বিদায় মাসুদ রানা । সাকিনা আক্তার

  
    

কাজী আনোয়ার হোসেন (১৯ জুলাই ১৯৩৬ – ১৯ জানুয়ারি ২০২২) বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী, প্রবাদ পুরুষ; আজ এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন অন্য ভুবনে।
এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে কাজীদার সৃষ্ট “তিন গোয়েন্দা” বইয়ের মত ভূত-থেকে-ভূতে ছড়িয়ে পড়েছে উনি আর আমাদের মাঝে নেই। কি অবিশ্বাস্য!

এই গুণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন একজন বাংলাদেশি লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় মাসুদ রানা ধারাবাহিকের স্রষ্টা। তাঁর বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন এবং মা সাজেদা খাতুন।
সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসেবে জন্ম দিয়েছেন অগণিত ভক্ত পাঠকের, বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন এক বিশাল সংখ্যক পাঠকদের। ষাটের দশকের যুগান্তরকারী সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র মাসুদ রানা হয়ে ওঠে পাঠকের মনে এক বাস্তব নায়ক চরিত্র।

পাশাপাশি কুয়াশা চরিত্রটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রায় ৭৬টির মতো কাহিনী রচনা করেছেন যা বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য আজীবন ইতিহাস হয়ে রইবে।
রহস্যপত্রিকা ছিল আমার জন্য এক বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়াও কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব নাম ব্যবহার করতেন।

পারিবারিক কারণে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন ছিলেন উনার সহধর্মিনী। আমাদের দেশ ওনাদের কাছে চিরঋণী, চির কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের এবং সাহিত্যে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য। ছোটবেলায় এই বাসায় বেড়াতে যাওয়া ছিল স্বপ্নপুরী ঘুরে আসার মত। একইসাথে শুনতে পেতাম কিংবদন্তি শিল্পীর কন্ঠে হৃদয় কাড়া গান।
অন্যদিকে বই ঘর!

সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনীর অফিস ঘরে শেষবার দেখেছিলাম কাজী আনোয়ার হোসেনকে মনে পড়ছে খুব স্পষ্ট। হাতে একটা গিটার নিয়ে টুংটাং বাজাচ্ছিলেন নিজের পড়ার চেয়ারে বসে টেবিলের সামনে। রাজপুত্রের মত দেখাচ্ছিলো তখনও ওই বয়সেও। মুখের কোনে মিষ্টি হাসি, চিকচিকে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি। আমি আমার বাবার সাথে গিয়েছিলাম। বললেন বেশি বেশি বই পড়বে। যা কিছু ইচ্ছে হয় নিয়ে যাও সাথে করে। প্রকাশনা ঘরে গিয়ে আমার মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। এত বই! অমন ঐশ্বরিক আনন্দ জীবনে খুবই কম হয়েছে! ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম বইগুলো এবং অগণিত বই দুই হাতে যতখানি ধরে বিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। যতগুলো বই আমি ধারণ করছিলাম দুই হাতে, অত বড় হাসিও আমি হাসতে শিখিনি আজও পর্যন্ত!

আমাদের বাড়িতে একটা লাইব্রেরী গড়ে উঠেছিল শুধুমাত্র কাজীদার দেয়া সেবা প্রকাশনীর বই গুলো দিয়ে। আমি আমার বাবা, মার কাছে কৃতজ্ঞ সেই ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আমাদের আকর্ষণ তৈরি করে দেবার জন্য। জীবনের যত ঝড় ঝাপটা এসেছে কখনো নিজেকে একা মনে হয়নি কারণ বই এবং সংগীত বন্ধু হয়ে আছে অন্তরে।
কাজীদার খুব শখ ছিল মাছ ধরা। ধানমন্ডি লেকে উনি প্রায়ই মাছ ধরতে যেতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ধীর স্থির চিত্তে উপভোগ করতেন এই মাছ ধরা। একটা মানুষের পক্ষে যতখানি সংস্কৃত মনা হওয়া সম্ভব, উনি সেই সীমা পার করেছিলেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

আজকে সারাদিন মেঘলা ছিল। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। গোধূলির তারা দেখা হয়নি মেঘে ঢেকেছিল! মন কেমন কেমন করছিল!
যখন শুনতে পেলাম প্রাণের কাছের একজন মানুষ হারিয়ে গেছেন দূর আকাশে, অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে ছুঁয়ে গেল আমার চিবুক!
শেষ বার দেখা হয়েছিল কোন এক সন্ধ্যায়ই ! অস্পষ্ট এক করুন সুর আমার মনের গহীনে বেজে চলেছে প্রচন্ড চাপা কষ্টে ;
আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে–
জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা !

তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি।

সাকিনা আক্তার
সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments