর আইপিএল-এর মতো টুর্নামেন্টও করতে পারে। ফুটবলেও তারা ইদানিং বেশ এগিয়ে গেছে।
অন্যদিকে, ক্রিকেটীয় ইনিংস যদি একটু লম্বা হয়, যেখানে উঠিয়ে মারার দরকারটা তুলনামূলক কম, যেমন একদিনের ক্রিকেট, সেখানে আমরা আরেকটু ভালো খেলি, টেস্ট হলে আরো ভালো খেলি। এর উল্টো দিকে আবার আফগানিস্তান বা পাকিস্তান কিন্তু লম্বা ইনিংসে তাদের দূর্বলতা দেখাচ্ছে, রেংকিংএও ওরা নীচে, ঐ এক কারন, টি২০এর উঠিয়ে মারাটা খেলে একদিনের বা টেস্ট ক্রিকেটে সমান ফল পাওয়া যায় না।
আমরা টি২০ ম্যাচে বিশ্ব রেংকিংএ অনেক নিচে, কারন আমরা এই উঠিয়ে মারাটা জানি না, আর এটি না জানলে টি২০ ম্যাচ জেতাটা আমাদের জন্য সহজ হবে না। আমাদের ভালো ব্যাটসম্যান আছে, কিন্তু টি২০এর মেজাজে এই নির্দিস্ট মানের ব্যাটসম্যান নেই। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তান বা স্কটল্যান্ড এই উঠিয়ে মারাটা জেনে গেছে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে একজন পুর্নাংগ পেসার পেতে ভারতকে কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, একজন কপিল দেবের পরও বহুদিন গিয়েছে ভারতের বিশ্বমানের পেসার পেতে, একজন জয়সুরিয়া বা কালুভিতারানা পেতে শ্রীলংকাকে কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রায় দেশের টি২০ দল, একদিন ও টেস্ট দলের টিম আলাদা আলাদা, শুধু আমাদের, পাকিস্তানের, স্কটল্যান্ডের, আফগানিস্তানের টিম এক থাকে, কারন অপশন কম।
আমাদের দল টি২০-তে শুধু হোম গ্রাউন্ডে কিছুটা ভালো করবে, অন্যদেশে চ্যালেঞ্জিং পিচে আমাদের দল থেকে কিছু আশা করাটা দেশপ্রেম আর দলটাকে পাগলের মতো ভালোবাসার বহি:প্রকাশ হতে পারে, দলের সক্ষমতার প্রকৃত বিচার না।
আর একটা কথা, দলে মাশরাফীর মতো ক্যাপ্টেন বা নেতা এখন আর নেই, সে ছিলো লিডার, সবাই তার হাত ধরে বিশ্ব দেখেছে, মেনেছে। মাশরাফী অনেক ম্যাচে নিজে ভালো না খেললেও সবার মধ্য থেকে ভালোটা বের করে আনতো, ঐ যে, তার লিডারশীপে দলের সদস্যদের মধ্যে একধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলো, সে সিনিয়রও ছিলো, আর মাশরাফীকে যে বিশ্বাসটা সারা দেশও করেছে, সেই কারনে ক্রিকেট বোর্ডও মাশরাফীকে বেশী ঘাটাতো না, সমীহ করতো, যেমন সমীহ স্টিভ ওয়াহ, কপিল দেব, ইমরান খান, জয়সুরিয়ারা আদায় করে নিয়েছিলেন। এখন পরিবেশ ভিন্ন, দলে ৪-৫ জন সমান বয়সের সিনিয়র, ইগো সমস্যা আর অনেকটা সমকেন্দ্রীক সমতায় একজন আরেকজনকে ডোমিনেট করার অক্ষমতার ভীড়ে জুনিয়রাও কিছুটা ছন্নছাড়া। দলে এখন লিডারশীপ দরকার ভীষনভাবে, এটি দ্রুত না আসলে বাংলাদেশ আগামীতেও ভালো দল নিয়ে অনেক ম্যাচ হারবে, টুর্নামেন্ট হারবে। ক্যাপ্টেন শক্তিশালী না হওয়াতে বোর্ডও এখন দলের উপরে অনেক প্রভাব খাটাবে, খেলোয়াররা আত্মবিশ্বাসের সাথে বোর্ডকে ডোমিনেট করতে পারছে না, মাঠেও এর প্রতিফলন ঘটবে।

দিন শেষে যাই হোক, এই দলটাই আমাদের লড়তে শিখিয়েছে, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। খেলোয়ারদের দোষ না দিয়ে টিমে দ্রুত দরকারী খেলোয়ারদের জোগান দিতে হবে। সারা দেশে খেলোয়াড় খোঁজা আর এই টিমে দিয়েই সব সমাধান খোঁজা, দুটাই বাদ দিয়ে ভালো পেসার আর ব্যাটসম্যান বের করা ও জোগাড় দেয়াই বোর্ডের এখন দ্বায়িত্ব, এই দ্বায়িত্বে গাফলতির পরিনতিতে টিমকে দোষ দিয়ে বোর্ডের অফিসিয়ালদের কোটি কোটি টাকা কামানোর সহজ জীবন বাদ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই টিমের কারনেই বোর্ডের এই জৌলুস, আজ এই পরিচিতি।
বাংলাদেশের এই দলটাকেই ভালোবাসি, হারুক জিতুক, এটাই আমার দল, এই দলটাই আমার আর আমাদের ভালোবাসা।
আল নোমান শামীম
সম্পাদক, মুক্তমঞ্চ
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।