আমাদের গৌরব স্তম্ভগুলো ধসে পড়ছে একে একে। জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম একসময় থেমে যাওয়া। সে নিয়মে পরিণত বয়সে অসাধারণ একটি জীবন যাপনের পর বিদায় নিয়েছেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। যাঁকে জাতি চেনে বীর সি আর দত্ত নামে। তখনকার দেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক না। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মই হয়েছিল ধর্মান্ধতার কারণে। উপমহাদেশের দুটি দেশ ভারত আর পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকেই শুরু সাম্প্রদায়িকতা। এই মানুষটির পাকিস্তানে থাকার কথা না। তাঁর জন্মও হয়েছিল ভারতের শিলং এ। কিন্তু হবিগঞ্জের মানুষ কি আর দেশ ছেড়ে অন্য দেশে উদ্বাস্তু হতে পারে?
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত।শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরে তাঁর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
১৯৫১ সালে চিত্ত রঞ্জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করে।
বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন সি আর দত্ত। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে একজন হিন্দু অফিসার কিভাবে থাকেন বা কিভাবে তাঁর কাজ করতে পারেন সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু তিনি পেরেছিলেন এবং ভারত পাকিস্তান যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন পাকিস্তানের হয়ে। কাশ্মীর প্রশ্নে দু দেশের সেই যুদ্ধ এখনো ইতিহাসের এক জটিল বিষয়। সে জটিলতায় তাঁর আনুগত্য বা যোদ্ধা সত্তা মার খায়নি। তবে এটা বলতেই হবে পরিবেশ তাঁর অনুকূলে ছিলো না। সেটা স্পষ্ট হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের সময়।

তিনি আমাদের দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে এক পাও পিছিয়ে থাকেননি। ভারতে চলে গিয়ে ৪ নাম্বার সেক্টরের কমান্ডার পদে আসীন হবার পর তিনি যে বীরত্ব আর কৌশল উপহার দিয়েছিলেন তার তুলনা বিরল। সিলেটের চা বাগান এলাকায় তিনি যুদ্ধ সংগঠিত করা ছাড়া ও পুরো একাত্তরেই ছিলেন সক্রিয়। আর সেই সক্রিয়তার কারনেই দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁর ললাটে জুটেছিল বীরোত্তম খেতাব। এরপরের ইতিহাস মূলত তাঁকে আরো নন্দিত আর উজ্জ্বল করেছে। কারণ দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা আর আমাদের আদর্শ বা চেতনায় থাকতে পারিনি। জিয়াউর রহমানের মতো সেক্টর কমান্ডার কিংবা আরো অনেকের পল্টি খাওয়া ইতিহাস বিকৃতি দেশকে ফেলে দিয়েছিল অন্ধকারে। আজ আমরা বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকীকে দেখলে চিনতে পারি না। বুঝতে পারিনা ইনিই কি সেই বাঘা সিদ্দিকী যাকে আমরা বেয়নেট হাতে রাজাকার নিধনে দেখেছিলাম?
সি আর দত্ত তাঁর অবসর জীবনে এদেশের দুর্বল সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার আগে এদেশে যখন ডাবল ষ্ট্যান্ডার্ড আর সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে চাই্ছিলো তখন তিনি সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁর ভাবমূর্তির দুটি দিক ছিলো। একদিকে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা অন্যদিকে একজন বীর। তাই তাঁকে অবহেলা বা এড়িয়ে চলা ছিলো যে কারো জন্য অসম্ভব। একবার তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে গিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েন। তখন খালেদা জিয়ার রমরমা অবস্থা । দেশ বিরোধী অপশক্তি ঘিরে ছিলো তাঁকে। তাঁকে ধারণা দেয়া হয়েছিল কেউ কিছু করতে পারবে না। সে সময় তিনি যান প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে। বেগম জিয়া মুখের ওপর পা তুলে বসে বাজে করে কথা বললে বেরিয়েএসে তিনি জানিয়েছিলেন, মুখের ওপর বলে এসেছেন যে খালেদা জিয়ার স্বামী ও কখনো এমন করতো না। এও বলেছিলেন এভাবেই পতন ত্বরান্বিত হয় শাসকের। তাঁর কথা কতোটা সত্য তা এখন আমরা চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
আওয়ামী লীগের সাথেও ছিলো অম্ল মধুর সম্পর্ক। সত্য কথা বললে যা হয়। তারাও তাঁকে অপমান করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে গেলে তারাও ছেড়ে কথা বলেনি। কিন্তু এটা মানতেই হবে তাঁর জায়গায় তিনি ছিলেন অটল। এদেশের সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন আজীবন। এমন সাহসী সৎ বাঙালি এখন আর চোখে পড়ে না। পরিণত বয়সে চলে গেলেও তাঁর অভাব অনুভূত হবে দীর্ঘকাল। যতোদিন গণতন্ত্র অসাম্প্রদায়িকতা আর সাম্যের দেশ না হচ্ছে ততোদিন তাঁর মতো মানুষদের অভাব ঘুচবে না। আর ইতিহাসে তাঁর তারকা খচিত জায়গাটি চিরকালের।
বিদায়ী প্রণাম বীর সি আর দত্ত আপনাকে।
সিডনি
২৫/০৮/২০।
অজয় দাশগুপ্ত
কলামিস্ট, লেখক।