COVID-19 গত বছর ডিসেম্বরে চীনে প্রথম ধরা পড়ে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই WHO এটাকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা দেয়। সোশাল মিডিয়াতে এর মহামারি নিয়ে শুরু হয় নানা তথ্য আদান প্রদান। আমরা হয়ে উঠি আতঙ্কিত। কি করব কি করবনা এসব নিয়ে শুরু হয় নানান জল্পনা কল্পনা। যার অধিকাংশই যা ঘটেনি তার উপর ভিত্তি করে যেমন কি হতে পারে কতজন মারা যেতে পারে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এসব করতে করতে আমরা পার করছি বর্তমান পরিস্থিতি।
বাস্তব সত্য হচ্ছে- করোনাভাইরাসে যারা আক্রান্ত হন, তাদের ৮১ শতাংশ কেসই মাইল্ড, যেটার জন্যে হাসপাতালে যাওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয় না। ১৪ শতাংশ যারা অসুস্থ হন, তাদেরকে হাসপাতালে নিতে হয়। বাকি ৫ শতাংশ ক্রিটিকাল। যাদের ইনটেনসিভ কেয়ারে নিতে হয় এবং অক্সিজেন সাপোর্ট দরকার হয়। এটা হচ্ছে নিউইয়র্ক টাইমসের ১৮ই মার্চের রিপোর্ট।
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২৯শে মার্চ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত হয়েছে ৬৫২০৭৯ জন মানুষ। মারা গেছেন ৩০,৩১৩ জন। রিকভার করেছেন ১,৩৯,৪৪১ জন।
আমরা এবার বড় বড় দেশ গুলির দিকে একটু দেখি (লেটেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যা কিছু কম বেশি হতে পারে)
করোনায় যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮,৭৬৩ জন। মারা গেছে ২৫৮ জন।বৃটেনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯৮৩ জন। মারা গেছেন ১৭৭ জন।ফ্রান্সে আক্রান্ত হয়েছেন ১২,৬১৫ জন, মারা গেছেন ৪৫০ জন।ইটালিতে মারা গেছেন ৪০৩২ জন।আজকের এবিসি নিউজ আপডেট অনুযায়ী অস্ট্রলিয়াতে মোট আক্রান্ত ৩৯৩১জন, মারা গেছেন ১৬ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ২২৬ জন।
যেই রোগের ৮১ শতাংশ মানুষের হাসপাতালেও যাবার প্রয়োজন হয় না; বা ৮১ শতাংশ মাইল্ড, সেটাকে আমরা সর্দি-কাশি-জ্বর মানে ফ্লু বলতে পারি কি?
আমি বলছিনা করোনা নিয়ে আমাদের চিন্তার কিছু নাই তবে এর ভয়াবহতা নিয়ে আমরা যা করছি সেটা কতটা মিডিয়া সৃষ্ট সামাজিক বিশৃঙ্খলা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আমরা কি জানি যে প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় কত লোক মারা যায়? যা মিডিয়াতে আসে না। আমরা আতংকিতও হই না।
চলেন আমরা একটু দেখে আসি সাধারণ ফ্লু বনাম করোনা ভাইরাস এর তুলনামুলক পরিস্থিতি।
ইউ এস এ/ যুক্তরাষ্ট্রঃ
Center for Disease Control and Prevention এর ওয়েবসাইট থেকে নেয়া রিপোর্ট অনুযায়ীঃ
২০১৬-১৭ সালে মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে পাঁচ লক্ষ জনকে, মারা গেছে ৩৮ হাজার।
২০১৭-১৮-তে আক্রান্ত হন সাড়ে চার কোটি আমেরিকান। হাসপাতালে ভর্তি আট লক্ষ ১০ হাজার। মৃত্যু ৬১ হাজার।
২০১৮-১৯-এ আক্রান্ত হন সাড়ে তিন কোটি আমেরিকান। হাসপাতালে ভর্তি চার লক্ষ ৯০ হাজার ৬০০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩৪ হাজার ২০০
তাহলে উপরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা যদি দেখি তবে গত তিন বছরের তুলনায় করোনার মৃত্যুর হার উল্লেখ করার মতন কিছু না । কারন আমরা আগেই দেখেছি এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে সারা পৃথিবীতে ৬৫২০৭৯জন মানুষ। মারা গেছেন ৩০,৩১৩ জন। রিকভার করেছেন ১,৩৯,৪৪১ জন।
যুক্তরাষ্ট্র / গ্রেট ব্রিটেনঃ
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর ইংল্যান্ডে ১৭ হাজার মানুষ সিজনাল ফ্লু-তে মারা যায়। ২০১৪ সালে ২৮ হাজার ৩৩০ জন মারা গেছেন। আর এ বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯৮৩ জন, মারা গেছেন ১৭৭ জন। (২১শে মার্চ দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট ২০২০ এর রিপোর্ট)।
এখানেও দেখা যাচ্ছে যে সাধারণ ফ্লু-তেও করোনার চেয়ে প্রত্যেক বছর কত বেশি পরিমাণে মানুষ মারা যাচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে ইটালিতে করোনায় মৃত্যু হ্যাঁর কেন এত বেশি?
কারণ ইতালিতে বয়স্ক লোকদের সংখ্যা হচ্ছে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম।আর ইতালিতে সিজনাল ফ্লু সবসময়ই বেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া তাছাড়া যাদের ক্যান্সার আছে , লিভারের প্রবলেম আছে, কিডনির প্রবলেম আছে, ডায়াবেটিস, হার্টের প্রবলেম আছে অর্থাৎ আগে থেকে যারা রোগগ্রস্ত এবং বয়স্ক তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। তবে সেটা শুধু করোনা ভাইরাস না, নরমাল ফ্লুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ইটালি এবং স্পেনের পরে ফ্রান্সের অবস্থা সবচেয়ে মারাত্মক। ফ্রান্সে করোনায় মারা গেছেন এ পর্যন্ত ৪৫০ জন, আক্রান্ত ১২,৬১২ জন।ফ্রান্সে প্রতিবছর ফ্লু-তে আক্রান্ত হন ২০ লাখ থেকে ৬০ লাখ মানুষ।২০১৬-১৭ সালে শীতকালীন ফ্লুতে মারা যান ১৪ হাজার ৪০০ জন। ২০১৭-১৮ সালে ১৩ হাজার জন এবং গত বছর ৯ হাজার ফরাসি ফ্লুতে মারা গেছেন।
ভারতঃ
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সোয়াইন ফ্লু-কে ‘নরমাল ফ্লু’ বা ‘সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা’ হিসেবে ক্লাসিফাই করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ভারতে সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত হন ৩৮,৮১১ জন। মারা গেছেন ২২৭০ জন। ১৮ তে আক্রান্ত হন ১৫,২৬৬। মারা গেছেন ১২১৮ জন।এবং ১৯ সালে আক্রান্ত হন ২৮,৭৯৮। মারা গেছেন ১১৮২ জন। আর এবছর (২০২০) জানুয়ারি থেকে পহেলা মার্চ পর্যন্ত দুই মাসে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৬৯ জন, মারা গেছেন ২৮ জন। আর ২১ মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৭১ জন এবং মারা গেছেন তিনজন।
সোয়াইন ফ্লুতে এতজন মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভারত কিন্তু নিউজ করেনি। অথচ সোয়াইন ফ্লুতে মৃত্যুর হার করোনায় মৃত্যুর হারের চেয়ে ৯ গুন বেশি।
মিডিয়ার প্রচার প্রচারণা এবং অথেন্টিসিটি
মিডিয়াতে অনেক কিছু অনেকভাবে প্রচার প্রচারনা হয়ে থাকে। কোন নিউজটা কিভাবে প্রেজেন্ট করা হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটা যারা নিউজ করেন তারা কখনো বুঝে কিংবা না বুঝেই সেটা প্রচার করে থাকেন। টেকনোলজির এই যুগে প্রচার হয়ে অনেক কিছু তবে সেটার অথেন্টিসিটি কতটা সেটা আমরা খুব কম মানুষই বুঝি। আমি বলছি না যে নিউজ দেখবার দরকার নাই। কিংবা সব কিছু ভুয়া। তবে যে কোন নিউজ দেখে সেটার অথেন্টিসিটি যাচাই বাঁচাই করা আমাদের কর্তব্য।
তাইওয়ানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এই দেশটি একসময় চীনের অংশ ছিল। নিউজ হয়েছিল যে চিনের পর যে দেশ বেশি আক্রান্ত হবে সেটা হল তাইওয়ান। কারণ তারা দেখতে শুনতে একরকম। খাওয়াদাওয়া একরকম। এর পর অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়া গুজব ছড়ায় যে, দক্ষিণ তাইওয়ানে ট্রাকে ট্রাকে লাশ চুল্লিতে নিয়ে গিয়ে পোড়ানো হচ্ছে।
সে দেশের সরকার খুব দ্রুত গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল।গুজব ঠেকানোর জন্যে তাইওয়ানে টিভি এবং রেডিও- মিডিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং করোনাভাইরাস কীভাবে ছড়ায়, সংক্রমণ ঠেকানোর উপায় কী-এটা তারা খুব ইতিবাচকভাবে প্রচার করে।ফলে মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে আশ্বস্ত হয় এবং সময়মতো প্র্যাকটিকেল পদক্ষেপ তারা নিয়েছে।
যেখানে মনে করা হচ্ছিল যে- চীনের পরে তাইওয়ানে হবে সবচেয়ে বড় ডিজাস্টার। অথচ সেখানে ২১শে মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৭৭ জন। মারা গেছেন ১ জন।
COVID-19 প্রতিরোধে আমাদের কিছু করবার নাই?
আসলে করোনা প্রতিরোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন বিকল্প নাই আমরা যদি শুধুমাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত যে শুদ্ধাচার সেটা অনুসরণ করি এবং একটু সচেতন হই এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি তাহলে এই ভাইরাস কেন সবসময় সব ধরনের রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারব।
ডক্টররা যেভাবে বলছেন বলছেন, সরকারি ভাবে যা বলা হচ্ছে যেমন হাতটাকে ভালোভাবে ধোয়া এবং কারো হাঁচি-কাশি বা এই জাতীয় কোনোকিছু দেখলে তার থেকে দুই ফিট/তিন ফিট দূরত্ব মেইনটেইন করা। তার বডি-টাচের মধ্যে না যাওয়া। কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রয়োজনে সেলফ আইসলেশনে যাওয়া এগুলি অনুসরণ করা আর সাবধান থাকা এর বেশি কিছু আসলে দরকার নাই।
আর আমরা বাঙ্গালিরা আসলে ন্যচারালভাবেই স্ট্রং ইমিউনিটির অধিকারী। কাজেই আমাদের এই ইম্মিউনিটিকে বুস্ট আপ করতে হবে তাহলেই আমরা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারব।
কোয়ারেন্টাইন মানে কি জীবন থেমে যাওয়া ?
বলা যায় কোয়ারেন্টাইন এর ধারণার মুল প্রবর্তক রাসুল (স)। রসুলুল্লাহ (স) হচ্ছেন কোয়ারেন্টাইনের পথ প্রদর্শক। রসুলুল্লাহ (স) এর নির্দেশ ছিল যে- যখন কোনো এলাকায় কোনো মহামারী ছড়ায়, ছোঁয়াচে রোগ ছড়ায় সেখানে কেউ যাবেও না, সেখান থেকে কেউ বেরও হয়ে আসবে না।পাশ্চাত্যের কোয়ারেন্টাইনের ধারণা আসে এরও ৭০০ বছর পর!
রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিরিয়াতে প্লেগ দেখা দিয়েছিল। যে শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছিল সেখানে আবু উবায়দা তখন কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। হযরত উমর তাকে ওখান থেকে ডেকে পাঠালেন যে ওখানে থাকলে তো সে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আবু উবায়দা খুব বিনয়ের সাথে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে তিনি রসুলুল্লাহ (স) এর হাদিস স্পষ্টভাবেই শুনেছেন যে, “যদি আক্রান্ত হয়, আক্রান্ত এলাকায় কেউ প্রবেশ করবে না এবং আক্রান্ত এলাকায় যে থাকবে সে ওখান থেকে বেরিয়েও আসবে না।” তিনি প্রথম কোয়ারেন্টাইন পালনকারী সাহাবী এবং তার সাথে যে সৈন্যদল ছিল কেউই ওখান থেকে বেরিয়ে আসে নাই।
তাহলে রসুলুল্লাহ (স) যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেটা পালন করা, অনুসরণ করা আমাদের জন্য অবশ্যই সওয়াবের এবং উপকারি! তাই আমরা যারা কোয়ারেন্টাইনে থাকছি তারা এই সময়টাকে মনে করতে পারি যে আমরা আল্লাহর রসুলের একটা নির্দেশ পালন করার সুযোগ পাচ্ছি, আমরা কত সৌভাগ্যবান এবং সে আনন্দ নিয়েই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারি।
তাছাড়া এর সময়টাকে আমরা চমৎকার ভাবে আত্মিত মানসিক উপলব্ধির সোপান হিসেবে কাজে লাগাতে পারি। আমরা যদি এই সময়টা নিজের মতো করে, নিজের আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্যে, নিজের মনের পরিশুদ্ধির জন্যে, মননের পরিশুদ্ধির জন্যে, সৃজনশীলতার পরিশুদ্ধির জন্যে এবং ব্রেনটাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্যে ব্যয় করতে পারি।এই সময়ে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে প্রাণায়ামের চর্চা করা, মেডিটেশনের চর্চা করা এবং আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের সান্নিধ্য চাওয়া।
যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী রয়েছেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী রয়েছেন- ঐসময়ও তারা তাদের একাগ্র নিমগ্ন প্রার্থনায় ডুবে গিয়ে একটা নতুন মাত্রা নিয়ে আসতে পারেন।
পরিশেসে বলি আমরা অবশ্যই সরকারি দিক নির্দেশনা মেনে চলব, নিজের এবং অন্যের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করব কিন্তু প্যানিকড হওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখব। আল্লাহ না করুন যদি আমাদের পরিচিত পরিজন করোনায় আক্রান্ত হন তাদের পাশে আমরা দাঁড়াতে চেষ্টা করব। মনে মনে কিং কোথায় কাজে সব কিছুতে পজেটিভ থাকব। ইনশাল্লাহ আমরা সবাই ভালো থাকব।
সূত্রঃ অনলাইন তথ্য এবং করোনা সম্পর্কিত কিছু নিবন্ধ।
তানজিলা মিম : কাউন্সিলর, মালটি লিঙ্গুয়াল ক্যাফে কনভেনর, কোয়ান্টাম মেডিটেশন সোসাইটি মেলবোর্ন এফিলিয়েশন অফ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়া। ইমেল: proshantika@gmail.com