
‘‘বৃত্তের বাইরে’’ শুনতে অনেকটা ভারিক্কি লাগলেও ব্যাপারটা সেরকম নয়, আবার হেলাফেলারও নয়। এখানে প্রশান্তিকা শুধু চেষ্টা করবে বৃত্তের বাইরে থেকে বাছাই করা কিছু বিষয়াদি অবলোকন করার। যেমন ধরুন আপনি একটি বাগানের সুন্দর ফুল দেখে তার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ এবং দু’এক লাইনে আপনার মাথায় ছন্দের অনুররণও ঘটে গেলো। একটু ভেবে দেখুন ফুলের এ রূপটাকে ফুটিয়ে তোলার পেছনে কতোটা নিয়মানুবর্তিতা, কতোটা পরিচর্যা, কতোটা সময় ব্যয় হয়েছে একজন মালির। আমরা বিষয়টা সবাই জানি যে মালির চেষ্টাতেই ফুল ফুটবে ।চিন্তাটা এখানেই না থামিয়ে চলুন না মালির কাছ থেকে বিস্তর জেনে আসি। এটাই আমাদের বৃত্তের বাইরে।
তবে কি সত্যিই বৃত্তের বাইরে যাওয়া যায়? আমাদের প্রশ্ন করলে আপেক্ষিক অর্থে আমরা বলবো, না যাওয়া যায়না। আরওএকটু চিন্তা করে দেখুন তো, আপনি যখনই কোন কিছু একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার বা উপস্থাপন করার চেষ্টায় আপনার কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে কাজটা করছেন, তখনই কিন্তু আপনি বৃত্তের বাইরে নিজের অজান্তেই আরেকটি বৃত্তে আবিষ্ট হচ্ছেন। একটু সহজ করে বললে বোধকরি ব্যাপারটা এমন হয় যে, আপনি আপনার পরিধির ব্যপ্তি ঘটাচ্ছেন এবং সেই বর্ধিত গোলকে ভাগাভাগি করছেন সকলের সাথে সুস্থতা, সৌখিনতা এবং আপনার ভিন্নতা।
মুখোমুখি সিরাজুস সালেকীন
আট বছর বয়সে তার সঙ্গীত জীবনের হাতেখড়ি, বাবার কাছে। তার বাবা বাংলা গানের দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুল লতিফ। নিজে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, রবীন্দ্র নাথের গান করেন। ছায়ানটে গান শিখেছেন, শিক্ষকতাও করেছেন সেখানে। উনচল্লিশ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছেন এই অস্ট্রেলিয়ায়। গান করে যাচ্ছেন অবিরাম। নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন সঙ্গীত দল ‘প্রতীতি’। আমরা বলি এই প্রবাসে তিনি সর্বাঙ্গীন শিল্পী ও সার্থক মানুষ। তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি প্রিয় মানুষ ও শিল্পী সিরাজুস সালেকীন।
প্রশান্তিকার পক্ষ থেকে সিরাজুস সালেকীনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ।
শুভ: প্রবাসে বাংলা গান তথা সংস্কৃতি চর্চা কতটুকু হচ্ছে বলে মনে করেন।
সালেকীন: এখানে অবশ্যই বাংলা সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। এখানে বাংলা স্কুলগুলিতে বাংলা ভাষা ও বাংলা গান শেখানো হচ্ছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সুন্দর বাংলা গান করছে। এখানে বাংলা নাটক হচ্ছে, বছরে ৩/৪টা কবিতা পাঠের আসর হচ্ছে। একুশে একাডেমী প্রতিবছর বই মেলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। প্রতীতি বর্ষবরণ ছাড়াও মাঝে মাঝে লোক গান, ভাষার গান – দেশের গানের অনুষ্ঠান করছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সারাদিন ব্যাপী মেলার আয়োজন করছে। এ ছাড়াও দেশ থেকে শিল্পী এনেও আয়োজকরা গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। সব মিলিয়ে সারা বছরই বাঙালীদের কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকছেই। প্রবাসে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা অত্যন্ত কষ্টকর কাজ। তারপরও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি অত্যন্ত তৎপর। তাঁদের নিষ্ঠা, দেশ ও এর সংস্কৃতির প্রতি একধরনের দায়বদ্ধতার কারণেই এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।
শুভ: আমরা জানি আপনি দেশেই একজন প্রথিতযশ শিল্পী ছিলেন, এখানে এসে কি কখনও মনে হয়েছে আপনার সঙ্গীতচর্চার ব্যপ্তি ছোট হয়ে এসেছে ? এজন্যই বলছি প্রবাসে বাঙ্গালীর সংখ্যা এবং মিডিয়া মাধ্যম তো দেশের মতো নয়।
সালেকীন: প্রবাসে এসে আমার একক গান করার পরিধি অবশ্যই কমেছে – সে ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। দেশে থাকতে প্রতিদিনই গান নিয়ে বসা হত, রেডিও-টিভিতে গান করতাম। কলকাতা, দিল্লীতেও গেছি কয়েকবার বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে গান করতে। আর দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও গান করার ব্যস্ততা ছিল। এখানে আসার পর সেটা একেবারেই কমে গেছে। সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় “লোকাল আর্টিস্ট” হয়ে গেছি বলে। স্থানীয় শিল্পীদের এখানে খুব একটা কদর নেই। তবে প্রতীতি নিয়ে বেশ আছি। আমরা নিয়মিত গান শিখতে বসি। অনেক অপ্রচলিত গান আমরা শিখেছি। প্রতীতিতে বেশ ক’জন শিল্পী আছেন যারা বাংলাদেশের যে কোন শিল্পীর চেয়ে অনেক ভালো মানের গান করেন।

সিরাজুস সালেকীনের হাতে গড়া প্রতীতি সংগঠন
শুভ: ঠিক সে কারনেই এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই কি প্রতীতি গড়ে তুললেন? প্রতীতির পেছনের গল্পটা জানতে চাই।
সালেকীন: ১৯৯৫ সালে প্রথমে বঙ্গবন্ধু পরিষদে যোগ দিয়েছিলাম। রাজ্জাক ভাই, উজ্জল চাচা, গামা ভাই তখন এর কর্ণধার। বছরখানেক ছিলাম ওখানে। কিন্তু আমি যা চাই – যেভাবে চাই – তা ওখানে করা দুঃসাধ্য ছিল। ওটা বারোয়ারী একটা সংগঠন, বছরে একটা মেলা হত, আর সেই সাথে অনেক ঝামেলা ছিল।
সেই সময় সিডনিতে দুইটা এ্যাসোসিয়েশন ছিল। ওরা বরং অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। ভালো ভালো নাটক হত। গোলাম মোস্তফা, শাহীন শাহনেওয়াজ, টুকু ভাই, রেহানা ভাবী, লরেন্স ব্যারেল – এরা ছিলেন এর কর্ণধার। আমিও ওদের সাথে কাজ করেছি। ভালো একটা পরিবেশ ছিল। তবুও আমি আমার মত করে গান করতে পারছিলাম না।
১৯৯৭ সালে মাত্র ৬/৭ জন নিয়ে প্রতীতি গঠন করলাম। সেই থেকে যাত্রা শুরু।
শুভ: প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ বাবার সন্তান আপনি, নিজের সঙ্গীত সাধনায় বাবাকে তথা আপনার পরিবারকে কেমন করে অনুভব করেন?
সালেকীন: খুব ছোটবেলা থেকেই গানে হাতেখড়ি বাবার কাছে। তখনকার রেডিও পাকিস্তানে ছোটদের আসরে গান করতাম। ১৯৬২ তে শের-এ-বাংলা ফজলুল হক মারা গেলেন। আব্বা পরদিন কার্জন হলের সামনে ছাত্রদের আয়োজনে নাগরিক শোকসভায় গান করলেন শের-এ-বাংলা ফজলুল হক স্মরণে। সে সময় আশেপাশে খুব একটা দালান ছিল না। হাজার হাজার মানুষ ছিল সেদিন। সেদিন আব্বার সাথে আমিও গান করলাম। গানটি ছিলঃ
কাল মেঘে ঘিরিল রে – আকাশের ওই চাঁদ
কাল মেঘে ঘিরিল রে।
আইছ ভবে যাইতে হবে সর্ব লোকে জানা
দিন থাকিতে দীনের খবর কর না কেন মনা। কাল মেঘে ঘিরিল রে।
শোন শোন শহরবাসী নগরবাসী ভাই – শের-এ-বাংলা ফজলুল হক আর এই দুনিয়ায় নাই…।।
গানটি যখন বাবা গাইছিলেন – তখন সবাই কাঁদছিলেন, অনেকে জোরে শব্দ করে কাঁদছিলেন। আমি অবাক হয়ে গেছিলাম, ছোট ছিলাম, ঘটনাটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। এখন বড় হয়ে ভাবি – রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে আজকাল কি মানুষ এমন করে কাঁদবে? আসলে রাজনীতি এখন আর সেরকম নেই, নেতারাও আর সাধারণ মানুষের মনের কাছাকাছি আসতে পারেন না।
যাই হোক, এভাবেই আস্তে আস্তে গানকে ভালবাসলাম। বাসায় প্রায় প্রতিদিনই গান হত। অনেকেই আসতেন বাবার কাছে গান শিখতে। ফেরদৌসি রহমান, নিলুফার ইয়াসমিন, ইসমত আরা, নিনা হামিদ, এম এ হামিদ, আবদুল আলিম, মিনা বড়ুয়া, আব্দুর রউফ – আরও অনেকেই নিয়মিত আসতেন। জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদও আসতেন সিনেমার গানের জন্য। এরকম একটা পরিবেশই আমাকে গানের জগতে নিয়ে আসে।
শুভ: দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে অনেককেই গান শিখিয়েছেন, তারাও নিশ্চয়ই খুব ভালো গান করছে। তাদের সম্পর্কে এবং আপনার গুরুদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
সালেকীন: অনেকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আবদুল আহাদ, অজিত রায়, সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, সুধীন দাশ, জাহেদুর রহিম, ওস্তাদ আখতার সাদমানী, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মাদ, পণ্ডিত বারীন মজুমদার, পণ্ডিত নারায়ন চন্দ্র বসাক –এই সমস্ত গুনী সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে গান শিখেছি।
ছায়ানটে গান শিখিয়েছি প্রায় ৫/৬ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গান শেখাতে যেতাম। সিডনিতে আসাত পর থেকে প্রতীতির ছেলেমেয়েদের গান শেখাচ্ছি। প্রতীতিতে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আছে যারা অত্যন্ত উচু মানের শিল্পী। ওদের অনেকেই দেশ থেকে কোন না কোন প্রতিষ্ঠানে গান শিখে এসেছে। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়াতে বেশ ক’জন বাঙালি গায়ক-গায়িকা আছেন, যাদের আমি ভক্ত, খুব সুন্দর গান করেন।
শুভ: সেদিন সিডনি একক অনুষ্ঠানে আপনি ভরাট কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও পুরনো দিনের বাংলা গান শুনিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করলেন । তারপরও আমরা আপনাকে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে দেখি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আপনার ভালোবাসার কথা শুনতে চাই।
সালেকীন: ছায়ানটে গান সেখার সুবাদে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর একটা প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা তৈরী হয়। মূলত সনজীদা আপা ও ওয়াহিদুল হক এর কাছাকাছি এসেই রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি ভালোবাসাটা বেড়ে যায়।
শুভ: আপনার বাবা গানের মানুষ, আপনিও সারা জীবন গান নিয়ে আছেন, আপনার পরের প্রজন্মের কেউ কি গান বা সঙ্গীত চর্চা করছে ?
সালেকীন: আমার মেয়ে গান করে, ও ক্লাসিকাল গিটার আর চেলো বাজান শিখছে। ছেলে আগে গান লিখত, এখন আর লেখে না।
শুভ: রবীন্দ্রনাথের গান করে এমন বাংলাদেশ ও বাইরে আপনার প্রিয় শিল্পীর তালিকা জানতে চাই।
সালেকীন: সুবিনয় রায়, মিতা হক, ওস্তাদ রশিদ খাঁ, ওস্তাদ বেলায়েত খান, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়
শুভ: সবশেষে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রশান্তিকাকে সময় দেয়ার জন্য।
সালেকীন: আপনাকেও ধন্যবাদ। প্রশান্ত পাড়ের এই প্রবাসে বাংলা ও বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় প্রশান্তিকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এই শুভকামনা জানাচ্ছি।