প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বই কেনা প্রবন্ধ দিয়ে শুরু করতে চাই। এই একটা প্রবন্ধের ছোট পরিসরে লেখক বাঙালি মানসিকতার যে চরিত্র এঁকেছেন তা এক কথায় অতুলনীয় এবং যথোপযুক্ত। প্রবন্ধের শুরুতে আনাতোল ফ্রাঁসের একটা উক্তি তুলে ধরেছেন, ‘হায়, আমার মাথার চতুর্দিকে যদি চোখ বসানো থাকতো, তাহলে আচক্ৰবালবিস্তৃত এই সুন্দরী ধরণীর সম্পূর্ণ সৌন্দর্য একসঙ্গেই দেখতে পেতুম।’ এরপরই ফ্রাঁস সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘কিন্তু আমার মনের চোখ তো মাত্র একটি কিংবা দুটি নয়। মনের চোখ বাড়ানো-কমানো তো সম্পূর্ণ আমার হাতে। নানা জ্ঞানবিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই এক-একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে।’
এরপরই লেখক মনের চোখ ফোটানোর আরো একটা প্রয়োজনের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায় বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’ এরপরই লেখক প্রশ্ন রেখেছেনঃ “কিন্তু প্রশ্ন, এই অসংখ্য ভুবন সৃষ্টি করি কি প্রকারে?” আবার উত্তরও দিয়েছেনঃ বই পড়ে। দেশ ভ্ৰমণ করে। কিন্তু দেশ ভ্ৰমণ করার মত সামৰ্থ্য এবং স্বাস্থ্য সকলের থাকে না, কাজেই শেষ পর্যন্ত বাকি থাকে বই। লেখকের ভাষায়, বই। তাই ভেবেই হয়ত ওমর খৈয়াম বলেছিলেন,’–
Here with a loaf of bread
beneath the bough.
A flash of wine, a book of
verse and thou,
Beside me singing in the wilderness
And wilderness is paradise enow.
এরপর লেখক মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন এবং খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের উদাহরণ দিয়ে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এখন বই পড়তে হলে বই কেনা অবশ্যম্ভাবী। আর বই কেনার বেলাতেই বাঙালির যত কার্পণ্য। বইয়ের দাম কমানোর ক্ষেত্রে প্রকাশকের ঝুঁকি বেশি সেই তুলনায় ক্রেতার ঝুঁকি অনেক কম তাই বই কিনে বইয়ের দাম কমানোর কথা বলা হয়েছে কারণ লেখকের ভাষায় “বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয় নি।” এরপর বিভিন্ন দেশের মানুষের বই কেনার অভ্যাসের সাথে বাঙালির বই কেনার তুলনা করেছেন এইভাবেঃ প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক যোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করে। একমাত্র বাঙলা দেশ ছাড়া। লেখক দুঃখ করে বলেছেনঃ জ্ঞানতৃষ্ণ বাঙালির প্রবল, কিন্তু কেনার বেলা সে অবলা! আবার কোনো কোনো বেশিরম বলে, ‘বাঙালির পয়সার অভাব’ বটে? কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা এ-কথা? ফুটবল মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, না সিনেমার টিকিট কাটার ‘কিউ’ থেকে।
যাইহোক উপরোক্ত প্রবন্ধের সারবস্তু হলো – বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ঞা প্রবল হলেও জ্ঞানের বাহন বই কেনার ব্যাপারে সে ভীষণ কৃপণ। এইবার আসি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাপারে। দীর্ঘদিন লেখালেখি করার ফলস্বরূপ গত একুশে বইমেলায় একখানা বই প্রসব করে ফেললাম। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে গত ছয় বছরের প্রসব বেদনার কিছুটা উপশম হলো। অবশ্য প্রকাশক লেখার পরিমাণ দেখে বলেছিলেনঃ এই লেখা দিয়ে আপনার তিনটি সন্তান মানে তিনটি বই প্রসব করা সম্ভব। আমিও ভীষণ উৎসাহিতবোধ করলাম। ভাবলাম ভালোই তো একই প্রসব বেদনায় যদি তিনটি সন্তান প্রসব করা যায় মন্দ কি? এখন কথা হলো সন্তান প্রসব করতে গেলে যেমন দাঈকে ডাকতে হয় ঠিক তেমনি বই প্রকাশ করতে গেলে প্রকাশকের দরকার হয়। আর আমি যেহেতু নবীন লেখক তাই নবীন প্রকাশকের শরণাপন্ন হলাম কিন্তু তখন পর্যন্ত আমার দাঈয়ের ফিস এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দামের বিষয়ে তেমন কোন ধারণা ছিলো না।

আধুনিক যুগে কোন প্রকাশকই বিখ্যাত লেখকদের ছাড়া অন্য লেখকদের বই নিজে থেকে প্রকাশ করতে এবং বিক্রয়ের দায়িত্ব নিতে চান না। প্রথম সন্তান ভুমিষ্ট হবার পর খরচের ফিরিস্তি শুনে আমার ভিড়মী খাবার জোগাড় হলো। পারলে সন্তানকে আবার গুটিয়ে পেটের মধ্যে নিয়ে রেখে দিই কিন্তু সেটাতো আর সম্ভব না। এখন খরচ দিতেই হবে। খরচ দিতে যেয়ে দেখি নিজের ব্যাংক একাউন্টে কোন টাকা কড়ি নেই। তাই বাধ্য হয়েই চুপি চুপি স্ত্রীর একাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে ফেললাম। পরবর্তিতে স্ত্রী সেটা দেখে ফেলে ভীষণ রাগ করেছিলো যদিও সেটা বাইরে প্রকাশ করেনি। আমি ভাবলাম এই শেষ। প্রথম সন্তনকে বেচে যে টাকা পাওয়া যাবে সেটা দিয়ে দ্বিতীয় সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাবো। কিন্তু সমস্যা হলো সন্তান ভুমিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশে। উহাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসা সেও এক বিশাল খরচান্ত ব্যাপার। বিষয়টা অনেকটা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’র মতো। আবারও স্ত্রীর একাউন্টে হানা দিলাম। সন্তান ভুমিষ্ট হবার খরচের তুলনায় আরো প্রায় অর্ধেক টাকা খরচ করতে হলো তাকে সাত সমুদ্র পারি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া আনতে।
এরপর একসময় প্রথম সন্তান অস্ট্রেলিয়া এসে পৌছালো। এসেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলো – বাবা আমি কবে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যাবো। আমি বললামঃ বাপু, আমি ঘরকুনো এবং ভীষণ লাজুক মানুষ তাই তোমার বেড়ানোর ইচ্ছাটা অন্যের কাছে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি না। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে তোমাকে দত্তক নিতে হলে তো আমাকেও তাদের কিছু খরচ দিতে হবে। আমি যে তোমাকে দাঈয়ের মাধ্যমে ভুমিষ্ট করলাম আবার অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসলাম। তখন সন্তান বললঃ বাবা তুমি না নিঃস্বার্থ বাবা বলে সবসময় নিজেকে দাবি করো তার কি হবে? উত্তরে আমি বললামঃ বাপুরে ঐ প্ৰবাদটার কথা শুনো নাই – আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তোমার আর আমার ক্ষেত্রে সেটা হলো আপনি বাঁচলে সন্তানের নাম। শুনে সন্তান আমার মন খারাপ করলো। এরপর আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করা শুরু করলাম যে আমার সন্তানকে দত্তক নেন। দত্তক নিতে অনেকেই রাজি হলো কিন্তু সবাই ভাবলো দত্তকই যখন নিচ্ছি তার জন্য আমার সন্তানের পিতাকে খরচ দেয়া লাগবে কেন। আমিও আর মুখফুটে খরচের কথাটা বলতে পারি না। এভাবেই আমার সন্তানটা বিভিন্ন বাসায় দত্তক চলে গেলো কাঁদতে কাঁদতে।
আমার সন্তানটাও আমার মতোই নিজে মুখ ফুটে তাকে জন্ম দিতে যেয়ে বাবার কষ্টের এবং খরচের বিত্তান্ত বলে না তাই আমি তার গায়ের মধ্যে এক জায়গায় খরচের একটা হিসাব লিখে দিলাম কিন্তু খুব কম লোকই সেটা খুলে দেখলো। আমি আকুল হয়ে গেলাম একদিকে সন্তানকে হারানোর কষ্টে আর অন্যদিকে সন্তানের ভরণপোষণের খরচ না পেয়ে। উপরন্তু অনেককেই আবার নতুন করে ডাকের মাধ্যমে সন্তানকে পাঠাতে যেয়ে কিছু টাকা খরচ হয়ে গেলো। সত্যি কথা বলতে খরচের ব্যাপারটাই বেশি পোড়াচ্ছিলো। কারণ যদি খরচের টাকাটা না তুলতে পারি তাহলে তো আর অন্য সন্তানগুলো পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। আমাকে বাকি জীবনটা প্রসব বেদনা নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। যাইহোক এই সন্তান কিন্তু আর কেউ নয় আমার প্রকাশিত প্রথম বই।

দীর্ঘ ছয় বছরের প্রসব বেদনার ফল ছিলো আমার এই তিন সন্তান তাই তাদের আকারও হলো অনেক বড়। এটাও ছিলো খরচ বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ। যাইহোক আধুনিক যুগে এই পৃথিবীতে কোন কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না এমনকি নিঃশ্বাস নেয়ার বাতাসটুকু পর্যন্ত বিক্রি হয় এই আধুনিক দুনিয়ায়। যেমন অস্ট্রেলিয়া থেকে চীনে বাতাস রপ্তানী অনেক লাভজনক একটা ব্যবসা। যাইহোক এই যুগে এমন একখানা হৃষ্টপুষ্ট পুস্তক প্রকাশ করতে যে লেখককে এক কাড়ি টাকা খরচ করতে হয়েছে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোন মানুষেরই সেটা বোঝার কথা কিন্তু এখানটাতেই বাঙালি অবুঝ এবং বধির। তার বুদ্ধির কোন অংশই এখানে খাটায় না। লেখক যে সময়ের অপচয় করে লিখেছেন সেটার খরচতো আর চাইছেন না। চাইছেন শুধু প্রকাশের খরচটা যাতেকরে আরো এমন পুস্তক পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারেন। অবশ্য অনেকেই নিজে থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে খরচের টাকাটা দিয়েছেন। আবার অনেকেই কয়েকগুণ বেশি টাকাও দিয়েছেন। আসলে এমন মানুষেরা যুগেযুগে ছিলেন বলেই হয়তোবা ছাপাখানার ব্যবসাটা এখনও টিকে আছে।
দেশের মানুষ বইয়ের পেছনে সামান্য অর্থ বের করলেও প্রবাসীদের মধ্যে এই অভ্যেসটা একেবারে নেই বললেই চলে। এর ব্যাখ্যা হিসেবে অনেক কথায় বলা যায় – যেমন নুন আনতে পান্তা ফুরায় বই কেনার টাকা পাবো কোথায়, বই যে কিনবো বই পড়ার সময় কোথায়, এই বই পরের প্রজন্মের তো আর কোন কাজে আসবে না ইত্যাদি। এগুলোরও উত্তর আছে যেমন – নুন আনতে পান্তা ফুরালেও মুম্বাই, কাবুল, পেশোয়ার থেকে জুড়িদার সালোয়ার কামিজ কিন্তু আসছে মাস অন্তর অন্তর; বই পড়ার সময় বাঙালির হাতে না থাকলেও দাওয়াতে যেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরচর্চা করার সময়ের কিন্তু অভাব নেই; পরবর্তি প্রজন্মকে শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বাংলা বইয়ের কোন বিকল্প নেই। এমনকি অস্ট্রেলিয়াতে সরকারিভাবে বহুভাষা শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় বিদেশী ভাষা শিক্ষার জন্য শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে কমিউনিটি স্কুলের। সেখানে শেখানো হয় বাবা মায়ের দেশের ভাষা।
যাইহোক সহসাই বাঙালির এই বৈকল্যের অবসান হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখি না। উপরন্তু আছে ফেসবুক নামের একটা বায়বীয় বই। সেখানে বিভিন্ন মানুষের জীবনযাপনের বাহারের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে লেখাও পড়া যায়। অবশ্য সেসব লেখার বিষয়বস্তু, মূল্যবোধ এবং গভীরতা নিয়ে সবসময় প্রশ্ন থেকেই যায়। আর কে কখন কার লেখা চুরি করছে তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এর বাইরে আবার আছে আধুনিক প্রযুক্তির ইবুক বা অডিওবুক। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে প্রথমে নিখাঁদ আনন্দ উপকরণ যেমন মানুষ, প্রকৃতি, বইয়ের মতো বিষয় থেকে আলাদা করে ফেললো যাতে করে সে বিষণ্ণতায় ভুগে। আবার সেগুলোকে ব্যবসার উপকরণ বানিয়ে বাজারে নিয়ে আসলো আরো অনেক উপকরণ। এভাবেই আধুনিক জীবনে “বিজ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ।”
আবার বই কেনা প্রবন্ধের কাছে ফিরে আসি। আরব্যোপন্যাসের একটা গল্প দিয়ে লেখক শেষ করেছেন। সেই গল্পে হেকিমের বই হাতিয়ে নিতে যেয়ে রাজার মৃত্যুর কাহিনী বর্ণনা করে লেখক উপসংহার টেনেছেন এইভাবে – “বাঙালির বই কেনার প্রতি বৈরাগ্য দেখে মনে হয়, সে যেন গল্পটা জানে, আর মরার ভয়ে বই কেনা, বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে।” আর বাঙালির বর্তমান অবস্থা দেখে মনেহয় বাঙালি বই দু একখানা পড়লেও পড়তে পারে কিন্তু সেই বই কেনার জন্য পয়সা খরচ করা বাঙালির মজ্জাগত নয় মোটেও। এহেন অবস্থায় লেখক এবং প্রকাশকের পেটে পাথর বাধা ছাড়া কোন গত্যন্তর দেখি না। লেখক সময়ের অপচয় করে লিখবেন। প্রকাশক কাগজ এবং কালির অপচয় করে বই ছাপাবেন কিন্তু মানুষ সেই বই আর কিনবে না। এমতাবস্থায় লেখালেখি এবং বই প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া সময়ের দাবী। এতে অন্ততঃপক্ষে নিরীহ উদ্ভিদকূল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আমাদের জন্য কিছুটা হলেও অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে পারবে।
মো: ইয়াকুব আলী
প্রকৌশলী, লেখক
প্রকাশিত গ্রন্থ: নদীর জীবন; অস্ট্রেলিয়ার ডায়েরি।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।