উৎসের ক্রমবিবর্তন ও বায়বীয় বিশ্বাস । দীন মোহাম্মদ মনির

  
    
কোন কিছু শুনতে না চাওয়া, কোন কিছু বুঝতেও না চাওয়া অনেকেরই একটি সাধারন প্রবণতা। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তো দূরের কথা। শুনতে ও বুঝতে না চাওয়ার এ ভয়ংকর সিদ্ধান্তটি বিশ্বাস নামক অদৃশ্য চেতনা কর্তৃক সর্বদাই সমর্থিত হয় এ ধারনা থেকে যে শুনলে পাপ আর বুঝলে মহাপাপ। কত ভাবনাইতো মনোজগতে উঁকি মারে। কৌতুহলী মন বলে কথা। কৌতুহলী মনের উঁকি মারা ভাবনাগুলিও বিশ্বাস চেতনার ছাকঁনীতে ছেঁকে ভাবনার উপযোগিতায় স্থান দেয়া হয়। ভাবনার মধ্যেও সীমারেখা ! সত্যের সন্ধান করাই যুক্তিসংগত। কারন, সত্যসংস্পর্শ তৃপ্তির, পরিশেষে শান্তির। কোন কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে সে ব্যাপারের ভিত্তি সমূহ নিরীক্ষণের প্রয়োজন। ভিত্তিহীন বলার পূর্বেও সতর্ক হওয়া দরকার। না জেনে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিষয়টি নিজেকে সমর্পণ করার মত, আর আত্মসমর্পণ বিষয়টি বিজয়ের নয়। মনোজগতের সর্বাংশ স্বচ্ছ না থাকলে পারিপার্শ্বিক মিথস্ক্রিয়ায় স্বীয় অন্তর্ভূক্তি হাজার মনোজগতকে কলুষিত করতে সক্ষম। তথ্য প্রদানে সতর্ক না হলে তার সুদূরপ্রসারী ভয়ংকর ফলাফল একসময় নিজের উপরেই পতিত হয়। তথ্য প্রদানের ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা একটি নির্দিষ্ট উৎসকে আদর্শ ধরে নেই। তারপর আমরা জোর গলায়, স্বীয় বিশ্বাসকে সংশ্লিষ্ট করে প্রচারে যারপরনাই স্বচেষ্ট থাকি। উৎসটির আদর্শ অবস্থার বিষয়ে যুক্তি-তর্ক, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সত্যতার যাচাই-বাছাই যেন অদৃশ্য এক মহাপাপ। রহস্যাবৃত অনেক কিছুই। রহস্যন্মোচনে ব্যর্থ হয়ে একটা কিছু মেনে নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণই বিশ্বাস। এ যুক্তিতে বিশ্বাস ও আত্মসমর্পন সমার্থক। বিশ্বাসে মুক্তি লাভ হয়। সে মুক্তি হলো সত্য উদঘাটনের জটিল পরিস্থিতি বা প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি এবং অযথা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে মুক্তি। বিশ্বাসের রাস্তাটি সহজ এবং সাধারন তবে অনিশ্চিত। আত্মসমর্পন ব্যাপারটিও মুক্তির। নিজেকে ক্ষমতার হাতে সমর্পন করার মাধ্যমে তুলনামূলক সহজ অথচ পরাধীন হলেও জীবননাশের হাত থেকে মুক্তি। জীবনতো রক্ষা হলো। রক্ষিত হওয়ার এরূপ চেষ্টা হজার বছর ধরে প্রায় সকলেই করে চলেছে। ফলে, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মত গৌরবময় অবস্থানে কেউ-ই পৌঁছাতে পারছে না। সুতরাং এক জীবদ্দশায় দেহাবসান একবার হলেও আত্মার মৃত্যু হয় হাজার বার।
যে উৎসকে বিশ্বাসের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, সে উৎসের আবির্ভাব, প্রসার ও সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্নহীন থেকে নির্দ্ধিধায় মেনে নেয়াটাকে নিরাপদ মনে করা হয়। কারন, উৎসটিকে রহস্যময় ও অজানা এক কল্পিত মহাশক্তি দ্বারা অনুবিদ্ধ বা গ্রথিত করা হয়েছে। সমাজে, গোত্রে, রাষ্ট্রে আধিপত্য স্থাপনের জন্য শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। যে শক্তি দৃশ্যত বিদ্যমান, যে শক্তি অন্য দশজন চাইলে অর্জন করতে পারে— সে সমস্ত শক্তি ব্যতীত অন্য কোন অদৃশ্য মহাশক্তি যার রহস্য উন্মোচনযোগ্য নয়, তাকে কোন ভাবে স্বীয়সত্তায় সংশ্লিষ্ট করতে পারলে আধিপত্য স্থাপন অতঃপর মহাপুরুষ হওয়া সহজ হয়ে যায়। মূল শক্তির উৎস যেহেতু রহস্যাবৃত ও অদৃশ্য, সেটিকে মহাশক্তিশালী প্রমানের চেষ্টার মধ্যেই স্বীয় অবস্থানের ভিত্তিটিকে স্থায়ী করা সম্ভব। জীবনসংশ্লিষ্ট ভাল কাজগুলি সম্পর্কে সবাই অবগত। এগুলি মোটামুটি ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে একই রকম। মহাশক্তির সাথে আরো কিছুর অন্তর্ভূক্তি যা কিনা নিঃসন্দেহে মানবকল্যাণকর তা সামগ্রিক ব্যবস্থা বা উদ্দেশ্যটিকে আরো মজবুত করে। যে সমস্ত ব্যাপারে সন্দেহ একেবারেই অনুপস্থিত, সে সমস্তের সাথে কিছু ভেজাল যুক্ত করে ভেজালকে খাঁটি বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায়; উপরন্তু, এক পর্যায়ে এটিও প্রতিষ্ঠা সম্ভব যে, সর্বকালের পরম খাঁটি বিষয়গুলি প্রতিষ্ঠিত খাঁটি বিষয়গুলিরই উপজাত।
যুগে যুগে বিশ্বাসীগন তথ্যসমূহ বহন ও প্রচার কাজে সদাতৎপর। কারন, এতেই মুক্তি, এতেই বর্ণিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। প্রজন্মকে একই বিশ্বাসে গড়ে তোলা যেন জীবনের একমাত্র ও প্রধানতম পূন্য বা কর্তব্য। অতঃপর, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, লক্ষ্য ও ভীতি নির্দ্ধিধায় প্রজন্মের হৃদয়ে গেঁথে দেয়া হচ্ছে। তথ্য প্রচারে তার কিছুটা বিকৃতি ঘটছে। ব্যক্তিগত আবেগ, উচ্ছ্বাস ও প্রতিক্রিয়ার সংমিশ্রনে কাহিনীরূপ তথ্য সময়ের সাথে সাথে কিছুটা মূল অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে। এ পরিবর্তন এতই ধীরগতিসম্পন্ন যে কয়েকটি প্রজন্ম তা উপলব্ধি করতেও ব্যর্থ হয়। উদাহরণ স্বরূপ, যারা রবীন্দ্রভক্ত তারা রবীন্দ্র  দর্শনে এতটাই সিক্ত যে তারা মনে করেন এ জাতীয় দর্শন অর্জন কেবল অলৌকিক ভাবেই সম্ভব। একসহস্র বছর পর এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে রবীন্দ্রনাথ মহাপুরুষ ছিলেন এবং তার গীতাঞ্জলী এক অলৌকিক প্রাপ্তি, অতঃপর তার কৃতকর্মের সবটুকুই এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হবে।
সহস্রবছর পূর্বের প্রত্যক্ষদর্শী পুরুষদের কেউই তখন আর প্রমান নিয়ে হাজির হবেন না। ইতিহাস বিবর্তনের এ ধারাটি বোধ হয় ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসবিশ্লেষকদের অজানা নয়।
তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস অতঃপর তার চর্চার মাধ্যমে শান্তি খুঁজে পাওয়ার বিষয়টিকে মন্দ তখন পর্যন্ত বলা ঠিক হবে না যতক্ষন পর্যন্ত ঐ বিশ্বাসের বিশ্বাসীগন অন্য রকম বিশ্বাসীদের ঘৃনা করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বিশ্বাসের পার্থক্যে মানুষে মানুষে পার্থক্য করার এই প্রবনতা দূর করার লক্ষ্যেই বিশ্বাসকে যুক্তিহীন ও অবাস্তব প্রমান করার প্রয়াশ যুক্তিযুক্ত। এ ব্যাপারটি অনেক সংবেদনশীল। বিশ্বাসের প্রভাব এতটাই প্রবল যে এর কারনে মানুষ একপেশে ও যুক্তিহীন প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়, পরিশেষে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে যাচ্ছেতাই করতে পারে। এ প্রসঙ্গে মিথ বা লোককথা নিয়ে একটু বিশ্লেষন করা যাক। হাজার বছর ধরে যে কাহিনী, কল্পকাহিনী, ঘটনা, বিশ্বাস ইত্যাদি লোকমুখে বাহিত হয় এবং যার সত্যতার সুনির্দিষ্ট কোন প্রমান নেই তা-ই মিথ বা লোককথা অথবা লোকগাঁথা। এসবকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অপ্রয়োজনীয় মনে করছি না। মানবের অস্তিত্বের সাথে এসব মিথলজিক্যাল সংস্কৃতির সম্পর্কটি সরাসরি যুক্ত।
এসব লোককথা মানুষের রক্তের সাথে বহমান যা কাহিনীরূপে অভিজ্ঞতা, দর্শন, হিতোপদেশ ও অন্যান্য জীবনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি বর্ণনা করে। কোন প্রাণীর ক্ষতি না করা, কাউকে সন্মান করা, অপেক্ষাকৃত দুর্বলের প্রতি সদয় থাকা, সদা বিনয়ী থাকা, অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়া
ইত্যাদি দলমত নির্বিশেষে সার্বজনীন গ্রহনযোগ্য উপদেশ যা কালান্তরে একই রূপে মানব সংস্কৃতি হিসাবে বিদ্যমান। তবে এসব প্রকাশের রীতিরূপ কেমন হবে সেটি মূখ্য নয়। উদাহরণ স্বরূপ, সন্মান প্রদর্শনের জন্য গোষ্ঠির চলমান রীতিটি কি, তা মূখ্য নয়; বরং, উপযুক্ত সন্মানটি করা হচ্ছে কি না, সেটিই মূখ্য। রীতিনীতি বা সংস্কৃতিকে ধারন-পালন করা আত্মতৃপ্তির। এটি যদি ধর্মীয় সংস্কৃতি হয়, ক্ষতি নেই। তবে, এটিকে সংস্কৃতিরূপে ধারন করাই যৌক্তিক। অন্যান্য মিথ-এর মত ধর্মীয় ভিত্তি গুলিও একপ্রকার মিথ বা লোককথা। সংস্কৃতি সত্য-মিথ্যার মানদন্ডে গ্রহন বা বর্জনের বিষয় নয়। এটি অভ্যস্ততা এবং এটি চলমান। শুধুমাত্র ক্ষতিকর সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতিই বর্জনীয়। ধর্মীয় রীতিনীতি যেহেতু শুধুই সংস্কৃতি হিসাবে বিবেচ্য সেহেতু ধর্মীয় অপসংস্কৃতিও অবশ্য বর্জনীয়। সংস্কৃতির সাথে বিশ্বাস তথা অন্ধবিশ্বাসের পার্থক্য হলো- ভাললাগার সাথে সংস্কৃতির যোগাযোগ, অপরদিকে বিশ্বাসের সংস্কৃতির মূলে সর্বদাই লোভ, ভীতি, অনিশ্চয়তা ও অজ্ঞতা বিদ্যমান। অন্যভাবে বলা যায়, সংস্কৃতিকে সাহসী ও প্রগতিশীল মানুষ বহন করে আর বিশ্বাস মানুষকে পরিচালিত করে। সুতরাং স্বীয় নিয়ন্ত্রনহীনতা শুধুই বিশ্বাসের ফসল যা মানুষ তৈরীর সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মানুষ তৈরীতে সবাই ব্যস্ত, অথচ মানুষ তৈরীর জন্য নিরপেক্ষতা, স্বাধীন চিন্তার শক্তি ও জীবনবোধের মত অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো শুরুতেই কেরে নেয়া হচ্ছে। বিষয়টি এরকম যে ব্যক্তি তার নিজস্ব দুর্বলতা সমূহ প্রজন্মে বিষের মত ছড়িয়ে দিচ্ছে নিঃসংকোচে ও নির্লজ্জ ভাবে। উদ্ধৃতি এমন ভাবেই দিচ্ছি যেন তা ধ্রুব সত্য, অসত্য সন্দেহ প্রকাশ পেলেই চরম অবমাননা ও শাস্তি।
গোষ্ঠিভেদে বুদ্ধিমান ও যৌক্তিক মানুষ কমবেশি আছেই। একই বিষয়ের উপর যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে বিভিন্ন সত্য বিরাজমান সেখানে নিরপেক্ষ মনে সত্য ঠিক করা কঠিন নিঃসন্দেহে। উৎসের সত্যতা ও মাহাত্ম্য সকলেই যার যার বিশ্বাসে থেকে জোর গলায় বলতেই পারে; তাই বলে একটি নির্দিষ্ট প্রভাববলয়ে অবস্থান করে প্রভাবিত মানষিকতায় তন্মধ্যে একটিকে সত্য বলে মেনে নেয়া ধ্রুব সত্যকে পাওয়া নয়। বাবাকে ভালবাসা প্রাকৃতিক সত্য, কিন্তু তার ধারনাকে বিনা যুক্তিতে অন্ধ অনুকরণ করা ভালবাসার বহিপ্রকাশ হতে পারে না। ভালবাসা নিষ্কলঙ্ক  বলে এর সাথে অন্যায়ের সংমিশ্রন এটিকে কলঙ্কিত করে। বাবাদেরও ভুল হতে পারে; কারন, এক বাবার বিশ্বাসকে সত্য বললে অপর বাবার একই বিষয়ের উপর ভিন্ন সত্যকে মিথ্যা বলতেই হবে।এটি সহজ যুক্তি যে একই বিষয়ে দুটি ভিন্ন সত্যের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। যে কোন একটি অবশ্যই মিথ্যা। আর যেহেতু কোনটি মিথ্যা তা সুনির্দিষ্ট নয়, সেহেতু একটিকেও সত্য বলা যুক্তিযুক্ত নয়। বিশ্বাসের বিশ্বাসটুকুই সত্য। উগ্র ও বিক্ষুব্ধ হয়ে জোরপূর্বক বিশ্বাসের মূলটিকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে যারপরনাই অত্যাচারী হলে তাদের কপালে মৌলবাদী উপাধিতো জুটবেই। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের সন্তানদের মৌলবাদী রূপে দেখতে চাই না।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments