বে-দখলের পথে শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্মৃতিচিহ্ন : জাতি উদ্বিগ্ন -রণেশ মৈত্র

  
    

বিগত ২ ডিসেম্বর, বাঙালীর বিজয়ের মাসে, দৈনিক সমকালে “আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সম্পত্তি বেহাতের আশংকা” শীর্ষক শেষের পৃষ্ঠায় দুইকলাম শিরোনাম বিশিষ্ট খবরটি মারাত্মক উদ্বেগের।
আমরা সারা দেশেই দেখছি ভূমিখেকোদের উৎপাত। যাঁরা আইন মেনে চলেন, আইনের নামে তাঁরাই আবার বে-আইনী কার্য কমের শিকার হন। জাল দলিল তৈরী ভূমিখেকোদের বহু পরিচিত কৌশলে। সেই কৌশল বা অপকৌশলের অসহায় শিকার হতে চলেছে জাতির গর্বিত স্মৃতি বহনকারী বরিশাল শহরের আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়। সমকালের বরিশাল প্রতিনিধি পূলক চ্যাটার্জী প্রেরিত ঐ খবরে বলা হয়েছে, “আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি”-একুশের এই অবিনাশী গানের সুরকার, ভাষা সংগ্রামী, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের স্মৃতিচিহ্ন বরিশাল শহরে মুছে যেতে চলেছে মুছে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
আজ থেকে ৪৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নামে লিজ নেওয়া অর্পিত সম্পত্তি বেহাত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে শতাংশ অর্পিত সম্পত্তি লিজ নিয়ে নগরীর হাসপাতাল সড়কে ঐ সঙ্গীত বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হলেও বিদ্যালয়ের জমির মালিকানা দাবী করে বরিশাল যুগ্ম জেলা জজ ও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন জনকৈ শৈল দে।
তবে বরিশালে জেলা প্রশাসক অজিয়র রহমান জমিটি রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবেন বলে সাংবাদিকদের বলেছেন। অন্যদিকে বরিশালের সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ বিন্নি শ্রেণি পেশার মানুষ ও সঙ্গীত বিদ্যালয়টি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

বরিশাল সামাজিক আন্দোলনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন সমকালকে বলেন, ১৯৭২ সালে বরিশাল নগরের বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের নামে সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নামে ঐ জমিটি লিজ দেন বরিশালের জেলা প্রশাসক। সেই থেকে বরিশাল হাসপাতাল সড়কের ঐ একতলা বাড়ীতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের কার্য্যক্রম চলছে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে নগরীর রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিজ ও তার পরিবারের সদস্যরা ঐ জমি তাদের দাবী করে জিয়া উদ্দিন হাসান কবিরকে রক্ষণাবেক্ষণের ও পরিচালনার দায়িত্ব দেন। কিন্তু ২০০৭ সালে ঐ জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি গেজেটভূক্ত হয়। ২০০৮ সালে রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিক ও তার পরিাবরের সাত সদস্য জমি শৈল দের কাছে ১৬ লাখ টাকায় বিক্রী করেন।
অপরদিকে ২০১২ সালের সি.এস. রেকর্ডেও সঙ্গীত বিদ্যালয়ের ঐ জমি জেলা প্রশাসনের এক নং খাস খতিয়ানভূক্ত হয়।
ক্রেতা শৈল দে দখলে যেতে না পেরে ২০১২ সালে বরিশালের যুগ্ম জেলা জজ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আদালতে জেলা প্রশাসককে বিবাদী করে মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলার বাদী শৈল দে দাবী করেন, তিনি ঐ জমি দলিল মূলে কিনেছেন। উল্লেখ্য শৈলদে হচ্ছেন অমৃতলাল দে এন্ড কোম্পানীর চেয়ারম্যান বিজয় কৃষ্ণ দের স্ত্রী।
তবে জেলা প্রশাসনের অর্পিত সম্পত্তি সেল থেকে আদালতে দেওয়া ভিপি আইন সহকারী নূরুল ইসলামের বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ জমি শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নামে লিজ দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে সুনামের সাথে পরিচালনা করে আসছে এবং ঐ জমিতে সরকার পক্ষে লিজ গ্রহীতা ছাড়া অন্য কারও স্বত্ত্ব বা দখল নেই। এ জমি নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ও অধিক মূল্যবান হওয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজ সৃষ্টি করে মামলাটি দায়ের জরা হয়েছে।
বরিশালের সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ বলেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ বাঙালির জাতীয় সত্ত্বার প্রতীক। তাঁর স্মৃতি রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। তাই শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয়টি যে স্থানে আছে সেখানেই রাখতে প্রয়োজনে বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মীরা আন্দোলনে নামবেন।

শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়

সঙ্গীত বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির সভাপতি এস এম ইকবালও প্রয়োজনে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার কথা বলেন। জেলা প্রশাসক এস এম আজিয়র রহমান বলেন, জমিটি নিজেরদাবী করে শৈল দে আদালতে মামলা করেছেন, জেলা প্রশাসন থেকে আদালতে জবাব দাখিল করা হয়েছে। এ সম্পত্তি ও বিদ্যালয়টি রক্ষার সর্বোাচ্চ প্রচেষ্টা অভ্যাহত থাকবে।
প্রকাশিত সংবাদে যে অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে তাতে শৈল দে কর্তৃক দায়ের করা মামলার রায়ের উপর শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীতালয়টির অস্তিত্ব লিজপ্রাপ্ত জমিতে থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে।
সরকার জমিটি অর্পিত সম্পত্তি (ক) শ্রেণির তালিকাভূক্ত করায় মামলাটি আইনত: অচল। মোকর্দমাটির নির্গলিত অর্থ সরকার অবৈধভাবে ঐ সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভূক্ত করেছে। আদালতকে সকল পরিস্থিতি সঠিক প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারেন। জেলা প্রশাসন অবশ্য মন্ত্রণালয় প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই আদালতে জবাব দাখিল করেছেন।
আশা করা যায় আদালত মোকর্দমার সকল প্রেক্ষিত যথার্থভাবে বিবেচনায় নিয়েই রায় ঘোষণা করেন।

বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ঐ জমির মালিকানা যিনি দাবী করছেন তিনি বরিশাল নগরের একজন অত্যন্তবড় ধনী এবং সে কারণে প্রভাবশালীও। ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি বাদী পক্ষ থেকে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালযের পরিচালনা কমিটিকে প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়েছিল যে বাদী শহরের অন্যত্র একটি বাড়ীভাড়া নিয়েছেন সেই বাড়ীতে সঙ্গীতবিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হোক। কিন্তু সঙ্গীত বিদ্যালয় পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ঐ প্রস্তাবে সম্মত হননি।

যা হোক, বাদী যে দলিলমূলে জমির মালিকানা দাবী করছেন সে দলিলটিই জাল এবং আইনত: অগ্রহণযোগ্য। যে জমিতে ১৯৭২ সালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয় সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সে জমি আশি বা নব্বুই এর দশকে এসে বেসরকারি কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কারও কাছে কেনা-বেচা করার কাহিনী যে কোন বিবেচনায়ই গ্রাহ্য হতে পারে না। তদুপরি বিশাল বরিশাল নগরীর লাখো বাসিন্দা বাল্যকাল থেকেই দেখে আসছেন ঐ বিদ্যালয়টি নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে সেখানে সঙ্গীত লিখতে পাঠাচ্ছেন প্রতি বছরই ঐ বিদ্যালয় থেকে যথেষ্ট সংখ্যক ছেলে-মেয়ে সঙ্গীত শিক্ষা নিয়ে বিদ্যি সঙ্গীত সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রবেশ করে বরিশালের সাংস্কৃতিক জগতকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। সংশ্লিষ্ট জমি ঐ বিদ্যালয়ের দখলে রয়েছে দীর্ঘ ৪৭টি বছর যাবত। বরিশালের সমগ্র জনগোষ্ঠি এই দখলের প্রত্যক্ষ সাক্ষী দিতেও পরোয়া করবেন না বলে বিশ্বাস রাখি।

প্রতিবাদ

শহীদ আলতাফ মাহমুদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর মূল্যবান অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি পেয়েছেন একুশে পদক। শৈল দে তাঁর পরিবার সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তারা কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অংশ নন।জানলাম যে ঐ বিদ্যালয়র পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তাঁরা। কিন্তু হঠাৎ করে কোন উদ্দেশ্যে এ ধররে কাজে নিজেদেরকে জড়ালেন তা এক বিস্ময়। জাল দলিল সম্পাদন করা তার দাতা-গ্রহীতা, সাক্ষী এবং রেজিষ্ট্রেশন অফিসার, দলিল লেখক-সবাইফৌজদারী আইনে মামলায় পড়ে যেতে পারেন যদি চলমান মামলাটিতে দলিলটিকে আদালত জাল দলিল বলে উল্লেখ করে আদালতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।
আমাদের শ্রদ্ধা ও গর্বের সাথে স্মরণে আনা প্রয়োজন যে, গণ-সঙ্গীত শিল্পী আলতাফ মাহমুদ এবং তাঁর জীবিত মৃত সহযোদ্ধরা জীবন মরণ পণ করে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন ১৯৭১ এ। নয় মাস ব্যাপী এবং অসাধারণ বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলেন আমরা সকলে এদেশে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারছি, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা, জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট এবংএম.পি মন্ত্রী হতে পারছি।
তাই ঐ লাখো শহীদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন গণসঙ্গীত শিল্পী আলতাফ মাহমুদের নামে পরিচালিত সঙ্গীত বিদ্যালয়টিকে পূর্ণ মর্যাদায় রক্ষা করা, তাকে সমৃদ্ধ করা, বিদ্যালয়কে মহাবিদ্যালয়ে উন্নীত করার মাধ্যমেই আমরা তাঁকে সম্মান জানাতে পারি।
তাই, বাদী মামলাটি প্রত্যাহার করে নিন-ভূমি মন্ত্রণালয় ঐ জমিকে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নামে ঐ জমি এবং সম্ভব হলে জমির পার্শ্ববর্তী আরও জমি একেয়্যার করে ঐ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নামে স্থায়ী লিজ প্রদান করে আলতাফ মাহমুদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করি। একই সঙ্গে বিদ্যালয়টি বেদখলের আশংকা থেকে জাতিকে মুক্ত করি।

রণেশ মৈত্র: 
সাংবাদিক,কলামিস্ট,সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত। 
Email:raneshamitra@gmail.com

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments