বৃষ্টি দিনের ঋণ । নাদেরা সুলতানা নদী

  
    

বাংলাদেশে বর্ষা ঋতু শুরু হয়েছে। এসেছে পহেলা আষাঢ়। না বাংলা ক্যালেন্ডার চোখের সামনে না থাকলেও ফেসবুকের কল্যাণে ঠিক সময়েই টের পাই। দেশের পত্রিকা এবং অন্যান্য মিডিয়াতে দেখা যায় বৃষ্টি ভেজা কদমের ছবি।

পরবাসে আমরা যারা আছি, তাদের ফেলে আসা স্মৃতি ঘেরা মেঘ বৃষ্টি বাদলের ছোঁয়া মাখা আবছায়া সুখ, মুখ মনে করার এক আকুলতাও বুঝি আমাদের কাউকে কাউকেই অল্প বিস্তর ভিজিয়ে যায়! ঠিক কোন সময় থেকে জানিনা আমার মাঝে প্রায় ছয় ঋতুরই কিছু সৌন্দর্যই ভীষণভাবে ঢুঁকে আছে, মন ও মগজে। যেকোন ঋতু শুরু হলেই আমি চোখ বুজে সেই সুন্দরই ছুঁয়ে দেই আজও এই সাত সুমুদ্দুর দূরে বসে!

পরবাস জীবনে এসেছি প্রায় এক যুগ। তার আগের বাংলাদেশে কাটানো সেই সময়গুলোর স্মৃতি নিয়েই কাটি জাবর…  যখন তখন। ঝুম বৃষ্টির বর্ষাও তাই…

‘’তোমার কাছে বৃষ্টি দিন শোধ না হওয়া অনেক ঋণ’।

একদম ছোটবেলায় তুমুল বৃষ্টি হলে কী করতাম ভাবতে গেলেই ভাসে টুকরো স্মৃতি।
স্কুলে টিফিন টাইমে ঝুম বৃষ্টি হলে ছেলের দল নেমে যেত মাঠে নিয়ে ফুটবল। আমরা নিরাপদ দূরত্বে বসে তা দেখছি কিশোরী দল। আমাদের মাঝেই দুষ্টু কেউ বৃষ্টির ছাঁটে এসে চুপিচুপি হাত ভিজিয়ে আমাদের দিকে বৃষ্টি জল ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করতো। তা নিয়েই একটু হুল্লোর আনন্দ সময়, বলা যায় আতংক এবং আনন্দের অদ্ভুত এক সময়। আতংক ছিলো বাসায় ভিজে ফিরে গেলে মায়ের বকুনি খাবার।

ছবি: দীপংকর গৌতম

তুমুল বৃষ্টিতে কোন খোলা বারান্দায় বা জানালায় দাঁড়িয়ে তার ঝাঁট, শরীর মনে যেন অন্য রকম এক ভালো লাগা দিয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা না পেলে কারো পক্ষে তা অনুভব করা সম্ভব না।

টানা বৃষ্টি হলে দুই/একদিন বাসায়ই আঁটকে থাকতে হতো পুরো পরিবারের। আব্বা ফার্মেসীও খুলতেননা। আব্বা যখন তখন ঘুম দিতেন লম্বা সময়। আম্মা হয়তো লুডু খেলা বা ক্যারাম খেলার মত কিছু করছে অন্যদের নিয়ে…

সেইসব দিনগুলোতে বাইরে খেলতে যেতে না পারায় রীতিমত মন খারাপ হতো স্কুল পড়ুয়া আমার। কোন না কোনভাবে দুই একজন বন্ধু বাসায় চলে এলে বসে বসে পুতুলগুলোকে সাজাতাম ওদের নিয়ে ইচ্ছেমতোন, এই ছিল খেলা।

মাঝে মাঝে এমন হতো, বৃষ্টি থামার নাম নেই, তারপরও কোন না কোনভাবে এই এতটুকুন পেলে ফুরসৎ, বন্ধুদের নিয়ে দৌড়ে চলে যেতাম দূরের খাল পেরোনো রাস্তার পারের সাঁকোর কাছে, একটা অদ্ভুত জায়গা ছিল। যেখানে বিল খাল নদীর পানি এক হয়ে অচেনা এক দৃশ্যপট হতো খুব বর্ষণের কিছু দিনই… প্রবল বৃষ্টি ধারা বয়ে যাচ্ছে সশব্দে। একদিকে ভয়, পানিতে ছিটকে পরে গেলেই হারিয়ে যেতে পারি আমরা… আবার একটা তীব্র টান, দেখতে হবে কেমন করে যায় পানি, কোথায় যায়…

দেখা মেলতো হঠাৎ মাছ ধরার আনন্দে মেতে উঠা পাড়ার বড়দের বেশ কজনকেও এই বৃষ্টি থামা সময়েই।

কোন এক বর্ষা রাতের অলৌকিক জোছনায় একদল বড় মানুষের সাথে ছোট নৌকায় করে রাতের শাপলা বিলে পৌঁছে যাওয়া, দূরের পাখি… অচেনা গানের তীব্র ভালো লাগা বেদনার সুর…এমন কিছু বর্ষা অনুভব আমার খুব যতনে তোলা আছে।

বৃষ্টি আধ ভেজা, পুরো ভেজা টুকরো টুকরো স্মৃতি। বৃষ্টি ভেজা সবুজ বনের হাতছানি, বড় ক্লাসে উঠেছি, একটু শান্ত হয়ে বসে থাকা শিখতে হয়েছে ততদিনে, হাইস্কুল বলে কথা!

