বাবা-কাজী লাবণ্য

  
    

সকালের নাস্তা শেষ। আজ মুন্নির মা তাঁর বিখ্যাত সবজি খিচুড়ি আর ডিমভাজা করেছিল সাথে ছিল ঘানির তেলে ডোবা জলপাইয়ের আঁচার। খাওয়া বেশি হইছে পেট একেবারে আইঢাই করতেছে। সোনার বরণ পানের বাটায় পান, শুপারি, মৌরি, দারুচিনি, ছোট্ট কাঁসার কুলিয়াতে চুন, পাশে বাবা জর্দার কৌটা। সব কিছু দিয়ে সাজানো পান মুখে দিয়ে আঙুলের মাথায় চুন নিতে নিতে গলা বাড়িয়ে মুখ তুলে ডাকতে থাকে মুন্নির বাবা-

-মা, মা, ওমা, কইরে বুড়ি…

ডাকতে ডাকতে মেয়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ঘরে ঢুকে দেখে মেয়ের পড়ার টেবিলে ওর বই খোলা আবার কম্পিউটারও ডালা খোলা বাক্সের মত হা করে আছে। নেট চালু আছে, মুন্নির বাবা এসব আধুনিক প্রযুক্তির কিছু বোঝেনা, বোঝার কোন চেষ্টাও করেনা। তার কোনরকম আগ্রহ নেই এসবে। তিনি মাথাটা এগিয়ে নিয়ে সেখানে কি লেখা তা পড়ার চেষ্টা করেন। কত ছোট ছোট সব মানুষের ছবি আর কি কি সব লেখা… মেয়েটা কই গেল! এদিক ওদিক ঘাড় ঘুড়িয়ে আবার ল্যাপটপের ডালায় তাকান- হঠাত সেখানে চোখ আটকে যায়- অন্যসব লেখার চেয়ে একটু বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে কে যেন লিখেছে-

“পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই” ।

মুন্নির বাবার ঠোঁটে একটা অমলিন হাসির রেখা ফুটতে ফুটতে মিলিয়ে যায়। মনে মনে ভাবে এইটা আবার  ল্যাখার কি হইল! এইটাতো আসমান জমিনের মতই সত্যি। যত্তসব! তিনি আবার মুখ তুলে ডাকেন

-মা, ওমা, ও টেপরি…

ঘরের ওপাশে বারান্দা, বারান্দার শেষ মাথায় লাগোয়া বাথরুম। সেখান থেকে মেয়ের ঝাঁঝালো উত্তর ভেসে আসে-

-কি হইছে? এত চেঁচাচ্ছ কেন?

-এই আমি একটু বাইরে যাচ্ছিরে মা, তোর কি কিছু লাগবে? কিছু আনতে হবে?
-যাও! আমার কিছু লাগবে না। মেয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

-না, না তুই বাইরে আয় কথা আছে… মেয়ের আর কোন উত্তর আসেনা। জানে বাবার কোন কথা নেই। মেয়েকে না দেখে, না বলে কয়ে তিনি কোনদিন বাসার বাইরে যাননা। সারাক্ষণ কেবল মা! মা! মা! মেয়ের মুখটা মমতায় আদ্র হয়ে ওঠে। বাবাটা যে কি পাগল। এই নিয়ে মা কত বকে মুন্নি নিজেও কত মুখ ঝামটা দেয় কিছুতেই কিছু হয়না। মেয়ে বের হয়ে এলে বাবা মেয়ের মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে বলে-

-আমি যাই মা। আজ মনে হয় ফিরতে দেরি হবে। কাল রাতে তোকে বললাম না তোর চাচ্চুরা আজ আসবে। ওরা আমার স্কুল জীবনের বন্ধু…

-হ্যাঁ বাবা জানিত, তুমি এসব গল্প অনেকবার বলেছ।

-আজ তোর লাল চাচার বাসায় খাওয়া দাওয়া হবে… বাবার কথা শেষ না হতেই মুন্নি বলে ওঠে

-যাও, তোমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে কুদ্দুসচাচ্চু, সাজুচাচ্চু, আজহার চাচ্চু আর বিদেশ থেকে শাহিনচাচ্চু, মাসুমচাচ্চু, আরো কে কে যেন আসবে না?
-হ্যাঁ মা ওরা সবাই এসেছে, দেখি আমাদের বাড়িতে একদিন খাবারের কথা কওয়া লাগবে।
-হ্যাঁ অবশ্যই বলবা, আজই বলে আসিও, মার হাতের রান্না চাচ্চুরা যা পছন্দ করে! আর চাচ্চুরা আসলে তো মা নিজের শ্রেষ্ঠ রান্নাটা করে।
-হ, এইটা ঠিক কইছিস, এদের বেলায় তোর মায়ের আর কোন আপত্তি থাকেনা, একেবারে হাস্যমুখে পঞ্চব্যঞ্জনে লেগে যায়,  শরীরের বিষ বেদনাও ফুরুত করি উড়ি যায় চড়ুই পাখির মতোন…
-ব্যস, হইছে এখন যাও মা শুনলে খবর আছে, তাছাড়া চাচ্চুরা ত অপেক্ষা করতেছে

-তাইলে আমি গেলাম রে মা… তা তোর কিছু লাগবে না?
-আবার ওই এক কথা!
-আচ্ছা আচ্ছা…

ক্লাসের বন্ধুরা যখন একটা বয়সে পৌঁছে যায়, তখন কি আর সবাই সেই আগের মত থাকে! সামাজিক অবস্থানে অনেকেই তাদের কুলীন অস্তিত্ব তৃণমূল বন্ধুদের সাথে মেশায়না। এখানে ব্যতিক্রম। জিলা স্কুলের একটা গ্রুপ তারা তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট রেখেছে এই বয়স পর্যন্ত। সামাজিক, পারিবারিক, ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সময় আর সুযোগ হলেই তারা একত্রিত হয় সারারাত বা সারাদিন ধরে চলে হুল্লোড় আড্ডা। আজ আড্ডা ও ভুরিভোজ হবে লালের ওখানে।

মুন্নির বাবা শহর ছেড়ে কোথাও যাননি। বন্ধুরা অনেকেই বিভিন্ন দেশে, শহরে চলে গেলেও এই লাল, মুন্নির বাবা, আরো ২ একজন নিজ শহরেই থেকে গেছে।
মুন্নির বাবা বলতে গেলে তেমন কিছু করেনা। চাকরি বাকরি করা তার ধাতে নেই, বিভিন্ন ব্যবসাপাতি করার নানা চেষ্টা করেছে কিন্তু সৎ এবং স্পষ্টভাষী মানুষের সেসব হবার কথা নয় হয়ও নাই। পিতা পিতামহ থেকে প্রাপ্ত এই বাড়িটা না থাকলে কিযে হতো! বাড়ির একটা পাশ ভাড়া দেয়া আছে, আর কিছু রিকশা ভাড়া দেয়া আছে আর আছে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে একটা ফটোকপির দোকান এসবের আয়ে কোন রকমে চলে যায় সংসার। মুন্নির মায়ের এসব নিয়ে কোন আপত্তি নাই তার দুঃখ অন্য জায়গায়। মুন্নির বাবা ফাঁস বেফাঁস রাজনীতির কারনে প্রায়ই জেলে যায়। জেল তার জন্য জলভাত। জেলে গেলে কষ্ট হয় একথা বলা বাহুল্য। ফি বছর দু/একবার করে সে ওই লালঘরে ঘুরে আসে। সেখান থেকে ফেরার পর অনেক সময় লাগে শরীর টা সেরে উঠতে। অল্প কিছুদিন আগেই সে জেলের বাইরে এসেছে…

সকল বন্ধুরা যখন একত্রিত হয়, নানা প্রসঙ্গ আসে আড্ডায়- রাজনীতি, দেশ, বিদেশ ইহকাল পরকাল সব নিয়ে কথা হয়। তখন কেউ না কেউ মুন্নির বাবার জেলের প্রসঙ্গ তুললে সে তার কষ্টের কথা বলব না বলব না করে আবার সব বলেও দেয়… সবাই তার গল্প শুনে, মুখ দেখে বোঝে খুব কষ্ট হয় জেলে। বন্ধুরা বহুবার বহু পরামর্শ দিয়েছে, এসব ছাড়তে বলেছে কিন্তু আসলে ওটাই সত্যি- “স্বভাব যায়না ম’লে”।

খাবার টেবিলে খাওয়া আর গল্প দুটোই চলছে,  কেউ একজন জিজ্ঞেশ করে-

-কিরে, এবারে জেলের দিন কেমন কাটল? একগাল হাসি হেসে উত্তর দেয় মুন্নির বাবা-

-কোন কষ্ট হয় নাই! সবার মুখ বিস্মিত, জেলে আবার কষ্ট হয় নাই, এ কেমন কথা! তাছাড়া ক্ষমতায় এখন বিপক্ষ দল, ধরে নিয়ে গিয়ে একেবারে নাকি ডলা দেয়। সমস্বরে প্রশ্ন ওঠে-

-কেন? কেন?
হাতে ধরা মোবাইলটা উপরে তুলে বন্ধুদের দেখিয়ে বলে, এইটার জন্য।
-তোরা তো এর আগে কতবার বলতি – একটা মোবাইল ফোন নে, আমি শুনিনি। এতদিন না নিয়া ভুল করছি রে…এবার ঐ, ঐখানে যাবার আগে এই ফোনটা নিছি…মুরগির রানের চামুচ ধরা হাতটা থামিয়ে একজন প্রশ্ন করে-

-জেলে মোবাইল ফোন নিতে দেয়?

-আরে টাকাটুকা দিলে, কি নিতে দেয় না! ঐযে কথায় আছে না- টাকায় করে কাম মদ্দের হয় নাম। এই বলে মুন্নির বাবা মিটমিট হাসতে থাকে। খাওয়ার শব্দ, থালা-বাটির আওয়াজ সব ছাপিয়ে,  আবার কোরাস-

– তারপর? তারপর?

-আরে তার আবার পর কি? এটা দিয়ে রোজ মুন্নির সাথে কথা কইছি, ভিডিও কলে মেয়েটার মুখটা দেখতে পাইছি, কানে ওর বাবা ডাকটা শুনতে পাইছি, মনে হচ্ছিল যেন মেয়েটা এই সামনেই আছে… সেজন্যে আর কিছু মনে হয় নাই। এরপর অনেকটা লাজুক গলায় নরম সুরে বলে-
-আরে, মেয়েটার ওই বাবা ডাকটা না শুনলে বুকের ভেতরটা খুব মোচড়ায় রে! একেবারে বিষফোঁড়ার মতো ব্যথা করে। আবার গলা তুলে একটু কেশে নিয়ে বলে – মুন্নির সাথে কথা হইছে, দেখা হইছে, ওর গলার স্বর শুনছি ব্যস আর অন্য কোন কষ্ট গায়েই লাগে নাই।

সমস্ত শব্দ থেমে গিয়ে যেন একটা নিরবতার শামিয়ানা  ঢেকে রাখে জায়গাটিকে।

টেবিলের সবাই মুখ নিচু করে খাবারে মনোনিবেশ করে। কি জানি কারো কারো চোখ হয়ত দূরে রেখে আসা এমন মুন্না-মুন্নিদের মুখ মনে করে সজল হয়ে ওঠে।

 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments