কতগুলি শব্দের সাথে আমরা পরিচিত; জীবনে অসংখ্যবার শুনেছি, পাঠ্যপুস্তকেও পড়েছি। বোধ, বুদ্ধি ও যুক্তির কথা বলছি। এগুলির অর্থ বুঝি অনেকেই বা সবাই; তবে, হৃদয়ঙ্গম যে অনেকের আজও হয়নি, এ উক্তি করা অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়ই। তবে, সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয়; আর এক্ষেত্রে সিদ্ধি লাভ মানে হৃদয়ঙ্গম করা। মানুষ প্রজাতি, এ প্রজাতির জন্য উপযুক্ত জীবন অন্বেষণ, এ প্রজাতির দ্বায়িত্ব-কর্তব্য এবং এ প্রজাতি সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে ভাবনাগুলি পরম মাত্রার কষ্টিপাথরে মাঝে মাঝে যাচাই অত:পর গ্রহন অথবা বর্জন করার মাধ্যমে নিজেকে অর্থাৎ স্বীয় অস্তিত্বকে যথার্থ অবস্থানে স্থান দেয়ার প্রক্রিয়াটি বোধ করি সাধনাতুল্য। বোধের উপস্থিতি প্রতিটি প্রাণেরই প্রাথমিক ও মৌলিক একটি বৈশিষ্ট্য। বোধটিকে শুধুমাত্র উপযুক্ত চর্চার মাধ্যমেই সক্রিয় রাখতে হয়। চর্চা বা লালনের অনুপস্থিতিতে তা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়। মানুষের ক্ষেত্রে এই বোধের অনুপস্থিতিটি মানুষকে নির্বোধ হিসাবে পরিগনিত করে। নির্বোধ আখ্যা পাওয়া মানুষটি তাই সর্বসম্মতিক্রমে সবচেয়ে ঘৃনিত একজন মানুষ; কারণ, বোধহীন মানুষটি যে কোন সময় জঘন্যতম কুকর্মটি করে ফেলতে পারে। দু:খের বিষয় হলো, মানুষ তৈরীর কারিগর সকল, যেমন- পিতা-মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রজন্মের মধ্যে এই বোধের ঊদয়ের ব্যাপারে যেন একেবারেই উদাসীন; তারা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিটিকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছেন নির্ভাবনায়। বোধহীন বুদ্ধিমান ! ভাবুনতো একটিবার। মূহুর্তেই যেন ভেসে উঠে খলনায়ক সদৃশ কতগুলি হিংস্র মানবের প্রতিকৃতি। তাই বলে, বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজনীয়তাকে দূরে ঠেলে শুধুই বোধযুক্ত মানুষের দ্বারা সমাজ-সংসারের অগ্রসরমান সচলাবস্থাটি ধরে রাখা সম্ভব নয়। বোধ হলো কতগুলি মানবসংশ্লিষ্ট অপরিহার্য উপাদান যা কল্যানকর। এটি ভিত্তি, এটি কারন, এটি গন্তব্য যার জন্য বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সহজে ও সাবলীল ভাবে সেখানে পৌঁছানো যায়। অপরদিকে, বুদ্ধি বলতে কৌশল প্রয়োগ করার ক্ষমতা যার মাধ্যমে সহজে, অল্প সময়ে ও নিখুঁত ভাবে কর্মটি সাধন করা যায়। বোধ সংশ্লিষ্ট না হলে, কর্মটির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয় না। যুক্তির স্থান অনেকটা আপেক্ষিক; অর্থাৎ, স্থান-কাল-পাত্র নির্ভর। সহজ করে বললে, যুক্তি অনেকটা প্রেক্ষাপট সাপেক্ষে উপযুক্ত; অর্থাৎ, দশ বছর পূর্বে যা যুক্তিযুক্ত ছিল, আজ তা যুক্তিযুক্ত নাও হতে পারে। তবে, কিছু যুক্তি আছে যা সর্বকালের জন্যই উপযুক্ত। এই বোধ, বুদ্ধি ও যুক্তির মহামিলন যেখানে সেখানেই জীবন নামক উপভোগটি নিষ্কলুষ রূপে চলমান হয়। নিষ্কলংক এই অর্থে যে, উপভোগটি নিজের জন্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপরের জন্যও তা নিশ্চিত করা। অনেকেই বলে থাকেন যে বাস্তব বড়ই কঠিন। তার মানে, বাস্তবতা প্রায় সময়ই উপরোল্লেখিত বোধ, বুদ্ধি ও যুক্তির সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্র অন্তরায় হিসাবে কাজ করে। তাহলে বাস্তবতাটি আসলে কি? যা চলছে, যা ঘটছে এবং যা বেশিরভাগ মানুষ অনেকটা অন্ধের মত অনুসরণ অত:পর অনুকরণ করছে, ফলে এমনই একটি পরিস্থিতির উপস্থিতি থাকছে যেখানে গ্রহনযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য সবকিছুর সংমিশ্রনে একটি অবস্থা বিরাজমান, সেটিকেই আমরা বাস্তবতা বলছি; আর, বাস্তবতাকে কঠিন কিংবা নিষ্ঠুর তখনই বলছি, যখন যা করতে পারা উচিৎ, তা করতে সক্ষম হচ্ছি না। অক্ষমতার জন্য দায়ী এই বাধাঁ সৃষ্টিকারী নিয়ামক সমূহ যদি অতিক্রম না করা যায়, তাহলে সেই ত্রিরত্নের অর্থাৎ বোধ, বুদ্ধি ও যুক্তির মহামিলনের মাধ্যমে মানব মুক্তি অসম্ভব।
অপ্রীতিকর, অনৈতিক, পাশবিক, হৃদয় বিদারক যা কিছু ঘটে চলেছে, সে সমস্ত যে পূর্বে কখনো ঘটেনি, তা নয়; তবে, তার সংখ্যা যেন বেড়েই চলছে, আর এটাই শঙ্কার ব্যাপার। শতভাগ বিশুদ্ধিকরণ সম্ভব না হলেও, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শুদ্ধাবস্থাটি অর্জন করা অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সহযোগিতাটি আমাদের অবশ্য করণীয় কর্মের মধ্যেই পড়ে বলে আমি মনে করি। আপনি কি মনে করেন না? যদি না, তবে আপনি স্বেচ্ছায় মনুষ্য প্রজাতি থেকে নিজেকে অবনমিত করে অন্য নিকৃষ্ট কোন প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত করলেন। যা কিছু নষ্ট, সেগুলিকে কষ্ট করে হলেও ভাল করা অসম্ভব নয়; যদিও, তা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে, প্রজন্মকে আদ্যন্ত সঠিক জীবন দর্শন প্রদান করার প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন কাজ নয়। জীবানু অস্ত্র অথবা অনুজীব যা মানুষের মৃত্যুর কারন তা গবেষনাগারে তৈরী করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য কিন্তু এই বুদ্ধিবৃত্তির সাথে যা সংশ্লিষ্ট নয় তা হলো- সুস্থ বোধ ও যথাযথ যুক্তি। সুতরাং, বুদ্ধিবৃত্তির এ প্রকারটি মানবকল্যাণের জন্য বড় হুমকি। অপরদিকে, মারনাস্ত্র অনুজীবটির প্রতিশেধক তৈরীতে যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করছেন তারা উপযুক্ত বোধ ও যুক্তি সমন্বিত বুদ্ধিটিই অর্জন করছেন এবং বাস্তবতার আলোকেই তা প্রয়োগ করছেন। দু:খিত বোধ করি, যখন দেখা যায় যে, শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত হওয়ার বদলে প্রজন্মটি সত্যিকার অর্থে আর আলোকিত হচ্ছে না। এই আলোকিত হওয়া মানে হলো- বোধ, বুদ্ধি ও যুক্তির উপযুক্ততায় জ্ঞান অর্জন করা, যার দ্বারা সমাজ ও সংসারের অন্ধকার দূর করার ক্ষমতা অর্জন সম্ভব হয়। বোধের উন্মেষ ঘটানোর জন্য যে দুটি মঞ্চ প্রধান ভূমিকা পালন করে তা হলো- পারিবারিক মঞ্চ ও বিদ্যাপীঠ বা শিক্ষালয়। পারিবারিক মঞ্চ বা পারিবারিক পরিমন্ডলে প্রজন্ম বিকাশে তাদেরকে উপযুক্ত পথ প্রদর্শনে উৎসাহ দানকারী সহায়ক নিয়ামক গুলির নিয়মিত চর্চা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । উপযুক্ত ভাবে বেড়ে ওঠা বলতে যথাযথ বোধের লালনে বিকশিত হওয়া বুঝায়। যে সন্তানটি অংকে নব্বই নম্বর পেল কিন্তু রাস্তা পারাপারে প্রায় অচল ব্যক্তিটিকে সহযোগিতা করলো না, তাকে মূল্যায়নের প্রচলিত ধারাটিতে যে সমস্যা, তা কতজন উপলব্ধি করেন? কিংবা সমস্যাটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব কতটা বিস্তৃত হতে পারে, তাই বা কতজন বুঝার চেষ্টা করেন? সত্যবাদিতার জন্য প্রশংসা বা পুরষ্কৃত করার উপর মনোনিবেশের পরিবর্তে শুধুই মিথ্যা অর্জনের জয়গানে বাদ্য বাজালে, গানটিই গাওয়া হবে কিন্তু জয়টি গানের তালে তালে ‘পরা’ উপসর্গ গ্রহন করে, তবেই ক্ষান্ত হবে। বিদ্যা দানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ কি কি ক্ষেত্রে কতটুকু প্রাধান্য দিবে এবং স্বীকৃতি প্রদানে কোথায় কতটুকু গুরুত্বারোপ করবে তা বোধ করি আর বিশ্লেষনের প্রয়োজন নাই।
একটার পর একটা দুর্ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন ঘটনার নৃশংসতা হৃদয়কে দুমড়ে মুচরে শুকনো খড়ের মত অবশিষ্টে পরিনত করে। উদাহরণ দেয়ার মত এরূপ এক, একাধিক, শতাধিক ও সহস্রাধিক নৃশংসতা রয়েছে, যে সমস্ত সম্পর্কে অনেকেই বা সকলেই জ্ঞাত। কারন অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে যে, আমাদের অনেকেই পরোক্ষ ভাবে নৃশংসতার সহায়ক ভূমিকা পালন করছি। বোধহীন ও যুক্তিহীন বুদ্ধির কদর বাস্তবতাকে নৃশংস ও কঠিন করছে; আবার, আমরাই বাস্তবতাকে কঠিন আখ্যা দিয়ে একই ধরনের কদরে উপুর্যপরি নিমগ্ন থাকছি। রসবোধে প্রানের ছোঁয়া মিলে; তবে, উল্লেখিত ‘কঠিন বাস্তবতার’ বোধে রসের আধিক্য এতই যে, তাতে জীবন নাশের সম্ভাবনা প্রকট রূপেই উপস্থিত। মাঝে মাঝে প্রায় সকলেই আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করে থাকি, “এরূপ যঘন্য কাজ এরূপ শিক্ষিত মানুষের দ্বারা কিভাবে সম্ভব?” প্রশ্নের মধ্যেই যে উত্তর রয়েছে, তা আমরা উপলব্ধি করি না। যেরূপের যঘন্য কর্ম, সেরূপের শিক্ষিত মানুষের পক্ষেই তা সম্পাদন করা সম্ভব। সেরূপ মানে শিক্ষার একটি বিশেষ রূপ, যাতে বুদ্ধিবৃত্তির সনদ ব্যতীত অন্যান্য মানবিক বোধ একেবারেই অনুপস্থিত । তারপরও এরূপ সনদের জন্য যার-পর-নাই উঠে পড়ে একাকার। কিছু দিন পূর্বে মাটিতূল্য আমার এক বন্ধুকে বলেছিলাম যে, মানবিক ও সুস্থ বোধের উপযুক্ততা যাচাইয়ের একটি স্বতন্ত্র মাপকাঠি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা একান্ত জরুরী, যেখানে বোধের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে বুদ্ধি অপ্রয়োজনীয় হবে; অর্থাৎ, সনদ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
ভাবুনতো, ঘরে ঘরে চলবে যৌক্তিক সুস্থ বোধের চর্চার পাশাপাশি মুক্ত বুদ্ধি অর্জনের চেষ্টা। সৎ প্রকৌশলী, বিনয়ী ও মানবিক চিকিৎসক, কর্তব্য জ্ঞান সম্পন্ন পুলিশ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, সৎ ব্যবসায়ী এবং দায়িত্ববান-অনুগত নাগরিকে যদি পূর্ণ হয় স্বদেশ, তাহলে অরাজকতা আর নৃশংশতার প্রবেশদ্বার বন্ধ হবেই, তা নিশ্চিত।
ভূক্তভোগী না হলে কিংবা ভূক্তভোগীর স্থলাভিষিক্ত কল্পনা না করলে অন্যায়ের মাত্রাটি পুরাপুরি উপলব্ধ হয় না। উপলব্ধিতে কি আসে-যায়, যদি করনীয় কিছুই না থাকে? করনীয় বলতে সর্বদাই সশস্ত্র ভূমিকা নিতে হবে, তা নয়। ছোট ছোট অংশগ্রহন কিন্তু যা প্রয়োজনীয়, তাতে অংশ নিন। লালন চর্চা, রবীন্দ্র চর্চা, নজরুল চর্চা করুন বোধদয়ের জন্য; তবে এটিও মনে রাখা জরুরী যে, চর্চা করতে করতে যেন অন্যান্য প্রয়োজনীয় কর্তব্যগুলি অবহেলিত না হয়।পারিবারিক পর্যায় থেকে অনুশীলণ করতে থাকুন। সততাকে স্বীকৃতি দান, ভাল কাজের প্রশংসা, অসদুপায়ে অর্জনকে বর্জন, সত্য গ্রহন, মিথ্যাকে বর্জন শুধুমাত্র মৌখিক বা পুঁথিগত রূপে নয়, বাস্তবে প্রয়োগের সংস্কৃতিটি এক্ষেত্রে উপযুক্ত। স্বপ্ন বাস্তবায়নেই যদি মানুষের সমগ্র জীবন উৎসর্গকৃত হয়, তবে সে স্বপ্নে কেন সুখের স্বর্গটি স্থান পাবে না? এ স্বর্গে থাকবে না কোন দম্ভ, থাকবে না অনুতাপ, থাকবে না প্রতিযোগিতা; সেখানে থাকবে শুধু ত্যাগের ফসল পরিতৃপ্তি। আমার কারনে যে হাসলো, সে তো কেউ নয়, সে তো আমা হতে নি:সৃত জীবনবোধে পূর্ণ রশ্মিটির প্রতিফলন মাত্র। হাসি ফোটানোর এরূপ রশ্মি নি:সরণতো শুধুমাত্র আলোকিত মানুষের পক্ষেই সম্ভব। অত:পর কেউ কেউ বলবে যে, তারা অন্ধকারে থাকতেই পছন্দ করেন! বোধ, বুদ্ধি আর যুক্তির বিবেচনায় এটা যে অবাস্তব পদচারনা, তা বুঝতে ওরা তখনই সক্ষম হবে, যখন উপলব্ধ হবে যে, জীবনীশক্তিটি আসলেই আলো কনিকা নির্ভর।
দীন মোহাম্মদ মনির
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।