বৃষ্টি দেখছি, স্কুলের মাঠ ভিজছে, তারও দূরে বড় রাস্তা, অচেনা কিশোর সাইকেলে করে বৃষ্টিতে হারায়… বৃষ্টির পর হঠাৎ মেঘ ভাঙা তীব্র রোদ। ধুয়ে যাওয়া প্রকৃতি যেন ফিক করে হাসে… আহ কী ভীষণ সবুজ, কী সবুজ, মনকে নাড়া দিয়ে যায় দূরের সেই সবুজ বনের সবুজ পাতারা। মন কেমন করে সেই সবুজে হারানো অবুঝ মন।

যে বাসায়টায় থাকতাম, তার পেছনে যতদূর চোখ যায় ধানী জমি নদী সব এক হয়ে যাওয়া থৈ থই পানি বর্ষারই কিছু দিন থাকতো।

টানা বর্ষণের আগের বৈশাখী ঝড়ের দিনগুলোতেই ছিল আমার কিছু ঝড়ের শেষে আম কুড়ানো সুখের দিন। হঠাৎ সকালের পর দুপুর বা বিকেল ছুঁই ছুঁই এমন সময়ে দূর থেকে শো শো আওয়াজে শুরু হতো শিলা বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাস।

ছোট বেলায় দুই একবার এমন শব্দ আর প্রকৃতির অদ্ভুত বদলে যাওয়া এখনও মনে আছে আমার খুব স্পষ্ট যেন শুনতে পাই সেই শব্দ।

সেই ক্ষণিক ঝড় শেষ হতে না হতেই সঙ্গী সাথী নিয়ে ভোঁ দৌড় আম বাগানের খোঁজে দূরের এক পুরোনো ইটের ভাঙ্গা দেয়ালের বাড়ির পেছনে। বাড়ির মালিক ক্ষিতীশ কাকুর তীক্ষ্ণ চোখ এড়িয়ে আম নিয়ে পালানো ছিল সুকঠিন… তারপরও সে কী চেষ্টা!

না, লেখক হুমায়ূন আহমেদ ওভাবে না বলে গেলে, কেউ যে কোনদিন বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল দেয়নি তা নিয়ে হয়তো আফসোসই হতোনা। তারচেয়েও বড় কথা ছোট বেলায় কদম গাছের ধারে কাছে যেয়ে অনেকবার সুগন্ধে আকুল হলেও গোছা গোছা কদম  হাতে আসুক কেউ এমন ভাবনা এ বেলায় মনে এলেও আগে কোনদিন আসেইনি। বরঞ্চ কদম কুড়িয়ে সেই কদমকে নেড়া করে সখীদের সাথে খেলায় মেতে থাকা কিছু সময়ই যে আছে আজ লিখতে বসেই তা পড়লো আজ মনে।

ছবি: দীপংকর গৌতম

ফেসবুক দুনিয়া আসাতেই বৃষ্টির সাথে খিচুড়ি, চা, রাবীন্দ্রিক আবহ আজকাল মোহিত করে গেলেও আমি জানি বিশেষ করে আমার ময়মনসিংহ গ্রামের বাড়ির টানা বৃষ্টিতে দেখেছি পাড়ার মানুষজন বাধ্য হয়ে খায় চাল ভাজা, কাঁঠাল বিচির ভর্তা, শুকনো পাট পাতা ভাজি বা শুঁটকী ভর্তা দিয়ে ভাত… নিরুপায় হয়ে। হাঁট বন্ধ হয়ে যেত টানা বর্ষণ হলে পরে ক’দিন।

এবং সেই শৈশবের খাবার আমায় বৃষ্টি এলে আজও টানে।

কোরোনায় বাংলাদেশ এবং আমাদের এখানকার জীবন যাপন গত বছর থেকে অনেক বেশীই বদলে গেছে। অনেকেই হারিয়েছি কাছের মানুষ.. হারানোর মিছিল থামেনি।

প্রিয় মানুষ, পরিবার পরিজন আছে দূরে আমাদের অনেকের। দেশ, দেশের যেকোন সময়ের স্মৃতি তাই এই সময় কিছুতেই যেন আর সুখ স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসেনা। কবে দেখা হবে…

‘’শাওন আসিলো ফিরে, সে ফিরে এলোনা’’… বাজে বিরহী সুর।

এই বর্ষা প্যাঁচাল নিয়ে এলাম কেন, কেউ কেউ ঠিক এই লেখা পড়বেন এমন খারাপ সময়েও, তাদের ছুঁয়ে যাক ফেলে আসা জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বর্ষা স্মৃতিগুলো। খুব খারাপ সময়ে মন শান্তিময় থাকুক, ভেতরে সবার এই সময়টা মোকাবেলার করার শক্তি থাকুক অটুট, এই চাই।

টাইটানিকে থাকা বাদক দল, নিশ্চিত ডুবে যাচ্ছে জেনেও একটু থেমে আবার বাজিয়ে যাচ্ছিলো তাদের বেহালা। আমিও লিখি, আমার লেখা যেন দিয়ে যায় সাময়িক হলেও যাপিত জীবনের ক্লান্তি ভুলার রিমঝিম ধারার মত শান্তি…

বাদল দিনেরও প্রথম কদমও ফুল করলাম আজ দান, এই লেখায় তোমাকে… যে আপনি পড়ছেন।

নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১৯ জুন ২০২১।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments