বাবাকে নিয়ে -তানিম হায়াত খান রাজিত

  
    

[ বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীত গবেষক লেখক, শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক মোবারক হোসেন খান না ফেরার দেশে চলে গেলেন গত ২৪ নভেম্বর। তিনি রেখে গেছেন তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থ।  সিডনি প্রবাসী সরোদ বাদক, সংগীত শিল্পী সুরকার তানিম হায়াত খান রাজিত তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান।  প্রশান্তিকায় বাবার জন্য রাজিত লিখলেনবাবাকে নিয়ে’]

তানিম হায়াত খান রাজিত

বাবাকে নিয়ে লিখবো আজকে।  ‘বাবা’ বাবাকে নিয়ে। মিউজিকলোজিস্ট বাবাকে নিয়ে নয়।
আমরা তিনভাইবোন। আমার বাকি দুই ভাইবোনের থেকে আমি একটু ছোটই। তাই বাবা মায়ের সাথে সময়টাও কাটিয়েছি একটু অন্যরকম ভাবে। আমার বড় ভাইবোন যখন বড় হয়েছে তখন বাবার অফিস সময়সূচী ছিল ৭:৩০ থেকে ২:৩০। তাই প্রতিদিন অফিসের পরে ওনারা চারজন বেড়াতে যেতেন অনেক জায়গায়। আমি যখন বড় হচ্ছি তখন অফিস সময়সূচী বদলে হয়ে গেল ৯টা ৫টা। আর মা তখন সন্ধ্যায় কলেজে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। তাই আমার বাবার সাথে সময় কাটানোর গল্পটা বাকি দুইভাইবোনের থেকে একটু আলাদা। বাবা ততদিনে লেখালেখি নিয়ে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আশির দশকের শুরুর কথা বলছি। অফিশিয়ালীও বাবা তখন ভীষণ ব্যস্ত। বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের ডিরেক্টর তখন বাবা। দেশ বিদেশ ট্যুর প্রায়শই থাকত। তাই আমার বাবার সাথে সময় কাটানোর মূহর্তগুলো ছিল বাবা অফিস থেকে ফেরার পর, সন্ধ্যার পরে। বাবা সন্ধ্যার পরে ওনার লেখালেখি সংক্রান্ত কাজগুলো করতে বের হতেন। বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম বাংলাবাজার, মুক্তধারা, আজিজ সুপার মার্কেট, অফিসার্স ক্লাব, বাংলা অ্যাকাডেমি, সংবাদ পত্রিকা অফিস আরো কত সব জায়গা। আর কত নামিদামী মানুষদের সাথে আড্ডা হত তখন বাবার, আমি আসলে তখন বুঝতামও না এতোকিছু৷ বাবার সাথে সাথে আছি এটাই দারুণ লাগতো! আমি নিজের চোখের সামনে শ্রদ্ধেয় হাশেম খানকে দেখেছি বাবার বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি আঁকতে! একদম সাদা কাগজ থেকে কিভাবে একটা প্রচ্ছদ দাঁড়িয়ে গেল! এগুলো সবই স্মৃতি!
আমার অন্য দুই ভাইবোনের থেকে আমার আধুনিক খেলনার প্রতি আগ্রহ ছিল সবসময়েই বেশী। বাড়ির ছোটগুলো মনে হয় একটু এরকমই হয়। বাবা যখন ১৯৮৩ সালে কনফারেন্সে জাপান যান ১৫ দিনের জন্য, তখন ফিরবার সময় নিয়ে আসেন Nintendo Donkey Kong II – যেটা সেই সময়ে একদম হাতে গোণা কিছু মানুষের কাছে ছিল। এখন তো ঘরে ঘরে একের অধিক। আমি আর ভাইয়া সেই Ninfendo Donkey Kong II পালা করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলতাম। বাবা সেবার ছোট্ট একটা ব্যাটারিচালিত Casio Piano নিয়ে এসেছিলেন! সেটার কারণেই মনে হয় আমার সুরের সাথে প্রথম সখ্যতা হয়েছিল। আমার প্রথম নিজের ক্যামেরা বাবা চীন থেকে এনে দিয়েছিলেন ১৯৯২ সালে। জীবনের প্রথম ব্র্যান্ডেড কেডস ‘FILA’ বাবা এনে দিয়েছিলেন জার্মানী থেকে ১৯৯০। হংকং থেকে এনেছিলেন রিমোট কন্ট্রোল গাড়ী ১৯৮৮ সালে। বাবা জানতেন তাঁর এই ছোটছেলেটা একটু সৌখিন।
বাবা একটু রাশভারী ছিলেন। তাই সরাসরি কিছু চাইতে গেলে হার্টবিট বেড়ে যেত। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি তখন একবার আমার এক বন্ধুর টয় ট্রাক দেখে আমার খুব শখ হয়েছিল সেরকম একটা ট্রাকের। সাহস করে বাবাকে বলা মাত্রই নাকচ হয়ে গেল সেই ইচ্ছা। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম ব্যপারটা। কিন্তু বিকালে অফিস থেকে বাসায় ফিরেই বাবা ওনার পিছনে লুকিয়ে রাখা টয় ট্রাকটা বের করে আমাকে দিলেন! আমার ওইটুকু বয়সের আনন্দ আর দেখে কে! বুঝেছিলাম আমার জন্য বাবা একটু আলাদা।
আরেকবার বাবা চিটাগাং যাবেন অফিশিয়াল কাজে। দুরপাল্লার বাস R & Co ছাড়বে আমার স্কুল নজরুল শিক্ষালয়ের একদম পাশ থেকেই, যেখানে এখন ওয়্যারলেস আড়ংটা আছে – বিশাল সেন্টারের পাশে। ১৯৮৩ সালের কথা। বাবা আমাকে স্কুলে নামালেন আর যাবার আগে একটা আপেল দিলেন। আমি স্কুলে চলে গেলাম। আমার ক্লাসের জানলা দিয়েই বাসটা দেখা যাচ্ছিলো। একটু পরে সেই বাস বাবাকে নিয়ে চলে গেল। আমি ব্যাগ থেকে আপেলটা বের করলাম। কিন্তু নিজের অজান্তে আপেলটার দিকে তাকিয়েই হুহু করে কেঁদে দিচ্ছিলাম বারবার!

বাবার সঙ্গে ছোট্ট আমি

আমার কাছে বাবার চেহারাটা একটু অন্যরকম। কারণ বাবা বাইরে একদম প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন। আর আমি অন্য দুইভাইবোনের  চাইতে বাবার সাথে বাইরে বেশী ঘুরেছি। আমি বাবার সাথে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গেছি, কুমিল্লা ঘুরেছি, নবীনগর ঘুরেছি, মানিকগন্জ ঘুরেছি, যমুনা বীজ কন্সট্রাকশনের সময়ে গেছি! আমি বাবার ছোটবেলার বন্ধুদের আড্ডায় অনেকবার গেছি। দূর থেকে বসে দেখেছি আড্ডা জমিয়ে রাখা অন্যরকম বাবাকে।
ক্রমে যখন কিছুটা বড় হয়েছি তখন বাবার আরেকটা দারুণ ব্যপার পেয়েছিলাম। বাবা আমাকে নিয়ে বের হলে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেতেন। আমাদের সময়ে এই ব্যপারটা স্বপ্নের মতন ছিল! নব্বই দশকের একদম শুরুর দিকের কথা। সেই আমিই কিন্তু ছোটবেলায় বাবা সকাল বেলায় যখন চা খেতেন টি টেবিলে বসে, তখন পায়ের কাছে বসে থাকতাম একটু খানি চায়ের লোভে! বাবাও বুঝতেন। পাউরুটিটা চায়ে ডুবিয়ে আমার মুখে তুলে দিতেন। অমৃতের মতন সেই স্বাদটা এখনও মুখে লেগে আছে!

বেশীরভাগ বাচ্চারা বড় হয় ঘুমের সময়টা মায়ের সাথে কাটিয়ে। আমার এই ব্যপারটাও কিন্তু আলাদা। আমি ১১ বছর পর্যন্ত বাবার সাথে ঘুমিয়েছি। বাবার শরীরের গরম ওমটা অনুভব করে ঘুমাতাম আমি! ঘুম না আসলে বাবা মাথায় হাতিয়ে দিতেন, চুল আস্তে আস্তে করে টেনে দিতেন! এরপরে যখন আরো বড় হলাম, ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তখন বাবা হলেন আমার আদর্শের প্রতিমূর্তি।

বাবা ও মা সহ আমাদের পুরো পরিবার

তখন আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসার। বাবা-মা-আমি। দুই ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা অন্য ফ্লোরে থাকতো। তবে রাতের খাওয়াটা আমরা সবাই জমিয়ে একসাথে করতাম। তারপরে রাত দশটায় সবাই চলে গেলে আমি আর বাবা ড্রইংরুমে বসে সময় কাটাতাম! সেই সময়টুকু ছিল বাবার আদর্শে দীক্ষিত হবার গল্প! বাবার ফিলোসোফি নিজের করে নেবার গল্প। বাবার সাথে বসে ইংরেজী মুভি দেখেছি গভীর রাত পর্যন্ত। এ ব্যপার গুলো অন্য ভাইবোনদের থেকে আমার একদমই অন্যরকম ছিল। আবার তাদেরও এমন অনেক গল্প আছে যেগুলো আমার নাই। আসলে বাবা অ্যাডজাস্ট করে নিতেন আমাদের তিনভাই বোনের যার যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী৷

আসলে আমি বাবার কতটুকু পেয়েছি? চেহারা তো একদমই না! তবে ফোনে হ্যালো বললে বহুদিনই আমাকে স্যার বলে কথা বলে দিতে শুরু করে দিত অনেকেই। আর হাবেভাবে? সেটারও মজার একটা গল্প আছে। একবার নাট্যশিল্পী শর্মিলী আহমেদের একটা চিঠি ভুলক্রমে আমাদের পশ্চিম রামপুরার বাড়িতে চলে আসে। মা বললেন চিঠিখানা শর্মিলী চাচীর বাড়ি পৌঁছে দিতে আসতে। আমি পূর্ব রামপুরায় ওনার বাড়িটা চিনতাম আগের থেকেই। তাই গিয়ে নক করলাম। শর্মিলী চাচী দরজা খুললেন। আমি চিঠিটা দিয়ে বললাম যে আমাদের বাড়িতে ভুল করে ওনার চিঠি চলে এসেছিল, আমি সেটা ফেরত দিতে এসেছি। আমি আমার পারিবারিক পরিচয় আর দিলাম না। শর্মিলী চাচী চিঠিটা নিলেন। আমি ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করলাম। অর্ধেক সিঁড়ি নেমেছি, পেছন থেকে শর্মিলী চাচী ডাকলেন, “শুনো!” আমি দাঁড়ালাম। ঘুরলাম। চাচী বললেন, “তুমি কি মোবারক ভাইয়ের কিছু হও?” আমি তো হতবাক! বুঝলাম। নিজের অজান্তেও কথা বার্তা বা হাবভাবে নিশ্চয় কোথাও দারুণ মিল আছে আমার বাবার সাথে!

যৌবনে বাবা মোবারক হোসেন খান

পড়াশুনার কথা একটু না বললেই নয়। বাবা আমাকে অংক করাতেন, বায়োলজি নোট করে দিতেন। ১৯৮৮ সালে বাবা রাজশাহী বদলী হয়ে গেলেন চাকরীর সুবাদে। যাবার সময় বায়োলজি বইটা কিনে নিয়ে গেলেন। আমার জন্য নোট করে সেটা পোস্টে করে পাঠিয়ে দিতেন! এছাড়াও পরবর্তীতে আমি ঢাকাতে কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ব, বিদেশে আসলে কোন দেশে আসবো এসব কিছুই বাবার সাথে কথা বলে নেয়া। আমি যখন ২০০৩ এ বাইরে পড়তে যাবার ডিসিশন নিলাম তখন বাবা বাসার সবাইকে নিয়ে মিটিং ডাকলেন। সেখানে সরাসরি বলে দিলেন যেই দেশে গেলে সুমিকে নিয়ে একবারে যেতে পারবো শুধু সেই দেশেই আমি যেতে পারবো। যেদিন দেশ ছাড়বো সেদিনই একই ফ্লাইটে আমি আর সুমি উঠবো। কতটা সূদরপ্রসারী আর বাস্তবধর্মী না হলে এরকম চিন্তা করা সম্ভব!

প্রৌঢ় বাবার সঙ্গে আমি

আমরা সিডনিতে চলে আসবার পর প্রতি দুই বছর পরপর বাবা সিডনি আসতেন। একদম নিয়ম করে। আমার গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতেও বাবা ছিলেন। আমার প্রথম প্রফেশনাল চাকরী হবার কিছুদিন পর বাবা সিডনি এসেছিলেন। আমাকে অফিসের অ্যাডমিন ম্যানেজমেন্টের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। ছেলে তূর্যর অন্নপ্রাসন করলেন। আমার TAFE Digital এ ফুলটাইম জব হবার কথা জানলেন এরপরে, আরো জানলেন আমার হেড অব দা ডিপার্টমেন্ট হবার খবর। চাকরী পার্মানেন্ট হবার খবর। দেখলেন ধীরে ধীরে সরোদে কিছুটা পারদর্শী হয়ে ওঠা! সরাসরি কিছু বলতেন না, কিন্তু আমি রেয়াজে বসলেই চুপ করে সামনে এসে বসতেন – ঢাকা সিডনি দুই জায়গাতেই। সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ দেশে গেলাম। তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

জীবনের পরিক্রমায় আমিও এখন মাঝবয়সী।আমার মনে হয় আমার এখন পর্ষন্ত জীবনের যতটুকু সফলতা তার সবটাই বাবা দেখে গেছেন। সেই ছোট্টবেলায় বাবার হাত ধরে মুক্তধারায় যাওয়া রাজিতকে বাবা রেখে গেলেন মধ্যচল্লিশে। আসলেই কি গেছেন? একদমই না। আমার কাছে বাবা এখনও আছেন ছায়ার মতন হয়ে, বিশাল ছাতা হয়ে। আমার এভাবেই ভাবতে ভাল লাগে।
বাবাদের মৃত্যু নেই।

তানিম হায়াত খান রাজিত
সরোদ আর্টিস্ট, শিল্পী ও সুরকার
মোবারক হোসেন খানের পুত্র।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments