প্রবীর– এই সেদিন ক্লাবে যোগ দিল।
‘এতদিন কেন কোন ক্লাবে যোগ দেননি?’ – এমন প্রশ্ন অনেকেই করেছে। প্রবীর মিটিমিটি হেসেছে। মনে তাঁর কত উত্তর ঘুরেছে।
ছোটবেলা ফুটবল খেলার সখ ছিল। গায়ের সাদা গেঞ্জিতে রঙ দিয়ে১০ নম্বর লিখে মাঠে নামত। কেউ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিত, ‘আরে এই ১০ নম্বর পরে কে খেলত জানোস না? পেলে । পেলে’।
বন্ধুরা হাসতো, কিন্তু প্রবীর সেগুলো পাত্তা দিত না। ও হচ্ছে পেলে। ওরকি আর এতো কিছু দেখার সময় আছে। ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য ক্লাবের মেম্বার হতে হয়। পাড়ার ফুটবল ক্লাবে মেম্বার হতে গিয়েছিল।কিন্তু মেম্বারশিপ পায়নি। কারণ প্রবীরের খেলার বুট ছিল না। স্কুলের পাশেই মুচির দোকান ছিল। সেখানে হরিপদ মুচি কত বুট বানাত। প্রবীর দোকানে গিয়ে বুটগুলো উল্টে পাল্টে দেখে। বুটের দাম জিজ্ঞেস করে। হরিপদ মুচি জানে প্রবীর বুট কিনবে না। ওর পকেটে টাকা নেই। কিন্তু বিরক্ত হয় না। প্রবীরের বুট কেনা হয় না। তাই ওর আর ক্লাবের মেম্বার হওয়া হোল না।
প্রবীর বড় হোল। হাই স্কুলে গেল। স্কুলের বন্ধুরা ক্যারাম খেলার জন্য ওকে পাড়ার একটি ক্লাবে নিয়ে গেল। প্রথম দিন বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বন্ধুদের সাথে চুপি চুপি কয়েকদিন ক্যারাম খেলেছে। প্রবীরদেখল – ওখানে নানা বয়সের ছেলেরা আসে। ক্যারাম খেলে, বিড়ি টানে। বন্ধু শফিক ক্যাপ্সটেন সিগারেট এর অর্ধেকটা এনে প্রবীরকে দেয়। প্রবীর ভয় পায়।
–যদি কেউ দেখে ফেলে?
শফিক বিজ্ঞের মত বলে, ‘দূর! এইখানে কে আসব? আমরা সবাই ফ্রেন্ড । কেউ কিছু কইব না’।
সিগারেট এর গন্ধ দূর করার জন্য মুখে একটা পান দিয়ে বাড়িতে যায়। কিন্তু এই ফ্রেন্ডদের বুদ্ধি বেশিদিন টিকে না। প্রবীরের বড় ভাই – সববের করে ফেলেছে। পিঠে বেশ উত্তম মধ্যম পড়লো। পাড়ার ক্লাবেপ্রবীরের মেম্বারশিপ নেয়ার ইচ্ছা উড়ে গেল।
স্কুল শেষ করে কলেজে ঢুকে প্রবীর জানল ঢাকা ক্লাবের নাম। ওখানে যা যা হয় না – তার একটি মনগড়া বিশাল লিস্টি বানিয়ে ফেলল। স্কুলে যাবার চেয়ে ঢাকা ক্লাবে যাওয়া ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। একে ধরে, ওকে ধরে– ঢাকা ক্লাবে ঢুকার ফন্দি আটে। হঠাৎ শুনলে গুলশানে – বিদেশীদের জন্য একটি ক্লাব আছে। ব্যস! ওর ঘুম শেষ। ওখানে তো মেম্বারশিপ নিতে হবে। স্কুলের বন্ধু সানি জানালো,’তুই তো ওইটার গেট দিয়া ঢুকতে পারবি না। মেম্বারশিপ পাইনি কেমনে?’
প্রবীর উল্টো প্রশ্ন করে, ‘ক্যান? গেট দিয়া ঢুকতে পারুম না ক্যান?’
–তোর গায়ের রঙ দেখছস? তুই তো কালা।
–তাতে কি?
–আমি যে তোর চেয়ে ফর্সা – তারপরও আমি ঢুকতে পারুম না।ঐখানে বিদেশি সাদারা যায়।
প্রবীর হাল ছাড়ে না। বন্ধু সানির সাথে লাইন লাগায়। সানির আন্কেল আমেরিকান ক্লাবে কাজ করে। ওখানে তো প্রতি সপ্তাহে পার্টি হয়। সানি কত গল্প বলে। প্রবীর সানির সাথে ভাব জমায়। কলেজের ক্যান্টিনে নিয়ে বার্গার খাওয়ায়।
–ওই ক্লাবে সবাই কি করে রে?
–ক্যান মজা করে।
–মানে কেমনে মজা করে?
– খেলে, নাচে, গান গায়, তারপর কক্টেল খায়।
প্রবীর জানত কক্টেল হচ্ছে হাত বোমা। সানি বলল অন্য কথা, ‘নানারকমের সিরাপ, জুসের মধ্যে মালটা মিশাবি। তারপর গলা দিয়া গিলে ফেল – টের পাবি না’।
প্রবীর বোকার মত জিজ্ঞেস করে, ‘ওইগুলি খাইলে নেশা হয়?’
সানি মাথায় ঠুয়া দিয়ে বলে, ‘তুই একটা গাধা। আরে একবার পেটে গেলে তোর হুস থাকবো না। তারপর ড্যান্স, তারপর পোলা আর মাইয়াগোর লটর পটর শুরু হয়’।
– আর?
– আর কি করবো?
– মানে আর কিছু করে না?
–ওই হালার পো। আবার কি করবো?
–মানে ড্রিং কইরা মাতাল হইয়া কিছু করে না?
– আমি ঠিক জানি না। তবে খোঁজ লাগাইতে পারি।
–তুই এতো জানোস ক্যামনে?
–আমার আঙ্কেল ঐখানের কাম করে। তারে জিগাইলেই কত কিছু বইলা দেয়’।
–আমার তো আঠার বছর হইয়া গ্যাছে। তুই আর আমি ঐ ক্লাবের মেম্বার হইতে পারুম না?
সানি আকাশ থেকে পড়ে। ‘তুই ওই ক্লাবের মেম্বার হইবি ক্যান?’
প্রবীর বিজ্ঞের হাসি দেয়। ‘ক্যান তোর প্রব্লেম আছে?’
–অফকোর্স প্রব্লেম আছে। হালার পো, কয় ট্যাকা কামাস?
–ক্যান, আমি তো টিউশনি করি। ট্যাকা আছে।
সানি বিরক্ত হয়ে লাথি দেয়। ‘মান্দির পুলা, ঐখানে তোর মত ফকিন্নি যাইতে পারবো না। ঐখানে সব বড় লোকেরা যায়’।
প্রবীরের আসলেই এই ক্লাবগুলো সম্বন্ধে কোন ধারনা ছিল না। ভেবেছিল সবই বোধহয় পাড়ার ক্লাবের মত কোন ক্লাব।
সানির বাড়িতে গেলে নানারকমের মদের বোতল দেখায়। ওর আঙ্কেল নাকি এগুলো জমায়। প্রবীর হিসাব করে বলে যে সবগুলো বোতল থেকে মাল বের করলে প্রায় অর্ধেক গ্লাস মাল হয়ে যাবে। সানি এবার কক্টেল বানানোর বুদ্ধি করে। প্রবীর পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে । পেপসি দিয়ে কক্টেল হবে। প্রবীরের আনন্দ আর ধরে না। মনে মনে ভাবে, ঢাকা ক্লাবের মেম্বার হলে এমন কত শত বোতল ঘরে আসবে।
সানির কানে মন্ত্র ঢালে, ‘তোর আঙ্কেলরে ধইরা চল তুই আর আমি ঢাকা ক্লাবের মেম্বার হই’।
সানি বোকা ছেলে না। এতো অল্পতে প্রবীর ফুড়ুৎ করে সব পেয়ে যাবে– তা তো হবার কথা না। সানি হাত বাড়িয়ে বলে, ‘দে একটা ফিল্টারদে’।
প্রবীর প্রস্তুত ছিল। সানির কাছে আসার সময় এক প্যাকেট ফিল্টার সিগারেট নিয়ে এসেছিল। সানি আরাম করে সিগারেট ধরায়।
প্রবীর আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে… তোর আঙ্কেল এর সাথে আলাপ করবি তো?’
–ঠিক আছে বলুম। কিন্তু আমার মেম্বারশিপের টাকা কিন্তু তোরে দিতে হইব।
প্রবীর সব কিছুতেই রাজি। ঢাকা ক্লাবের মেম্বারশিপ পাওয়া কিচাট্টিখানি কথা?
–তোর আঙ্কেল কই?
– কাজে।
–কখন আসব?
–আইজকা তো বুধবার। আইজকা আঙ্কেলের নাইট ডিউটি। রাইত তিনটার আগে আসব না।
ওরা দুজন যখন মনের আনন্দে সিগারেট ফুঁকছিল আর একটু একটু করে কক্টেল টেস্ট করছিল, ঠিক তখনই অঘটন ঘটলো। সানির আন্কেল ঘরে ঢুকল। সানি তাড়াতাড়ি সিগারেট লুকাল, প্রবীর সোফার নিচে কক্টেলের গ্লাস রাখল। কিন্তু সিগারেট এর গন্ধ তো আর লুকানো গেল না।
আঙ্কেল কোন কথা না বলে সানি আর প্রবীর এর গালে ধপাস করে চড় মারল। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সানি বলল, ‘প্রবীর ঢাকা ক্লাবের মেম্বার হতে চায়। তাই একটু প্রাকটিস করছিল’।
আঙ্কেল দুজনকে কানে ধরে দাড় করালো।
আঙ্কেল আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে মেম্বার হতে চায়?’
প্রবীর ভাবে যা ভুল হয়েছে – তা মেনে নিলে আর চলবে না। সাহস করে বলে, ‘আঙ্কেল, আমি আর সানি দুজন ঢাকা ক্লাবে মেম্বর হবো। আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন’।
আঙ্কেল এর মুখ হা হয়ে গেল। ছেলের সাহস দেখে আঙ্কেল জিজ্ঞেস করল, ‘এই বিড়ি টানার জন্য ঢাকা ক্লাবের মেম্বার হইবা?’
প্রবীর আমতা আমতা করে বলে, ‘না আঙ্কেল। আমি বিড়ি খাই না। সানি আর আমি এমনি সখ কইরা সিগারেট কিনছি। ক্লাবের তো অনেক ফ্যাসিলিটি থাকে। আমরা ওই সব ফ্যাসিলিটি ইঞ্জয় করবো’।
সানির আঙ্কেল এবার কষে দুইটা চড় মারে। প্রবীর টের পায় ঢাকা ক্লাবের মেম্বরশিপ এই মাত্র ক্যান্সেল হয়ে গেল।
কিন্তু ক্লাবের মেম্বার হবার স্বপ্ন তো শেষ হয় না। এই ভাবেমেম্বারশিপহীন অবস্থায় অনেকগুলো বছর কেটে গেল। তারপর প্রবীরের একটি বিশেষ ক্লাবের মেম্বার হওয়ার সুযোগ এলো। অবশ্য মেম্বার হবার আমন্ত্রণ গত দু’বছর ধরেই পাচ্ছিল। প্রবীরের ডানে, বায়ে, সামনে, পিছনের অনেকেই সেই মেম্বারশিপ নিয়েছে। প্রবীর নেয়নি। বুক ফুলিয়ে বলেছে, ‘নাহ রে ভাই। আমি সব ক্লাবের মেম্বারহই না’।
বন্ধুরা বলল যে এই নতুন ক্লাবের মেম্বার হলে বেশ সুবিধা পাওয়া যায়। এই যেমন নিজেকে রান্না করতে হয় না। চারিদিকের বন্ধু–বান্ধবরান্না করে বাড়িতে দিয়ে যায়। দোকানের কেনা কাটা নিজের করতে হয়না। অনলাইনে নতুবা বন্ধুদের বললেই ওরা কিনে বাড়ির দরজায়দিয়ে যায়। পাক্কা দুই সপ্তাহ অফিসে যাওয়ার দরকার হয় না। ইচ্ছেকরলে – টেনে চার সপ্তাহ করা যায়। মন চাইলে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’বলে দুই তিন মাস কাটিয়ে দেয়া যায়। কোন যুক্তি দিতে হবে না। শুধুএই নতুন ক্লাবের মেম্বারশিপ দেখাতে হবে। ক্লাবের সব কিছু ভাল শুধুএক বিছানায় প্রিয় মানুষের সাথে ঘুমানো যায় না।
প্রবীর ভাবে এমন ক্লাবের মেম্বারশীপ এর জন্য আবেদন করবে কিনা।গত দুই বছর এই মেম্বারশিপ এড়ানোর জন্য প্রবীর বাইরে যাওয়া বন্ধ করেছে, লোকজনকে মুখ দেখায়নি, বাইরে হাটতে গেলেও মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে, দিনে দশ বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছে, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত কচলিয়েছে দিনরাত। বাড়িতে কাউকে আসতে দেয়নি। নিজেও অন্যের বাড়িতে যায়নি। কিন্তু এইভাবে প্রবীর বেশিদিন টিকতে পারল না। অতঃপর প্রবীর এই ক্লাবের মেম্বারশিপগ্রহণ করল।
প্রবীর ঘরের চারিদিকে তাকায়। আনাচে কানাচে – কত রকমের লাল নীল কক্টেল সাজানো। হাত বাড়ালেই বাড়ির কাছের দোকান থেকে ফিল্টার সিগারেট কিনে আনা যায়। সানির কথা খুব মনে হয়। আহা! দুজনে বসে একটু কক্টেল আর ফিল্টার সিগারেট খেলে মন্দ হয় না। সানিকে কি ফোন দিবে? সানি কি কোন ক্লাবের মেম্বার হয়েছিল? অনেকদিন যোগাযোগ নেই। পাঁচ বছর আগে কথা হয়েছিল। প্রবীর ইমেল ঘেটে সানির ফোন নম্মর বের করে। দ্বিধা নিয়ে ফোন করে। অপরিচিত গলার স্বর উত্তর দেয়,’হ্যালো। কে বলছেন?’
–আমি প্রবীর। সানির বন্ধু। ওঁর সাথে কি কথা বলা যাবে?
–আঙ্কেল। আপনি বোধহয় জানেন না। বাবা দু’সপ্তাহ আগে মারাগেছে।
প্রবীর চমকে উঠে।
–কি হয়েছিল?
–শ্বাস কষ্ট। আই সি ইউ তে ছিল দুসপ্তাহ।
প্রবীর ফোন রেখে দেয়। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল সানি ঢাকা ক্লাবের মেম্বরশিপ পেয়েছিল কিনা? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। নিজের মেম্বারশিপ কার্ডটি উল্টে পাল্টে দেখে। গতকাল মোবাইলে ডাউনলোড করেছে। নিজের নাম, জন্ম তারিখের উপর আঙ্গুল ঘুরায়। প্রবীর ভাবে ঢাকা ক্লাবের মেম্বরশিপ কার্ডেও নিশ্চয় ওর নাম আর জন্ম তারিখ লেখা থাকতো। হয়ত একটা মেম্বারশিপ নম্বর থাকতো। শুধু নতুন ক্লাবের এই শর্তটি ঢাকা ক্লাবের কার্ডে থাকতোনা, ‘মেম্বারদের জন্য অক্সিজেন এর কোন ডিস্কাউন্ট নাই।’
সিডনি, এপ্রিল’২০২২।