বাবার মৃত্যু: কৃতজ্ঞতা, এই পরবাসে যারা পাশে দাঁড়িয়েছেন । নাদেরা সুলতানা নদী

  
    

গেল বছরের শুরু থেকে এই সময়টা ছিল পুরো বিশ্বের জন্যেই খুব এলোমেলো।
হঠাৎ যেন এক দমকা হাওয়া। যে যেখানেই যে অবস্থায় ছিলাম একটা অন্যরকম যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই যেন পড়ে যাই। কোভিড-১৯ কে মোকাবেলার নানামুখি যুদ্ধে লিপ্ত আমরা যেনো সকলে।

এই পরবাসে বসে নিজেদের এক রকম যুদ্ধ আবার অন্যদিকে দেশে থাকা প্রিয়জনদের জন্যে দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা নিয়ে অজানা আশংকায় প্রতিটি মুহূর্ত!
নিজের বদলে যাওয়া সময় এবং অভিজ্ঞতার কিছু বলবো এবং আমার বিশ্বাস আমার এই ডায়েরি নোটস আজ থেকে কয়েক যুগ পর ইতিহাসের খন্ড চিত্র হয়েই থাকবে।

একটু পেছন থেকে বলি, আমি মূলতঃ লেখালেখি করি ফেসবুকে এবং এই ফেসবুক জগৎটা চেষ্টা করি একান্তই আমার মতো করে রাখতে। লেখালেখি দিয়ে প্রকাশ করে ফেলি আমার সকল অনুভব তবে অবশ্যই তাতে শুধু নিজের কথা বলিনা। তুলে আনি অনুভব অন্য কারো খুব যতনে।

আমার বাবা মা আত্মীয় পরিজন স্বামী পুত্র ও অন্য সব কাছের পরিবারের অনেকেই তেমন নয়। মানে ফেসবুকে ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে লেখা পছন্দ করেননা। তাই পারতপক্ষে আমি আমার পরিবার নিয়ে চেষ্টা করি ওভাবে কিছু না লিখতে।

অনেকদিন পর গেল বছর হঠাৎ আব্বা একটু অসুস্থ হওয়ার পর, মনের অস্থিরতাটা প্রকাশ করে ফেলেছিলাম ফেসবুক স্ট্যাটাসে। সত্যি বলতে সব মিলে সিচুয়েশনে এমন ছিল যে, প্রকাশ করতে চাইছিলাম আসলে আমাদের সকলেরই এই সময়ের অসহায়ত্ব। চাইলেই আমরা আজ পরিবার পরিজনের কাছে ছুটে যাব সে পরিস্থিতি আজ নেই!

তারপর জানালাম সবাইকে, আব্বা অসুস্থ ছিলেন, এখন একটু ভালো আছেন। দুর্বল আছেন তারপরও বলবো কিছুটা ভালো আছেন। তবে অসুস্থ হবার পোস্ট দেয়ার পর যে বিষয়টা আমাকে ছুঁয়ে গেছে, হাজার মাইল দূরে বসেও ফেসবুক জগতেই আছেন এমন শ্রদ্ধাভাজন যাদের বড় ভাই বোনের মতন করে দেখি, কাছের বন্ধু এবং এই জীবনে হয়তো দেখাই হবেনা এমন অনেকেই বারবার খোঁজ নিয়েছেন, জানিয়েছেন দোয়া করছেন আমি জানি তাঁরা আমাকে ভালোবেসেই করেছেন এমন। ঢাকায় আছেন সরকারের অনেক বড় কর্মকর্তা বলেছেন যদি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আনার কোন ব্যবস্থা করতে হয় উনি করবেন। কী যে শান্তি লাগে মনে এমন বার্তায়।

বিষয়টা আমার মনোজগতে ভীষণ রকমের একটা ছাপ রেখে গেছে এবং আমি সব সময় যা বলি, অনেক না পাওয়া যেমন জীবনে আছে, আছে এমন প্রাপ্তিগুলোও। কখনও কখনই আমরা কারো না কারো প্রার্থনায় আছি এই শুনলেই মনে একটা প্রশান্তি আসে। হয়তো বিপদ কেটে যায়না, তারপরও।
মা বাবা অসুস্থ থাকলে পৃথিবী হঠাৎ খুব অসহায় হয়ে যায় আমাদের। সকল শুভ কামনা সকল মা বাবার জন্যে, সব সময় তাই আমাদের মনে কাজ করে এই হাজার মাইল দূরে বসে।

আমি যেটা আমার নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি, সন্তানের কোন না কোন অসুস্থতা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাননি এমন মা বাবা পাওয়াই যাবেনা।  ঠিক একইভাবে একসময় সেই মা বাবাকে নিয়ে সন্তানেরও ফিরে আসে নির্ঘুম রাত। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ফিরে ফিরে আসে একই অনুভব পরিবারের একে অন্যক ঘিরে এক জীবনে।

এই লেখাটা লিখতে চাইছিলাম সেই জানুয়ারী থেকে, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০ আমার আব্বা চলে গেলেন। না কোরোনা আক্রান্ত হননি উনি। তবে গ্রামের বাড়ী ছিলেন, বার্ধক্যজনিত কিছু সমস্যা ছিল, কোরোনা এফেক্টের জন্যে চলাচলে বাঁধা থাকায় চেক আপের জন্যে আসতে পারেননি এটা একটা বড় কারণ ছিল উনার হঠাৎ শরীর খারাপ করার। তারপরও আব্বার চলে যাবার দুই তিন আগেই ভিডিও কলে কথা হয়েছে।
২৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বাভাবিক কথা বলা, নামাজ পরা এবং নাস্তা খাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং প্রেশারের মেডিসিন সহ অন্য কোন একটা মেডিসিন চেয়েছেন এবং হাতে নিয়ে খেতে যেয়েই চির নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েন তিনি!  উনি বুঝি এমন শান্তির ঘুমই চেয়েছিলেন।

আমি অস্ট্রেলিয়া বসে অফিস করছিলাম বাসা থেকে। এক জুম মিটিঙে ছিলাম তখন। এই সময় দেশে থাকা পরিবার আমাকে খুব জরুরী না হলে কল করেনা। অসময়ে কল পাই এবং শুরুতে সরাসরি আব্বার মৃত্যু সংবাদ আমাকে কেউ দিতে পারছিলনা আসলে, কিন্তু সব মিলে আমি বুঝে যাই অল্প ক্ষণেই!

২০২০ এ আমরা যারা পরবাসে আছি তাদের অনেকেই হারিয়েছি কাছের মানুষ। বাইরে বসে এমন দুসংবাদ যে বা যারা পেয়েছেন তারাই জানেন এই শূন্যতা কী ভীষণ ভয়াবহ ভাবে বুকের মাঝে চেপে বসে। নিজেকে লম্বা সময় কোন সান্ত্বনা দেয়া যায়না যখন আপনি নিজ পরিবারের কাছেও যেতে পারছেননা এটা মানা খুব বেশী কঠিন।
আব্বা নেই খবরটা বিশ্বাস হচ্ছিলোনা, আর তাঁকে দেখতে পাবোনা এই সত্য মানতে পারছিলামনা। তারপরও যখন বুঝতে পারলাম উনি আর নেই, আমি কেমন করে ঠিক কী লিখে যে ফেসবুকে পোস্টটা দিয়েছিলাম, সত্যি বলতে একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম তখন।

আমার পরিবারের খুব কাছের বলতে প্রথম বাবাকে হারানোর বিষয়টা। মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়ায় বসে যখন পেলাম এই খবর তখন আমি ছিলাম লকডাউন সহ সকল রকম চূড়ান্ত রেস্ট্রিকশনে। শহরে থাকা দুই একজন বন্ধু কেউ যে সশরীরে এসে আমার পাশে দাঁড়াবে সে উপায় ছিলোনা।

খবরটা পাবার পর আমি অনেকটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে চিৎকার করছিলাম, কী কী যেন বলছিলাম সোফায় আছড়ে পড়ে… বাসায় তখন আমার কিশোর পুত্র ছাড়া কেউ ছিলোনা। ওর বাবা কাজে অনেক দূরে আসতে প্রায় ২ ঘন্টা লাগবে…আমার ছেলেটা কখনও যা না করে ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো… এ যেন হারানো বাবার ছায়া হয়ে কেউ একজন আমাকে ছুঁয়ে রইলো একটু সময়।

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র বোন বন্ধু মিতা চৌধুরী, যে আমার প্রায় ২০ মিনিট ড্রাইভ দুরত্বে থাকে। ও ই প্রথম বিশেষ পারমিশন নিয়ে বিকেলে আসে এবং লম্বা সময় সে আমার পাশে বসেছিল। পরদিন, ওর নিজের ছেলেটা সব মিলে খুব সুস্থ ছিলোনা, এর মাঝেই প্রায় সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে খাওয়া যাবে এমন সব খাবার রান্না করে  ফ্রিজ ভর্তি করে দিয়ে যায় মিতা।

সিডনিতে থাকা আমার ফেসবুক বন্ধু সাকিনা, ও কল দেয়, ওভাবে কারো কল এটেন্ড করবো সে অবস্থায় ছিলামনা। তারপরও ওর কলটা রিসিভ করা হয় হুট করেই এবং ও এমনভাবে বলে ‘’তোমাকে কথা বলতে হবেনা, আমি বলি একটু শুনো প্লিজ’’। আমার বলতে দ্বিধা নেই ওর কথা ভালো লাগতে থাকে, আমি চোখ মুছি কিন্তু ভেতর থেকে কী যেন একটা হতে থাকে…
সেই নির্ঘুম রাতে সাকিনা ছিল আমার সাথে এবং ও যখন বললো আব্বার জন্যে সে বিশেষ দোয়া করে দিচ্ছে এটা জানার পরের অনুভতি বলে বুঝাতে পারবোনা।

মেলবোর্ন থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ভাই বোন সম দম্পতি স্মারকনীলিমা এলো বেশ কদিন পরযেহেতু আসা যাচ্ছিলোনা আমার বাসায়। কিন্তু ওরাও যে এভাবে আমায় ভেবে এত এত খাবার কষ্ট করে রান্না করেনিয়ে আসবে আমি সত্যি ভাবিনি। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। দেশ ছেড়ে এলো ওরা এই সেদিন কিন্তু এই যে সহমর্মিতাএই সময়টুকুতে  আমার মনে থাকবে।

ব্রিসবেন থেকে  সিনিয়র এক আপা স্বপ্না উনার সাথেও ওভাবে কথা হয়নি অনেকদিন, হঠাৎ কল দিয়ে নিজের জীবনের হারানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেন উনি পাশে আছেন। অন্যরকম এক ভালো লাগে। এডেলেইডে আছেন আমার খুব প্রিয় এক আপা, যার কাছ থেকে এই প্রবাস বসে পাই পছন্দের শাড়ী, সেই মুক্তা আপা যা করেছেন আমি শোকের মাঝেও তীব্র ভালো লাগায় আবেগে আপ্লূত হয়ে যাই। আপা সেই এডেলেইড বসেই মেলবোর্নে থাকা কোন এক ক্যাটারিং সার্ভিসের কাছে খাবার অর্ডার করেন এবং সেই খাবার যখন আসে আমি আমার শোককে হঠাৎ পাই যেন, অন্য রকম এক মৈত্রীর বার্তা হিসেবে। এই যে, যে যেখানে আছেন সেখান থেকে আমার পাশে থাকবার চেষ্টা করছেন এই ব্লেসিং কী আমার আব্বার আত্মাকে শান্তি দেবেননা!

আমার কাছের সব বন্ধুরা সেই লন্ডন আমেরিকা এবং বাংলাদেশ থেকে তো ছিলোই আমার পাশে তাদের মত করে প্রতিটা মুহূর্ত তাদের কথা আলাদা করে বলছিনা, বলছি শুধু এই পরবাসে যে বা যারা নূতন করে আমার একটা স্তব্ধ সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন অন্য রকম এক মমতা নিয়ে কিছুটা সময়।

আমার ছোট ভাই তার পরিবার নিয়ে থাকে সিডনি ওর মনের অবস্থা কেমন হতে পারে বুঝতে পারছিলাম কিন্তু দুই ভাই বোন এক সাথে হবো সে উপায়ও ছিলোনা।
সিডনি থেকে প্রকাশিত মুক্তমুঞ্চ সম্পাদক নোমান শামীম ভাই তাঁর একটি শোকবার্তা পোস্ট করার পর অসংখ্য অপরিচিত মানুষ আমাকে ইনবক্সে বলেছেন তাঁরা আমার আব্বার জন্যে দোয়া করছেন এবং আমি যেন এই শোক কাটিয়ে উঠি! শামীম ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

আমার যুক্ত থাকা পত্রিকা প্রশান্তিকার অনেক অনেক পাঠক আমার প্রয়াত বাবাকে নিয়ে প্রশান্তিকা সম্পাদকের করা বিশেষ সংবাদের নীচে কমেন্টে তো সহানুভুতি জানিয়েছেন, পাঠিয়েছেন ব্যক্তিগত মেসেজ। সেদিন প্রশান্তিকার একটি লাইভ ছিলো। আমার বাবার মৃত্যুর কারণে ওরা লাইভটি বন্ধ রাখতে চেয়েছিলো। আমি শুনেছি সেদিন ছোট ভাই সম নামিদ ফারহান বলেছিলো- এই লাইভ বন্ধ হোক। আমি তা হতে দেইনি। শো মাস্ট গো অন বলে যে কথাটা রয়েছে, সেটা নষ্ট হতে দেইনি। সেদিন নন্দিত শিল্পী অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় এবং সঞ্চালক তানজিনা তাইসিন আমার বাবার জন্য প্রথমেই শোক প্রকাশ করেছেন। বাবাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে অঙ্গনা গেয়েছেন বিশেষ প্রার্থনা সঙ্গীত। প্রশান্তিকার সাথে যুক্ত তুলি নূর আপা, ছোট ভাই সম আরিফসহ সকলে যে সমবেদনা পাঠিয়েছে, তাতে বারবার আপ্লুত হয়েছি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

কেউ জায়নামাজে, কেউ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে সকল দোয়া প্রার্থনায় আমার জন্যে আমার বাবাকে মনে করেছেন এই পাওয়াটুকু আমি মনে রাখবো।
আমি এই  হারানোর মাঝখান দিয়ে যেটি উপলব্ধি করেছি আমার আব্বার চলে চাওয়াটা হয়তো আমার একান্ত এক শোক, এটা কোনদিন কাটাতে পারবোনা, শুধুই যাপিত জীবনে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করতে হয় জীবনের নিয়মেই। তবে এই বিভূঁইয়ে এত এত মানুষের সহানুভুতি পাওয়া বা জানানো তাঁরা পাশে আছেন এই বার্তাটুকু যে কী ভীষণ ভাবে আমায় জীবনে ফিরিয়েছে এবং আমি নিজেও চেয়েছি আমার সকল সাধ্য নিয়ে কাছের বা দূরের বন্ধুদেরও পাশে থাকতে।

মানুষই হয়তো ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অনেকবার কষ্ট দিয়েছে, বেদনায় নীল হয়ে আস্থা হারিয়েছি। সেই মানুষই আবার অনেকভাবে দিয়েছেন জীবনকে ভালোবাসবার আহ্বান।
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’’

নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments