
জলোচ্ছ্বাসের সময়ও আকাশে জ্যোৎস্না থাকে। কিন্তু সেই জ্যোৎস্না দেখার আগ্রহ, সময় কিংবা উপায় সকলের থাকে না। তবে কারও কারও থাকে। যেমনটি ছিল রোমান সম্রাট নিরোর। রোম নগরী যখন ধ্বংস হচ্ছিল তখন তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যের রাজকন্যা সেলিনা হোসেন জলোচ্ছ্বাসের সময় জ্যোৎস্না দেখেছিলেন কিনা, জানি না। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসের পরে জ্যোৎস্নায় সূর্য জ্বালা অনুভব করেছেন ঠিকই।
হাঙর নদী গ্রেনেডের মুক্তির উপাখ্যানে মগ্ন চৈতন্যে শিস বাজিয়েছেন নিজেই তাঁর যাপিত জীবনে। নীল ময়ূরের যৌবনের পদশব্দ ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই চাঁদবেনে কিংবা পোকা মাকড়ের ঘরবসতিতে ক্ষরণ দেখেছেন। তাই বাজিয়ে চলেছেন নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি। কাঁটাতারে প্রজাপতি কিংবা খুন ও ভালোবাসার টানাপোড়েনের মধ্যেও তিনি কালকেতু ও ফুল্লরাদের ভুলে যাননি। যেমনটি ভুলে যাননি প্রীতিলতাকেও ভালোবাসতে কোনো এক গায়ত্রী সন্ধ্যায়। একদিকে যেমন কবি মির্জা গালিবের প্রতি মুগ্ধতার হরফে লিখেছেন যমুনা নদীর মুশায়রা, অন্যদিকে মাটি ও শস্যের বুনুন কিংবা ভূমি ও কুসুমে তিনি খুঁজে পেয়েছেন পূর্ণ ছবির মগ্নতা।
জলবতী মেঘের বাতাস কি একালের পান্তাবুড়ি; নারীর রূপকথা কিংবা অনুঢ়া পূর্ণিমায় সখিনাদের চন্দ্রকলার কথা জানে? মতিজানের মেয়েদের নুন পান্তায় গড়াগড়ির অবেলার দিনক্ষণ? মৃত্যুর নীলপদ্ম কি এই মানুষটির শুধুই পরজন্মের গল্প? দ্বীপান্বিতা, গেরিলা এবং বীরাঙ্গনাদের যুদ্ধ যেমন কখনো শেষ হয় না, তেমনি লারাদের কখনো মৃত্যু নেই। বিহঙ্গরা কখনো মরে না। তারা উড়তে থাকে; উড়তেই থাকে হৃদনীলিমায়। মোহিনীদের বিয়ের ছবি তিনি কাঠ-কয়লায় এঁকেছেন জীবনের ক্যানভাসে। কারণ আগস্টের এক রাত থেকে ঘুম ক্লান্ত ঈশ্বর পড়ে আছেন কোনো এক আণবিক আঁধারে; যদি কোনো দিন ঈশ্বরের ঘুম ভাঙে তাহলে অবশ্যই দেখতে পাবেন, এক আলোর দুহিতা দিনের রশিতে গিট্টু দিয়ে অপেক্ষা করছেন মর্গের সেই নীল পাখিটির জন্য।

প্রিয় পাঠক, ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহীতে বাংলা কথাসাহিত্যের রাজকন্যা সেলিনা হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে তাঁর রচিত বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রচিত উপন্যাস পড়ানো হয়। এ বছর তিনি তেয়াত্তর বছরে পা দিয়েছেন। আমরা এই আলোর দুহিতার দীর্ঘায়ু প্রত্যাশা করছি।
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক