বাংলাদেশের সাহিত্য অবশ্যই বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয় -সেলিনা হোসেন

  
    
সাক্ষাৎকার গ্রহণে নাঈম আব্দুল্লাহ

বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালে রাজশাহী শহরে। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর পরিচালক হন, মহিলা হিসেবে বাংলা একাডেমীর তিনিই ছিলেন প্রথম পরিচালক। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরী থেকে অবসর নেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ “উৎস থেকে নিরন্তর” প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ভ্রমণ তাঁর নেশা। তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় ৪০টি, গল্প গ্রন্থ ১১টি এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৯টি। এছাড়াও তার ৩০টি শিশুতোষ গ্রন্থ আছে।কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য সেলিনা হোসেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক (১৯৬৯), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদকসহ (২০০৯) বহু পুরস্কার পেয়েছেন।

আসছে ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় একুশে একাডেমী অস্ট্রেলিয়ার আমন্ত্রণে তিনি মিলিত হবেন ‘গায়ত্রী সন্ধ্যায় যাপিত জীবনের গল্প’ শীর্ষক সাহিত্য আড্ডায়। এর আগেও তিনি সিডনি এসেছেন। সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক ও সিডনি প্রতিদিন সম্পাদক নাঈম আব্দুল্লাহ সেলিনা হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। প্রশান্তিকার পাঠকদের জন্য সেটা তুলে ধরা হলো।

নাঈম আব্দুল্লাহ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে আপনার লেখায় তার কেমন প্রতিফলন ঘটে?
সেলিনা হোসেন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। তখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম রাজনীতি মানুষকে ভাত, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা দেবে। মানুষের জীবন হবে স্বস্তি ও শান্তির। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষের পরেই রাজনীতির পাঠ শেষ করে দেই, লেখালেখির জগত ধরে রাখব বলে। রাজনীতির যে আদর্শগত দিক শিক্ষাজীবনে গ্রহণ করেছিলাম তার প্রয়োগ ঘটিয়েছি লেখায়। তবে সরাসরি নয়। সৃষ্টি কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে, মানবিক মূল্যবোধের জায়গা সমুন্নত রেখে এবং বেঁচে থাকার মাত্রার সমতার বিন্যাস ঘটিয়ে। মানুষের ভালোমন্দের বোধকে রাষ্ট্র সম্পর্কের জায়গায় রেখে আমি রাজনীতির নানাদিকের প্রতিফলন ঘটাতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের জীবন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে মানুষ – এটাই আমার গভীর বিশ্বাস। যখন এর ব্যত্যয় ঘটে তাও তুলে ধরি লেখায়। বিশেষ করে সামরিক শাসন এসেছে আমার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে।

নাঈম: আপনার “ভূমি ও কুসুম” উপন্যাসে ছিটমহল ও দহ-গ্রাম এলাকার গণ মানুষের জীবনের তৎকালীন চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানে মানুষের জীবন কিভাবে রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তা আপনার লেখায় বিশদভাবে উঠে এসেছে। কিভাবে আপনি লেখনীর তুলিতে এত নিপুণভাবে তার ছবি আঁকলেন?
সেলিনা: ছিটমহল দহগ্রাম আঙ্গরপোতা এবং পঞ্চগড় এলাকার অনেকগুলো ছিটমহল আমি দেখেছিলাম আমার ভ্রমণের নেশা থেকে। পরে ছিটমহলবাসীর জীবন নিয়ে উপন্যাস লেখার চিন্তা করি। ওরা এক ধরনের বন্দী জীবন কাটায়। ছোট্ট ভূখণ্ডটি অন্য একটি দেশের সীমান্ত রক্ষীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ঠিকমতো চিকিৎসা পর্যন্ত পায় না। উচ্চ শিক্ষাতো নয়ই। এমনকি ভোটাধিকারও থাকে না। ওদের সঙ্গে কথা বলে, ওখানে ঘুরে তারপর লিখতে বসেছি।

নাঈম: আপনার “হাঙর নদী গ্রেনেড” উপন্যাস চলচ্চিত্রে তুমুল দর্শক নন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে। আবার পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ওকটন কমিউনিটি কলেজে পাঠ্য হয়েছে। খ্যাতির তুঙ্গে এই উপন্যাস সম্পর্কে আমাদের পাঠকদের কিছু বলবেন?
সেলিনা: আপনাদেরকে দু’তিনটে স্মৃতির কথা বলি। প্রথমত উপন্যাসটি নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণে তিনি ভাবনাটি বাদ দেন। কারণ তার ইচ্ছে ছিল শুটিং হবে বাংলাদেশে। একটি মাত্র চরিত্র বাদে বাকী সব অভিনয় শিল্পী বাংলাদেশের হবে। কাজ করার সুবিধা ‘৭৫ সালের পরে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তাঁর সিকিউরিটির বিষয়টিও ছিল। সেজন্য তিনি আর চিন্তা করেননি।
আর একটি ঘটনার সামনা-সামনি হয়েছিলাম দিল্লিতে। সেখানে একটি সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সম্মেলনে চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছিলো। ৭-৮ জন চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী আমাকে এসে বললেন, আপনি যে প্রতিবন্ধী ছেলেটাকে দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তান সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাতে আপনি ছেলেটির হিউম্যান রাইটস লঙ্ঘন করেছেন। আমি ওদের কথায় চমকে উঠেছিলাম। আমিতো জানতাম সাহিত্য শিল্পবোধের ক্ষেত্র। ওরা শিল্পকে সোশ্যাল অ্যাকটিভিজমের জায়গায় নিয়ে গেছে। আমি তাৎক্ষনিকভাবে বলি, তোমাদের মনে রাখতে হবে যে, সময়টি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। যে মা ছেলেটিকে সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল। আর তিনি যদি এ কাজটি না করতেন তাহলে পাকিস্তানী সেনারা গ্রামটি জ্বালিয়ে দিতো, ধরো পাঁচশো লোককে মেরে ফেলত, কুড়িটি মেয়েকে বাঙ্কারে নিয়ে যেত – এই পরিস্থিতিতে কোনটি বড় কাজ ছিল? একটি জীবন নাকি একটি ম্যাসাকার? ওরা স্বীকার করে বলেছিল, ইয়েস ইউ আর রাইট।
তৃতীয় ঘটনাটি আবার অন্য রকম। প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক Pascal Zink নেট থেকে বইটি নামিয়েছিলেন। তিনি সাউথ এশিয়ান লিটারেচার পড়ান। তিনি উপন্যাসটি পড়ে পছন্দ করে আমাকে লিখলেন, ইংরেজি অনুবাদ ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। আপনি অনুমতি দিলে আমি ব্রাশ আপ করে উপন্যাসটি ইন্ডিয়া থেকে ছাপার ব্যবস্থা করে দেখতে পারি। আমি তাকে অনুমতি দেই। বইটি বর্তমানে ইন্ডিয়ার রূপা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ছাপার কাজ চলছে। শিকাগোর ওকটন কমিউনিটি কলেজে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ একটি সেমিস্টারে পড়ানোর অনুমতি চেয়েছিলেন প্রফেসর Emily Bloch. তিনি পরে চারটি সেমিস্টারে পড়ান। এভাবে এ উপন্যাসটির নানা স্মৃতি আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে বড় সঞ্চয়।

নাঈম: প্রথম উপন্যাস “ জলোচ্ছ্বাস”এ প্রকৃতির অতি নিখুঁত বর্ণনা ও প্রেক্ষাপট স্থান পেয়েছে। আপনি প্রকৃতিকে এত কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ পেলেন কিভাবে?
সেলিনা: শৈশবে প্রকৃতি দেখার অবাধ সুযোগ হয়েছিলো আমার। বাবার চাকুরী সূত্রে আমারা থাকতাম বগুড়ার করতোয়া নদীর ধারের গ্রামে। পঞ্চাশের দশকের কথা। মাঠ-ঘাট-প্রান্তর-নদী-বিল-বন-ঝোপঝাপ ইত্যাদি ঘোরার অবাধ সুযোগ ছিল। শৈশবে-কৈশোরের দেখা প্রকৃতি আমার স্মৃতির সঞ্চয়। তাই আমার লেখার একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রকৃতিকে কাছে পাওয়ার নানামাত্রার অভিজ্ঞতার কারণে আমার লেখায় প্রকৃতি এমন আপন হয়ে যায়। ভ্রমণ আমার নেশা। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত অনেক ছোট ছোট জায়গাও দেখার সুযোগ হয়েছে। বঙ্গোপসাগর এবং অসংখ্য নদী-নালা দেখে চিত্রকল্প খুঁজে পেতে শিখেছি। এভাবেই প্রকৃতি অনবরত আপন হয়ে উঠেছে।

নাঈম: “লারা” উপন্যাসে আপনার প্রাণপ্রিয় মেয়ে প্রয়াত বৈমানিক ফারিহা লারার স্মৃতিকে ঘিরে রচিত হয়েছে। এই ধরনের উপন্যাস লেখা কতটা কঠিন বলে আপনার মনে হয়েছে?
সেলিনা: লারা উপন্যাসটি লিখতে খুব কষ্ট হয়েছে এটা ঠিক। কতটা কষ্টের তার পরিমাপ করা যাবে না। একটি উপন্যাস তখনই ভিন্ন মনে হয় যেটি ব্যক্তির নিজস্ব ঘটনার বাইরে উঠতে পারে। যে পাঠক লারা এবং আমার সম্পর্কের কথা জানবে না, তারা উপন্যাসটি মা-মেয়ের সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখতে পারবে। আমি ‘লারা’ উপন্যাসে এই ভিন্নতা প্রত্যাশা করি।

নাঈম: বাংলা একাডেমীতে ৩৪ বছর গবেষণা মূলক কাজের অভিজ্ঞতা কিভাবে আপনার সাহিত্য চর্চাকে প্রভাবিত করেছে?
সেলিনা: বাংলা একাডেমীকে আমি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখেছি। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক বিষয়ের সমকালীন প্যারালালধর্মী উপন্যাস লিখেছি। যেটাকে আমি ঐতিহ্যের নবায়ন বলি। এসব উপন্যাস লিখতে গবেষণা করতে হয়েছে। গবেষণা করার কাজটি আমি বাংলা একাডেমীতে কাজ করার সুবাদে শিখেছি। তাছাড়া বাংলা একাডেমী আমার কাছে মর্যাদার কর্মস্থল ছিল।

নাঈম: নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? আপনার লেখায় নারী চরিত্রগুলি কি আপনারই প্রতিনিধিত্ব করে?
সেলিনা: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে আমি নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ বলে মনে করি। নারী পরিবারসহ যেখানেই কাজ করুন না কেন তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন এটি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার লেখায় নারী চরিত্র অবশ্যই আমার প্রতিনিধিত্ব করে না। তাহলে তো সবাই একরকম হয়ে যাবে। প্রত্যেকেরই আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে বলে আমি মনে করি।

নাঈম: নুতন প্রজন্মের লেখা পড়ে আপনার কি মনে হয়? সাহিত্যের মূলধারায় তাদের অবস্থান কোথায়?
সেলিনা: নুতন প্রজন্ম আমাদের সাহিত্যের যোগ্য উত্তরাধিকার। তারা সাহিত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছে শুধু তাই নয় আমাদের নূতন প্রজন্ম ইংরেজিতে লিখে আন্তর্জাতিক জগতে বাংলা সাহিত্যের ঠাঁই করেছে। এটিও প্রশংসনীয়। অনলাইনে সাহিত্যের ধারাটি তারাই রক্ষা করেছে।

নাঈম: কাদের লেখা আপনার লেখনীকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে? আপনার প্রিয় লেখক কারা?
সেলিনা: দেশি- বিদেশি মিলিয়ে অনেক লেখকই আছেন। কারও কোন বই ভালো লাগে। অন্যটা নয়। সেজন্য একজন-দুজন খুবই প্রিয় নন, শুধু রবীন্দ্রনাথ ছাড়া।

নাঈম: বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চার বর্তমান মূল্যায়ন কিভাবে করবেন?
সেলিনা: প্রবীণ-নবীন সাহিত্যিকরা বাংলাদেশের সাহিত্য নিজ নিজ সাধ্যের মধ্যে পরিচর্যা করছেন। এখানে কোন ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি না। তবে মানসম্মত রচনার মূল্যায়ন করবেন সমালোচক। সবার উপরে বড় সমালোচক সময়। কালের বিচার বড় নির্মম। এটি কাউকে ক্ষমা করে না। যা বাতিল হওয়ার যোগ্য তা স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হবে।বাংলাদেশের সাহিত্য মানের দিক থেকে অবশ্যই বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়।

নাঈম: অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
সেলিনা: অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত নতুন প্রজন্মের কাছে আবেদন, নিজের মাতৃভাষা শিখবে। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করবে না। এটা তোমার শেঁকড়ের সন্ধান। ইংরেজি ভাষা শিখবে জ্ঞান লাভের জন্য। জীবিকা অর্জনের জন্য। যারা পারবে তারা ইংরেজি ভাষায় নিজ দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরবে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটকে।

নাঈম: অনেক ব্যস্ততার মধ্যে এতক্ষণ সময় দেবার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সেলিনা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments