আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের বোল্ডার শহর, একটি পার্বত্য অঞ্চল। পৃথিবীর বিখ্যাত রকি পর্বতমালা এরাজ্যেই অবস্থিত।
রৌদ্রজ্জ্বল এক শান্ত সকালে, আমাদের চারজনের ছোট্ট দলটি বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্য– মেসা ভার্দে ন্যাশনাল পার্ক। এই পার্কটি বোল্ডার শহর থেকে প্রায় ৭২৫কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। পথে যেতে যেতে রকি পর্বতমালার রূপ আমাকে বিমহিত করলো। পাথুরে পাহাড়েরও যে এত বিচিত্র সব রঙ হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেসা ভার্দে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরা সেদিন আর পার্কে না গিয়ে রাতটা হোটেলেই বিশ্রাম নিলাম। পরদিন সকাল সকাল পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
মেসা ভার্দে একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ সবুজ টেবিল। এমন নামের কারণ হলো, পর্বতটি আসলে একটি মালভূমি। দূর থেকে পর্বতটিকে ঠিক একটি টেবিলের মতই দেখায়। সমতল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৬,৯৫৪ ফুট থেকে ৮,৫৭২ ফুট। গাড়িতে করে ২১ মাইল পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠার পর এর চুড়ায় এসে থামলাম। এই পাহাড়টি ঘুরে দেখার জন্য গাইডের সাথে সাথে তিন ধরনের ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। আমাদের গাইড মাইকেল জানালো ব্যালকনি হাউস নামে একটি ট্যুর আছে, যেটি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। আমরা সেটাই বেঁছে নিলাম। যেতে যেতে জানতে পারলাম এই মালভূমির অতীত ইতিহাস।
প্রায় ১,৪২০ বছর আগে আমেরিকার এক আদিবাসী জাতি এখানে বসতি স্থাপন করে । প্রত্নতত্ত্ববিদরা যাদের নাম দিয়েছেন ‘Anashazi’। তবে বর্তমানে এই জাতিকে ‘Ancestral Peubloans’ বলে অভিহিত করা হয়। ওদের বসতির বয়সকাল ছিল ৭০০ বছর। মালভূমির খাড়া গা কেটে ওরা বাড়িঘর তৈরি বসবাস করতো। ওদের মূল পেশা ছিল চাষাবাদ। আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এই জাতি হঠাৎ করেই এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। ওদের আর কোনো চিহ্ন পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি। এমনকি ওদের কোনো সমাধির সন্ধানও কেউ দিতে পারেনি। যে কারনে ওদের সম্বন্ধে যা কিছু জানা যায় তা তাদের বাড়িঘর দেখে অনুমানের ভিত্তিতেই বলা হয়। এসব শুনে ওদের স্মৃতিচিহ্ন দেখার আগ্রহ বেড়ে গেল, বহুগুণ।
প্রথমে আমরা মালভূমির মেঠো সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা নিচে নামলাম। এরপর একটি সরু পথ ধরে হেঁটে যেতেই পেলাম একটি ১০-১২ ফুট মই। যা মালভূমির গা বেয়ে নিচে নেমে গেছে। সেই মই বেয়েই আমাদের নামতে হবে। প্রথমে ভয়ে গা শিরশির করছিল, পাও কিছুটা কাঁপছিল। একটু এদিক ওদিক হলেই কয়েক হাজার ফুট নিচের খাদে নিজেকে আবিস্কার করতে হবে। যদিও নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছিল। আমাদের গাইড মাইকেল, বেশ মজার লোক। মজার মজার ভয় দেখিয়ে আমাদের প্রচুর হাসাচ্ছিল। এতে করে আমাদের ভয় সহজেই দূর হয়ে গেল।
ব্যালকনি হাউস নামকরণের কারণ হল, এটাই একমাত্র বাসা যেখানে একটা বিশাল বারান্দা আছে। আমরা মই বেঁয়ে সরাসরি এই হাউসের একটি ঘরে প্রবেশ করলাম। এখানে ঘরের সংখ্যা ৭০-৮০টি। ওদের ঘরগুলি অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে তৈরি। যা সেই জাতির শুধুমাত্র বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ই বহন করে না, ওরা যে কতখানি শৈল্পিক মানসিকতার ছিল সেটাও অনুমান করা যায়। পাথর কেটে ইট বানানো হয়েছে। সেই ইট কাদামাটি ও পানি দিয়ে গেঁথে গেঁথে ঘরের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। দেয়ালে আবার কারুকাজও করা হয়েছে। বাইরের দিকের ঘরগুলিতে দরজা–জানালা আছে। আর ভেতরের ঘরগুলিতে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা আছে। একটা ঘর কাঠের পাটাতন দিয়ে মাচার মত করে তৈরি করা। এটা নাকি ওদের লিভিং রুম,ছিল, যার নাম ‘পিট হাউস’। আরেকটা ঘর খুব বিচিত্র আকারের! যেন একটা বিশাল চাবি। এই ঘরটাকে ঘিরেই অন্য ঘরগুলির অবস্থান। এই বিশেষ ঘরটা ছিল ওদের উপাসনালয়, যাকে বলে ‘কিভা’, মানে হল চাবি। অন্যান্য ঘরগুলি থেকে একটু নীচুতে গর্ত করে এটি তৈরি করা হয়েছে। ঘরটির মাঝে একটি গোল গর্ত, যার নাম ‘সিপাপু’। যেখানে আগুন জ্বালিয়ে আদিবাসীরা প্রার্থনা করতো। ধারণা করা হয়, আদিবাসীদের ধারণা ছিল যে, এই গর্তের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে যাওয়া সম্ভব। ওদের রান্নাঘরও দেখা গেল। ওখানে হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে শীলপাটাও আছে। সেটা দেখতে একেবারেই আমাদের ব্যবহৃত শীলপাটার মতই। আদিবাসীদের ঘরবাড়ি যতই দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
এরপর আমরা একটি ঘুটঘুটে অন্ধকার সুড়ঙ্গ হামাগুড়ি দিয়ে পার হয়ে আকাঙ্ক্ষিত সেই বারান্দায় এসে পৌছালাম। ভারী রেলিং ঘেরা সেই বারান্দা। নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম কতোটা উপরে দাঁড়িয়ে আছি। গা ছমছম করে উঠলো। আবার ক্ষণেই চারপাশের ঘন সবুজ গাছ আর জংলী ফুলে ঘেরা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল আর ফিরে না যাই। এত বছর আগে, এত উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে এমন সুন্দর বাসা ওরা কিভাবে বানালো? বিস্ময়ে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
আমাদের যাবার ডাক পরলো। মাইকেল আমাদেরকে এবার প্রায় ২০ ফুট মই ধরিয়ে দিল উপরে উঠে যাবার জন্য। তবে এবার আর ভয় লাগলো না। উঠার সময় বার বার নিচে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। যেন এখনই দেখতে পাবো, সেই আদিবাসীরা আমাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে।
এমন একটি বুদ্ধিমান জাতি কি করে কালের গর্ভে হারিয়ে গেলো তা সত্যিই বিস্ময়কর।
অনীলা পারভীন: কর্মকর্তা, ভিক্টর চ্যাং কার্ডিয়াক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।