রীমা আড্ডার মাঝখান থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। শাহেদ রীমার এই অদ্ভুত স্বভাবের কথা জানে। ও বিরক্ত হলে সেখান থেকে উঠে যায়। রীমা যে বিরক্ত হয়েছে তা বুঝতে দ্যায়নি। এমনিতেও শাহেদের বন্ধু মহলে ওর শীতল স্বভাবের জন্য ওর নাম “আইস কুইন”।
অবশ্য যথেষ্ট বিরক্ত হবার কারন ঘটেছে। কথা প্রসঙ্গে একজন রীমাকে জিজ্ঞেস করেছে ওদের বাচ্চা হচ্ছে না কেন? লোকে কি অবলীলায় অন্যের শোবার ঘরের খবর জানতে চায়।
গায়ে দেবার একটা পাতলা শাল থাকলে ভালো হতো। শীতকাল এবার লুকোচুরি খেলছে। বিরক্তিকর কথা মাথা থেকে সরাতে রীমা বারান্দার খুঁটিনাটি মন দিয়ে দেখছে। এই বাড়ীর সামনে বড়সড় একটা বাগান বিলাস গাছ।
ওর বাগান বিলাস গাছের প্রতি দুর্বলতা আছে। ওদের মন্ট্রিয়ালের ছোট এপার্টমেন্টের বসার ঘরে একটা বাগান বিলাস ছিল। সময়ের সাথে সাথে সেটা ছাদ ছুঁয়েছিল। ঢাকায় যখন একেবারে চলে এলো তখন একটা গ্রিন হাউজ নার্সারিতে দিয়ে এসেছিল।
একটা গলা খাকারির আওয়াজ ভেসে এলো। রীমা বামপাশে তাকিয়ে দেখল শ্বেতাঙ্গ পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। নামটা মনে পড়ছে না । ও জোর করে নাম মনে করার চেষ্টা করছে। কোভিড হবার পরে অনেক কিছুই ভুলে যায় ও।
নাম মনে পড়তে রীমা একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “ স্যরি আই ডিড নট সি ইউ।“
মাইক একটা হাসি দিয়ে পরিস্কার বাংলায় বলল, “ আসলে আমি তোমাকে চমকে দিতে চাইনি। তবে মনে হচ্ছে তোমার কম্পানির প্রয়োজন”।
রীমা এবার ওর দিকে ঘুরে তাকালো। সাদা পাঞ্জাবি আর শালে যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথের মত চেহারা মাইকের। শুধু চশমাটা সব গোলমাল করে দিচ্ছে। ওর স্পষ্ট বাঙলা উচ্চারনে রীমা বেশ চমকে গেছে। শাহেদের সূত্রে পরিচিত বেশির ভাগ মানুষ একটু ট্যাশ গরু প্রজাতির। একটু নাকি স্বরে, একটু ইংরেজি মিশিয়ে এরা বাঙলা বলে।
“ কেন মনে হলো এমন? এমনি বুঝি কেউ বারান্দায় আসে না?”
“ তা আসে। বাড়ির সামনে বাগান বিলাস গাছটা দেখেছ?”
“ হু দেখেছি। আমার বাগান বিলাস খুব পছন্দ। বাগান বিলাস অবশ্য বিদেশ থেকে এসেছে”।
“ আমি জানি। বগেনভেলিয়া থেকে বাগান বিলাস নাম রেখেছিলেন কবিগুরু। আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ বাগান বিলাস খুব পছন্দ করত” ।
রীমার মনে হল মাইক নিজেই কথা বলার লোক খুঁজছে। ওর কৌতূহল হচ্ছে কী করে এত স্পষ্ট বাঙলা বলে ! নেহাত আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলে অভদ্রতা হয় তাই রীমা জিজ্ঞেস করছে না।
“ রীমা তোমার কৌতূহল হচ্ছে না আমি কি করে এত ভালো বাঙলা বলতে পারি”।
“ মনে হচ্ছে আপনি আমাকে গল্পটা বলবেন”।
“ আমাকে যে বাঙলা শিখিয়েছিল তার গল্প বলি। আর এই গল্পে বাগান বিলাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অবশ্য তুমি যদি শুনতে চাও।
রীমা ঘাড় হেলিয়ে হেসে সম্মতি দিলো।
মাইক বলে চলেছে, “ আমি তখন ইউনিভার্সিটি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ছুটির দিনে আমি একটা ফার্মারস মার্কেটে চাকরি করতাম। দোকানের নাম সিল্ক প্ল্যান্ট ওয়ারহাউজ। সেখানে নানারকম ট্রপিক্যাল গাছ বিক্রি হতো। নবনীর সঙ্গে আমার পরিচয় সেখানেই। ওর সঙ্গে দেখা হবার প্রতিটা খুটিনাটি ব্যপার আমার মনে আছে। ওর পরনে ছিল লাল একটা ম্যাক্সি ড্রেস।
ও এসে একটা বাগান বিলাস কিনলো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ও এই গাছ কোথায় দেখেছে। সেভাবেই আলাপ জমিয়েছিলাম। ও হেসে বলেছিল বে অফ বেঙ্গলের পাড়ের ছোট একটা দেশের কথা। সেই দেশের সঙ্গে আমি এভাবে জড়িয়ে যাব সেদিন কল্পনা ও করিনি।
আমি ভুমধ্যসাগরের পাড়ের লোক। আমার জন্ম দক্ষিণ ফ্রান্সের একটা শহরে যার নাম নীস। আমি ছোট বেলায় রাস্তা ঘাটে এই গাছ দেখেছি। কেউ আগ্রহ নিয়ে খুঁজছে এই ব্যাপারটা দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। নবনী খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে বলল ওর ঢাকার বাড়িতে এই গাছ আছে। নামকরনের ইতিহাস ও বলল।
নবনী আর আমি একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। ওকে খুঁজে পেতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। যতবার দেখা হয়েছে মিষ্টি করে হেসেছে।
তোমাদের দেশের মেয়েদের মন পেতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয় জানো? আমি প্রথমে ওর বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করলাম। বেশির ভাগ বাঙালি। আমার সঙ্গে আড্ডা দিলেও বেশ সমস্যা হতো জানো? ওরা প্রতি শনিবারে একসাথে বসে বাঙলা সিনেমা দেখত। আমি সেখানে বোবার মতন বসে থাকতাম। সাব টাইটেল দেখে গল্প বোঝার চেষ্টা করতাম।
একটা মজার কথা জানো?
রীমা জিজ্ঞেস করল,” কী?”
“ তোমাদের বাঙলা ভাষীদের ইংরেজি উচ্চারনে কোথাও একটা ফরাসি টান আছে”।
“ যত না মিল আছে তার চেয়ে আপনি বেশি ভেবেছেন। এক বিখ্যাত লেখক বলেছেন প্রেমে পরলে প্রেমিকার বাড়ির বেড়ালও ভালো লাগে”, বলে ফিক করে হেসে ফেলল রীমা।
“ সেটা আর বলতে। তবে এ কথা সত্যি কারো মন পেতে হলে তার ভাষায় কথা বলতে জানা প্রয়োজন। নয়ত হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছুনো যায় না”।
“ আপনি আসলেও খুব সুন্দর বাঙলা বলেন, বলে হাসল রীমা। ওর গল্পের বাকি অংশ শুনতে ইচ্ছে করছে।
“ বাঙালিদের সঙ্গে ফরাসিদের আরেকটা ব্যপারে মিল আছে। তোমরা খুব আর্টিস্টিক। কেউ ছবি আঁকতে পারে, কেউ গান গাইতে পারে। আমি নবনীর বন্ধুদের দেখে ব্যপারটা বুঝেছিলাম।
যা বলছিলাম বাঙালি মেয়ের মন পেতে আমি বাঙলা শিখতে শুরু করলাম। নবনীর বন্ধুরাই আমাকে শিখিয়েছিল। আমার বাঙলা শিখতে অনেক দিন লেগেছিল প্রায় ছয় মাস তো হবেই। ইংরেজি অক্ষরে ওরা আমাকে বিভিন্ন শব্দের প্রতিশব্দ লিখে দিত। আমি এভাবেই শিখেছিলাম।
একদিন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বাংলায় ওকে আমার মনের কথা বললাম। নবনী খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। ও বোধ হয় ভাবেনি আমি বাঙলা শিখে ফেলব। ও খুশি মনেই রাজি হয়েছিল। নবনী ছিল ভীষণ মুক্ত চিন্তার একজন মানুষ। ওর কাছে আমার ধর্ম, বর্ণ এগুলো বাধার কারন হয়নি।
রীমার প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছে বাকি গল্প শুনতে। মাইক নবনীর গল্প বলতে অতীতকাল ব্যবহার করেছে। ওর বাম হাতের অনামিকায় আবার আঙটি দেখা যাচ্ছে। বাগানবিলাস প্রেমি মেয়েটার গল্প না শুনলেই নয়।
মাইক একটু থেমে আনমনা হয়ে চেয়ে আছে। বোধ হয় কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। রীমা চুপ করে অপেক্ষা করছে।
“ আমি সবসময় একটা কথা বিশ্বাস করি যা কষ্ট করে অর্জন করা যায় তার মুল্য আমাদের কাছে অনেক। আমরা অনেক সুখি ছিলাম। প্রথম দেখার ঠিক তিন বছর পরে নদীর ধারে একটা খোলা জায়গায় আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আমাদের দুইশ বন্ধু বান্ধব আর পরিবার পরিজন সবাই এসেছিলেন বিয়েতে। নবনীর পরিবারের অনেকেই খুব অবাক হয়েছিলেন আমার পরিস্কার বাঙলা শুনে আর হাত দিয়ে ভাত খাওয়া দেখে। আমি অবশ্য মাছের কাঁটা বাছতে পারতাম না। মাইক হাসছে।
আমরা যে শহরে থাকতাম তার নাম উইন্ডসর। ইউনিভার্সিটি টাউন। ডেট্রয়েট রিভার নামে একটা নদী আছে। সেই নদী পার হলেই অন্য পাশে আমেরিকা। শহরের নাম ডেট্রয়েট। নবনী মাঝে মাঝেই ওখানে শপিং করতে যেত। একাই যেত। আমার শপিংয়ে কোনো আগ্রহ নেই। এমন একদিন সকালে বেড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে ওর কোনো খবর নেই। আমি বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম। কেউ ফোন তুলছে না। আমি ধরে নিলাম ওর ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
দুশ্চিন্তা যখন বেড়ে গেলো আমি ওর বন্ধু বান্ধবদের ফোন করলাম। যা বুঝলাম ওরাও জানে না।
ঠিক রাত আটটা নাগাদ পুলিশের ফোন এলো। এক পার্কিং লটের সামনে এক বন্দুক ধারির গুলিতে নবনী.. বলে চুপ করে রইল মাইক।
রীমা আর কোনো প্রশ্ন করল না। দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
রীমা নীরবতা ভেঙে বলল, “ এবার একটু বাড়াবাড়ি রকমের ঠাণ্ডা পরেছে”।
“ আমেরিকার গান ভায়োলেন্স নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কেউ এ নিয়ে কথা বলবে না। ও ভুল জায়গায় ভুল সময়ে ছিল। আমি অনেকবার ভেবেছি আমি ওর সঙ্গে গেলে সেদিনটা অন্যরকম হতে পারতো।
এরপর আমি মাস ছয়েক ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভুগেছি। বাড়ি থেকে বের হতাম না। কারো ফোন ধরতাম না। শুকনো সান্তনা আমার অসহ্য লাগত। একদিন লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে কি করে আমার সব যন্ত্রণার অবসান করব তাই ভাবছিলাম। আই ওয়াস কনটেমপ্লেটিং সুইসাইড।
হঠাৎ দেখি নবনীর সেই বাগানবিলাসে ফুল এসেছে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। ও যেন আরেকবার আমায় নতুন করে আশার আলো দেখালো। শীতকালের শেষে বসন্ত আসে এমন মনে হল।
আপনি একটা অদ্ভুত কথা জানেন? আমার স্ত্রী শাহানা বাঙালি। ও আজকে আসেনি। আমি মনে মনে এমন কাউকে খুজছিলাম যার সঙ্গে বাঙলা বলতে পারব। আমার কষ্ট করে শেখা বাঙলা ভুলতে ইচ্ছে করেনি। মনে হতো ওর স্মৃতি বেচে থাকবে।
নবনীর মুখে শোনা সব জায়গায় আমি ঘুরেছি। কালকে শাহবাগ নামে একটা জায়গার কাছে এক ফুল বিক্রেতা মেয়ের হাতে বেলিফুলের মালা দেখে নবনীর কথা মনে পরল। আসলে কি জানেন? স্মৃতি থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে ভালোবাসার স্মৃতি”।
রীমা বলল,” আপনার ভালবাসার গল্প আসলেও অসাধারন সুন্দর”। বলে অন্যদিকে তাকালো। এই মুহূর্তে নবনী নামের অচেনা এক মেয়ের জন্য ওর চোখ আদ্র হচ্ছে।
মাইক বলল, “ তোমার সাইকলজিস্ট পরিচয়টা আমি জানি রীমা। বাগানবিলাস দেখে নবনীর কথা মনে পড়ল। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই ভালই হলো তুমিও বারান্দায় এলে”।
শাহেদকে দেখা গেল স্লাইডিং ডোরের অন্যপাশে। হাসিমুখে এসে বলল, “ তুমি মাইককে তো চেনো ? আমাদের শাহানার হাজবেন্ড।“
রীমা বলল, “ হ্যা। আমাদের পরিচয় হয়েছে। নয়ত এতক্ষন গল্প কার সঙ্গে করলাম?”
শাহেদ বলল,” আমাদের আজকে উঠতে হবে। তুমি একবার আমাদের বাড়িতে এসো”।
মাইক হাসলো, “ আমি শাহানাকে নিয়ে আসব একদিন”।
শাহেদ গাড়ি চালাচ্ছে। রীমা চুপ করে বসে আছে। মিউজিক সিস্টেমে বাজছে-
সেই মেঘবালিকার গল্প হোক, শহরজুড়ে বৃষ্টি হোক, রোদ্দুর হোক আজ শুধুই তাহার ডাকনাম।
ফারহানা সিনথিয়া
ক্যাল্গেরি, কানাডা।
