বৃষ্টি ও অশ্রু । মো. রফিকুল ইসলাম

  
    

অবিরল ধারায় সশব্দ বর্ষণ ঝরিয়া চলিয়াছে সিডনির তিমির অন্তরীক্ষ হইতে। থামিবার কোন লক্ষণ প্রতীয়মান হইতেছে না। ইহা যেন বাংলার বর্ষণমুখর যামিনীর এক নিখুঁত প্রতিরূপ। বর্ষার স্থলে অত্র এইক্ষণে চলিতেছে নিদারূন শীতের রাজত্ব – পার্থক্য বলিতে এই যাহা। বর্ষণের অবিরল ধারার সহিত সবেগ শীতল বায়ুর সংস্পর্শ হাঁড়কাঁপানো শৈত্যধারাকে হৃদকাঁপানো যমধারায় রূপান্তরিত করিয়াছে যেন। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের টিনের চালায় অনুভূত রিমঝিম ছন্দে বৃষ্টি অনুভব করিবার সুযোগ অত্র না থাকিলেও প্রস্তর-কাষ্ঠনির্মিত এই আধুনিক নগরীর এহেন উত্তাল বাদলধারা জীবন চৌধুরীর সমস্ত তনুমনে এক ভিন্নতর অনুভূতির সঞ্চার করিয়া চলিয়াছে। তিনি নিজেকে সুকঠিন গবেষণাকর্মের বিরস জগত হইতে একরকম বলপ্রয়োগপূর্বক বিচ্ছিন্ন করিয়া আপন কক্ষের আলোকরাজি চকিতে নিভাইয়া দিয়া এবং বাতায়নাবরণ সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করিয়া বহিরাঙ্গণপানে মুখ করিয়া নিজস্ব শয়নস্থলে অর্ধ-শায়িত অবস্থায় নিমগ্নচিত্তে বসিয়া পড়িলেন। তাহার অন্তর আচম্বিতে কিরূপ যেন অসাড় আকুল ও চঞ্চল হইয়া উঠিল।
তিনি বাহিরপানে স্থিরনেত্রে বৃষ্টিরস চাক্ষুস করিতে সচেষ্ট হইলেন। কিন্তু চতুর্দিকের ধূ-ধূ তমিস্রার মাতামাতিকে জয় করিয়া বাদলধারার শীতল-রসে আপন চক্ষুকে প্রশান্ত করিবার সুযোগ হইতে একপ্রকার বঞ্চিতই রহিলেন। অবশেষে বিরসবদনে বসিয়া চক্ষুদ্বয় নির্মীলিত করিয়া কর্ণকুহর অধিকতর সম্প্রসারিত করিয়া বাদল-ধারার ছন্দে আপন শ্রবণেন্দ্রিয়দ্বয়কে সুধারসে সিক্ত করিতে প্রয়াসী হইলেন। উত্তাল শীতল সমীরণ কী এক মৃদুস্পর্শে তাহার অন্তরের এক সাম্প্রতিক সুপ্ত অতীতকে সহসা স্মরণ করাইয়া দিয়া বিদ্যুচ্চমকসদৃশ নিমিষে শূন্যে বিলীন হইয়া গেল!

আশৈশব তিনি ধরিত্রীর বিবিধ দেশের অজানা প্রান্তের ভৌগোলিক সোন্দর্য্যরস ভাবিয়া ভাবিয়া কোন কূলকিনারা করিতে ব্যর্থ হইয়া আপন হৃদয়তলে একপ্রকার কল্পিতকাব্যের ছন্দ রচনা করিয়া ধরণীর অদৃশ্য সৌন্দর্যকে কাব্য-উপমায় মাখামাখি করিয়া তাহা হইতে রসাস্বাদন করিতে সচেষ্ট রহিতেন।
পরদেশেও কি বাংলাদেশসদৃশ বৃক্ষরাজি তাহার সুশ্যামল পত্র-পল্লবসমৃদ্ধ শাখা-প্রশাখা দোলাইয়া শীতল সমীরণে শ্রান্ত পথিকের ওষ্ঠাগত প্রাণকে নিমিষে জুড়াইয়া দেয়? সেইখানেও কি প্রখর রৌদ্রকিরণে দগ্ধ গোরক্ষকগণ বটসদৃশ কোন বৃক্ষতলে আসীন হইয়া ব্যাকুলহৃদে বাঁশরীতে সুরলহরীর সুতীব্র বাণ ছুটাইয়া পার্শ্ববর্তী কোন গাঁয়ের অচিন ষোড়শীর হৃদয়ালয় আচমকা বসন্ত-দোলায় চঞ্চল করিয়া দেয়? সেইখানের অধিবাসীদেরও কি প্রভাত-পক্ষীর কিচিরমিচিরে সুখনিদ্রা টুটিয়া গিয়া স্নিগ্ধ-শ্যামল শিশিরসিক্ত ঘাসের ডগায় প্রভাত-রবির বর্ণিল কিরণছটার অনুপম খেলা প্রত্যক্ষ করিয়া অন্তর বিমোহিত হইয়া যায়? পূর্ণ জোৎস্নায় আলোকিত থমথমে চন্দ্রিমা নিশীথে সেইখানের রোমান্টিক প্রেমিকযুগলও কি ব্যাকুল হৃদয়ে আপন আলয় হইতে অন্তর্হিত হইয়া কৌমুদী-বিহারে ছুটিয়া যায়? জীবন চৌধুরী নিমগ্নচিত্তে বসিয়া বসিয়া এইসব ভাবিতেন আর ভাবিতেন – কিছুতেই তাহার এইসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর প্রাপ্ত হইয়া আপন অন্তরকে জুড়াইবার সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিতেন না।
অদ্য সিডনীর এই বাদল-নিশীথে আপন অন্ধকারালয়ের এক নিভৃত-কোণে বসিয়া অতীতের এমনি কত শত ভাবনা তাহার বৃষ্টি-বিগলিত হৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে দোলা দিয়া যাইতে লাগিল। এইরূপ একটি ঘটনা স্মরণ করিয়া এইক্ষণে তাহার একপ্রকার হাসিই পাইতে লাগিল। পরদেশের বৃষ্টি এবং স্বদেশের বৃষ্টির মধ্যে যে কোন প্রকার প্রভেদ নাই তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া তাহার বিগত সময়ের বালকসুলভ ভাবনা অদ্য পুণ:পুণ: তাহাকে ব্যঙ্গ করিয়া যাইতে লাগিল। আপন দেশের বারিধারা যেইরূপ ভাবুকের অন্তরকে বেদনাতুর করিয়া তোলে, সিডনীর এই অবিরল বর্ষণও কি সেইরূপ তাহার হৃদয়-কোণের নানা অতীত স্মৃতির ঝাঁপি খুলিয়া তাহাকে স্মৃতিকাতর করিয়া তুলিতেছে না? হায়! হায়!! ধরণীর সকল বর্ষার স্বরূপ একই পরিমাপের, একই মাত্রার, একই কার্যক্ষমতার! সুখী দু:খী সকল মনুষ্যান্তরেই এই বর্ষা বিগত স্মৃতির দ্বার খুলিয়া দিয়া তাহাকে নির্বাক, বিমর্ষ, উদাস, আকুল ও চঞ্চল করিয়া তোলে!

জীবন চৌধুরীর অন্তরও কি অদ্য তেমনি কোন বেদন-ভারে জর্জরিত? এই বাদল-বরিষণ কি তাহার অন্তরের আগল খুলিয়া দিয়া তাহাকে সুদূর কোন ভাবনার রাজ্যে লইয়া যাইতে চাহিতেছে? কোথায় লইয়া যাইতে চাহিতেছে? কোন সুদূরের পাড়ে? তাহা কি সপ্তসমুদ্র ত্রয়োদশ তটিনীতটস্থ কোন অচিন দেশে? নাকি অতি পরিচিত কোন দু:খী মানুষের রাজ্যে যেইখানে সহস্র দু:খের মধ্যেও খেলা করিয়া বেড়ায় অজস্র পরিণয়ের পদ্মদল? সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা সেই মৃত্তিকায় কি উদয়াস্ত মলয়-দোলায় নৃত্য করিয়া খেলিয়া বেড়ায় স্বর্ণালী ধানশীষ? সর্ষে বালা সেইখানে গলা নুইয়া কি হলুদিয়া হাওয়ার সুখে মন মজায়? কলাপাতার চামর কি সেইখানে সহসা ক্লান্ত পথিকের প্রাণ জুড়াইয়া দেয়? ইহা কি সেই দেশ যেই দেশে ঝরা বকুলমাল্য গাঁথিয়া পথ চাহিয়া নিশী পোহায় ডাগর কোন পল্লীবধু? কোকিল-ডাকা রাঙা-বসন্তে সেইদেশে কি কোন সহোদরা পলাশ-পুষ্পমাল্যে আদরের সহোদরকে তাহার কোন প্রাপ্তিতে অভ্যর্থনা জানাইবার নিমিত্ত উদ্বেলিত-হৃদয়ে পথ আগলাইয়া দাড়াইয়া থাকে? সেইখানে কি কোন দু:খিনী জন্মদাত্রী তীর্থ-পরভৃৎসদৃশ অস্ত-রাঙা পন্থ চাহিয়া বসিয়া থাকে দীর্ঘ-দিবস অন্তে তাহার নাড়ি-ছিন্ন ধনের স্বআবাসভূমে আগমন প্রতীক্ষায়? কিংবা সেইদেশে কি কোন জনিত্রী সুদূর প্রবাস গমণে আপন আত্মজকে বিদায় জানাইয়া দিবসের পর দিবস অনাহারে অনিদ্রায় অতিবাহিত করিয়া দীর্ঘকাল রোদনহেতু আপন নেত্রজল শুষ্ক করিয়া অন্ধনয়নে বোবা-রোদনে প্রাণপাত করে?
জীবন চৌধুরীর আত্মনিমগ্ন ভাবনায় হঠাৎ যেন কিসের এক ছেদ পড়িয়া গেল। তিনি আর ভাবিতে সক্ষম হইলেন না। সম্প্রতি ঘটিয়া যাওয়া এইরূপ এক বেদনাবিধূর বিদায়লগ্ন স্মৃত হইয়া তাহার অন্তর দু:সহ এক বেদন-ভারে মুষড়িয়া পড়িতে চাহিতেছে। অতীব গ্লাণিকর সেই বিদায়ভার কী এক অবর্ণনীয় পীড়ায় তাহার অন্তর-আত্মাকে আকস্মিক বিষবাণে বিদ্ধ করিয়া বিগত মাসাধিককাল ব্যাপিয়া বড়শী-বিদ্ধ মৎস্যের ন্যায় ছটফটাইয়া মারিতে চাহিতেছে।

আবশ্যক মালপত্রসমৃদ্ধ লাগেজদ্বয় মোটরবাহনে উন্নীত করিয়া বাকরূদ্ধ জননীর নিকট হইতে বিদায় চাহিতে গেলে তাহার রোদনভার-জর্জরিত বদনপানে চাহিয়া বিদায় গ্রহণ করিতে তিনি ভরসা পাইতেছিলেন না। “মা যাই” বলিয়া তাহার শীর্ণ মস্তিষ্ককে টানিয়া আপন বক্ষমাঝে জড়াইয়া ধরিয়া কিছু একটা কহিতে চাহিয়া বুঝিলেন তাহার কণ্ঠ পূ্র্বেই বাষ্পরূদ্ধ হইয়া রহিয়াছে, সেইহেতু তিনি আর কিছুই বলিবার সাহস করিয়া উঠিতে পারলেন না। পশ্চাতে তাহার অন্তর্দাহ অনুধাবন করিয়া তাহার জনিত্রী হাহাকার করিয়া ক্রন্দন করিয়া উঠিয়া বিদায়লগ্নটিকে অধিকতর কঠিন করিয়া তোলেন। তিনি এক লহমায় পশ্চাতে ঝুঁকিয়া বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া পড়িলেন। মনে ভাবিলেন এই বেদনার্ত আবহাওয়া হইতে যত দ্রুত চলিয়া যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। সন্তানের বিদায়লগ্নে রোদন করিবেন না বলিয়া বিগত বেশকিছু কাল যাবত পণ করিয়া মাতা আপন মর্মজ্বালাকে কিঞ্চিত সম্বরণ করিয়া রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন বটে কিন্তু অতিব স্নেহশীল সন্তানকে দীর্ঘ সময়ের তরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া তিনি আর নিজেকে সংযত রাখিতে পারিলেন না। শকট-দ্বার গলাইয়া আপন হাড্ডিচর্মসার হস্তযুগলকে বাড়াইয়া নিজের কপোলকে সন্তানের কপোলে ঘঁষিয়া মাজিয়া তাহার সোনামানিকের মুখমন্ডলে গভীর আবেশের পরশ বুলাইয়া হৃদয়ের সমস্ত প্রণয়কে এক মূহুর্তে উজাড় করিয়া সম্প্রদান করিতে গিয়া চাঁপারোদনে আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতে লাগিলেন। জীবন চৌধুরী এই দৃশ্য আর সহ্য করিতে না পারিয়া কোন রকমে ভগ্নকণ্ঠকে চড়াইয়া বলিলেন, “ড্রাইভার চলো”।
কোন কিছু বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই মোটরশকটটি কলোনীর মোড় পার হইয়া গলির ভিতর ঢুকিয়া গেলে তিনি পিছনে কী ঘটিতেছে তাহা আর দেখিতে পাইলেন না। তথাপি, পশ্চাতে দন্ডায়মান প্রৌঢ়ার অন্তরতলে কী ভয়ঙ্কর রকমের অগ্ন্যুৎপাত ঘটিতেছে তাহা হৃদয়ঙ্গমে তাহার বিন্দুমাত্র ক্লেশবোধ হইতেছে না। দীর্ঘক্ষণ গম্ভীর থাকিয়া সিডনীর এই সান্ধ্য গগণ যেইরূপ অকস্মাৎ অবিরল বর্ষণে চতুর্দিক প্লাবিত করিয়া দিতে চাহিতেছে, তাহার জননীও যে সেইরূপ অবিরত অশ্রু বিসর্জন দিয়া তাহার আজীবন প্রণয়ের প্রতিদান দিতেছেন তাহা না বুঝিলে তাহার সন্তান হইয়া জন্মগ্রহণ করা বৃথা বৈকি।

বর্ষণমুখর ঘোর সন্ধ্যায় সিডনীর বারিধারা যেমনি করিয়া দৃষ্টিসীমার অন্তরালেই রহিয়া গিয়াছে, তাহার মাতার রোদনাশ্রুও তেমনি করিয়া অপ্রকাশিত রহিয়া গেলেও তাহা তাহার অন্তর্দৃষ্টি এড়াইতে সক্ষম হয় নাই। সিডনীর শীতল বারিবর্ষণ চক্ষুদ্বয়কে বঞ্চিত করিয়া যেমনি করিয়া কর্ণকুহরকে প্রশান্তি যোগাইয়াছে, মায়ের গোপনাশ্রু তেমনি করিয়া অক্ষিকে আড়াল করিয়া সন্তানের অন্তরকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে। শুধু পার্থক্য বলিতে এই, সিডনীর বারিধারা কর্ণকে শীতল করিয়াছে, অপরপক্ষে প্রসূতির করুণাক্ষির ঊষরাম্বু তাহার সন্তানের অন্তঃকরণকে সুদীর্ঘ কালের তরে উষ্ণ করিয়া তুলিয়াছে।
মর্মদেশে লেপটিয়া থাকা এহেন পাষাণভার বক্ষ হইতে কিঞ্চিত সরাইয়া দিয়া সেইখানে শীতলবায়ু প্রবাহের অভিপ্রায়ে জীবন চৌধুরী এইবার তাহার দৃষ্টি অন্য মাতার দিকে ঘুরাইয়া লইতে চাহিলেন। অন্য মাতা? তিনি আবার কোন্জন? আপন মাতার সুদূরে অবস্থানহেতু সৃষ্ট বিরহ-বেদনাকে অতি সন্নিকটে থাকিয়া ক্ষুদ্র অঙ্গুলি-সঞ্চালনে আধো-বোলে পরম মমতারসে সিক্ত করিয়া রাখিবার তরে সুমহান বিধাতা জীবন চৌধুরীকে অধুনা যেই মাতাকে উপহার দিয়াছেন তিনি আর কেহ নন, তাহারই আত্মজা।
অর্ধাঙ্গীর সহিত তাহার দুই অপত্যও বাহনে পাশাপাশি আসীন হইয়াছিল। তাহাকে নিঃসঙ্গতা হইতে যথাসম্ভব পরিত্রাণ দিবার প্রত্যাশায় তাহারা বিমানবন্দর অবধি তাহার সফরসঙ্গী হইয়াছিল। পার্শ্বস্থ মাতৃকাঙ্কে সমাসীন দুহিতাকে তিনি এক ঝাপটায় আপন বক্ষদেশে টানিয়া লইলেন। বাঁধভাঙা স্নেহ, অনুরাগ ও চুম্বনের তোড়ে তনয়াকে ভাসাইয়া দিয়া তিনি বৃদ্ধ নিরাবলম্ব জননীর অন্তঃপীড়া হইতে পরিত্রাণ পাইতে চাহিলেন। নিষ্পাপ দুহিতার অক্রূর হাস্যরস ও আনকোরা চাঞ্চল্য তাহাকে ক্ষণতরে কিয়ৎ প্রশান্তি প্রদান করিলেও তাহার আর্তনাদ একেবারে তিরোহিত করিতে পারিল না। ক্ষণে ক্ষণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় তাহা অন্তর্দেশ ভেদ করিয়া বাহির হইয়া আসিবার কসরত করিতেছিল যেন।
হায়! মনুষ্যজাতি নিদারূণকালে যেই বৃক্ষশাখা আকড়িয়া ধরিয়া আশ্রয় খুঁজিতে প্রয়াস পায়, তাহার সেই অবলম্বনও অযাচিতরূপে ভাঙিয়া পড়ে। ক্ষণান্তরেই বিমানবন্দরে তাহাকে তাহার আত্মজার নিকট হইতেও বিদায় গ্রহণ করিবার মূহুর্ত আসিয়া উপস্থিত হইল। জীবন চৌধুরীর দীর্ঘ অমঙ্গল ভাবনাকে এক ফু’য়ে উড়াইয়া দিয়া তাহার কন্যা যেইভাবে হাস্যবদনে তাহার প্রিয় জনিতাকে বিদায় দিয়া বিমানবন্দর হইতে বাহির হইয়া গেল, তাহা দর্শনান্তে তিনি যারপর নাই বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়া তিনি এই ভাবিয়া অন্তরে অত্যন্ত আহলাদবোধ করিলেন, “যাহা হোক, অন্তত দ্বিতীয় মাতার মলিন বদন স্মরণ করিয়া তাহাকে বিদায় গ্রহণ করিতে হইলো না। এইবার বোধ হয় কিছুটা স্বস্তিতেই প্রবাসের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো যাইবে”।

কিন্তু, হায়। মানুষ ভাবিয়া থাকে এক, হইয়া থাকে আর এক। প্রবাসের কথা উদিত হইবামাত্র তাহার অন্তর আরো একবার বিমর্ষ হইয়া পড়িল। তৃতীয় আরেক প্রসূতি আসিয়া যেন তাহার পথরোধ করিয়া দাঁড়াইলো। ইহা এক অদৃশ্য জনিকা যাহার সহিত তাহার রহিয়াছে বিনি সূতোর এক পরম সুকঠিন বন্ধন। সেই যে তাহার দু:খিনী মাতৃভূমি। তাহার মনে পড়িয়া গেল সেই অমোঘ বাণী – জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরিয়সী; মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি এই তিনটি প্রত্যেক মানুষের নিকট পরম শ্রদ্ধার বস্তু।
বাহিরে বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বাড়িয়া চলিয়াছে। মৃদু সমীরণ অধিতকর বলবান হইয়া ঝড়ো অনিলের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। সান্ধ্য-তিমির অধিকতর বৃদ্ধি পাইয়া কৃষ্ণ-রজনীতে ধাবিত হইতে চলিয়াছে। জীবন চৌধুরীর হৃদয়ানলও উষ্ণ হইতে উষ্ণতর রূপ পরিগ্রহ করিয়া চলিয়াছে। তদীবসীয় হাস্যবদনী দুলালী অদ্য মর্মবেদনাপীড়িত হইয়া অনুরাগ অভিমানে তাহার জনিতার সহিত ভালো করিয়া কথা কহিতে চাহে না। তাহার এত ভালোবাসার ‘বাবা’ কোন পাষাণ প্রাণে তাহাকে ফেলিয়া গিয়া এতকাল ব্যাপিয়া অন্যত্র বাস করিতে সক্ষম হউন তাহার শিশুহৃদে এই বোধ কোনমতেই প্রভাব না ফেলিয়া জনিতা-দুহিতার দূরত্বকে ক্রমশ যোজন যোজন দূরে লইয়া যাইতেছে। দূরালাপনী মারফত যোগাযোগ রক্ষাহেতু শ্রুত তাহার জন্মদাত্রীর বুকফাঁটা দীর্ঘশ্বাস এই সুদূর গগন-ব্যজনকেও সতত ভারী করিয়া তুলিতেছে! আর জন্মভূমির টান? ইহা জীবন চৌধুরী ভাষায় প্রকাশ করিতে সক্ষম হইবেন কি কভু? সিডনির ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ বাদল-বর্ষণস্বরূপ জীবন চৌধুরীর মর্মজ্বালাও প্রতিনিয়ত প্রচণ্ডতর ও উষ্ণতর হইয়া উঠিতেছে।
অকস্মাৎ কপোলতলে কী এক জলধারা অনুভূত হইলো। হিম-শীতল বর্ষণমুখর রজনীতেও এর উষ্ণতা সহজেই টের পাওয়া গেল। কিন্তু নিকষ আঁধারে এই নয়নধারাও মাতৃরোদনাশ্রুসদৃশ অদৃশ্য রহিয়া গেল।

মো. রফিকুল ইসলাম
পিএইচডি স্টুডেন্ট,
ফ্যাকাল্টি অব ইকোনোমিকস
ম্যাকুয়ারী ইউনিভার্সিটি।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
জয়েন্ট ডিরেক্টর ( ওএসডি )
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments