
‘কন্সেন্ট’ একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, যেইটার গুরুত্ব বোঝার বুদ্ধি, জ্ঞান কিংবা মানসিকতা সংখ্যাগরিষ্ঠের তৈরি হয়নি, এই উপলব্ধি আমার নতুন না। সাম্প্রতিকতম সময়ে মিথিলা-ফাহমি ভাইরাল কেসে বাইপ্রডাক্ট হিসাবে এই উপলব্ধি আরও পোক্ত হয়েছে। কেননা,আলতু ফালতু যুক্তি যারা দিয়েই যাচ্ছেন মিথিলা কে ‘বেশ্যা’ প্রমাণের জন্য, তাদের যুক্তিবিদ্যা (গরু ঘাস খায়, মানুষ গরু খায়, অতএব, মানুষ ঘাস খায় লেভেলের যুক্তি যদিও!) চর্চা দেখে মনে হয়েছে কন্সেন্ট শব্দটা হয় তারা জানেন না, অথবা জানলেও তাদের মাথার ভেতর কখনো ঢোকেনি, মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ছক্কা হয়ে। তাই ভাবলাম ‘কন্সেন্ট’ ব্যাপারটা কি সেটা বলে নিই একটু শুরুতে। বলা হচ্ছে যে, সেক্সুয়াল এক্টিভিটিতে ‘কন্সেন্ট’ হল যৌন সম্মতি যেখানে অংশগ্রহণকারী দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, দুজনে নিজ ইচ্ছায় অংশগ্রহণ করেছে এবং এই ইচ্ছা বা ‘পছন্দ’ করার ক্ষেত্রে তারা দুজনেই স্বাধীন এবং সক্ষম। অর্থাৎ যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা দুজনেই সম্মত হয়েছে কোন রকম ভয়ভীতি, বল প্রয়োগ, প্ররোচনা বা প্রলোভন ছাড়াই।
প্রেমের সম্পর্কে থাকলে পরস্পরের মধ্যে যে যৌন সংসর্গ হয় সেটাও কন্সেন্সুয়াল। কন্সেন্সুয়াল সেক্স সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর। মোরাল পুলিশেরা ফেসবুক আর কীবোর্ড হাতে কালকে থেকে যে মিথিলাকে (ফাহমিকে না কিন্তু) গালি দিয়ে ভুত ছাড়ানোর কাজে নেমেছেন, এনাদের আমার একটু জিজ্ঞাসা করে দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল, ‘কন্সেন্ট’ বিহীন যৌন সম্পর্ক যেমন ধরেন রেপ, ম্যরিটাল রেপ এসবের ক্ষেত্রে কি ওনারা তাদের মোরাল পুলিশিংকে চাষের খেতে বর্গা দিয়ে আসেন? পরে ভেবে দেখলাম নাহ, তা তো তারা দ্যান না, বরং একই ভাবে মেয়েটা কিভাবে ‘বেশ্যা’ সেকারনেই রেপড হয়েছেন সেই যুক্তি দিতে বসেন। সুতরাং হিসাব কিতাব পরিস্কার, ঘটনা যাই ঘটুক, মেয়েটা ‘বেশ্যামাগী’।
অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর (অমিতাভ বচ্চন অভিনীত) ‘পিঙ্ক’ সিনেমাটার বদৌলতে কন্সেন্টের ‘No means No’ মডেল বেশ পরিচিত। এরই আরেকটা পার্ট হল The Affirmative Model of consent ‘Yes means Yes’. এখন একটা কুইজ। ধরেন ‘ক’ আর ‘খ’ সর্বত সম্মতিক্রমে ‘Yes means Yes’ এর সবগুলো শর্ত মেনে দুইজন দুইজনের অনুমতি নিয়ে যৌন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন আর আপনি জানালার ফুটা দিয়ে সেটা দেখে মজা নিচ্ছেন, অথবা ভিডিও করে/ছবি তুলে এরে তারে দেখাচ্ছেন। আপনাকে কিন্তু ‘ক’ এবং ‘খ’ কেউই অনুমতি দ্যান নাই। বলেন দেখি, কে অপরাধী? ক/খ না আপনি?

মিথিলাকে নিয়ে ইতিবাচক কথা বলাতে একজন আমাকে কমেন্ট করেছেন ‘এখন আপনি আপনার ভাতারের সাথে ছবি তুলে আপ্লোড দ্যান, আমরাও দেখে মজা নেই” । ওনাকে উত্তরটা আমি এখানে দিতে চাই -আমার ‘ভাতার’ কিংবা যেকোন পুরুষের সাথে আমি যদি অন্তরঙ্গ ছবি তুলি তা হল নিজেদের আনন্দের জন্য, নিজেদের সম্মতিতে। এখন আপনি যদি আমার আইডি হ্যাক করে আমার সেই ছবি নিয়ে ব্যবসা করেন, ‘মজা নেন’ তাহলে আপনি বেশ্যা (উৎপত্তিগত বৈশ্য এবং পতিত অর্থে। ভাষার লৈঙ্গিক রাজনীতি আমি জানি, বেশ্যার যে কোন পুরুষবাচক শব্দ বাংলা অভিধানে নেই (সে আমার জানা) আমি না। আমাদের কন্সেন্ট ছাড়া আপনি যে আমাদের ছবি দেখে ভয়ারিস্টিক আনন্দ নিবেন, সে জন্য কিন্তু আমি আপনার নামে মামলা করব।
ভয়্যারিস্টিক ডিসঅর্ডার বলে একটা টার্ম আছে, এই ডিসঅর্ডার হলে মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের শরীর বা সেক্সুয়াল অ্যাক্ট দেখে আনন্দ নেয়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষজন নিজেরা সেক্সুয়াল এক্টিভিটিতে অংশ নিতে অক্ষম হন। কুংগ থাং’দার পোস্ট ধরে ইফতেখার আহমেদ ফাহমীর হ্যাক হওয়া আই ডি তে গিয়ে দেখে আসলাম, মানুষজন লিঙ্ক দ্যান ভাই লিঙ্ক দ্যান করে চিল্লাপাল্লা করছে এবং কেন এটা ভুয়া লিঙ্ক সে নিয়ে গালাগালি করছে। দেখে শুনে আমার মনে হল, আমাদের চারপাশে বিশাল একটা সংখ্যা সেক্সুয়ালি ফ্রাস্টেটেড ভয়্যারিস্টিক ডিসঅর্ডারড জাতি তৈরী হয়েছে।
আমার সেকেন্ড মাস্টার্সটা আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে করছিলাম। যেদিন আমার কনভোকেশন ছিল, সেদিন মিথিলারও কনভোকেশন ছিল। আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট রিলেটেড কোন একটা মাস্টার্স করছিলেন তিনি, সেকেন্ড মাস্টার্স। প্রথমটা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। আমাদের সবার আগে মিথিলা স্টেজে উঠছিল, কেন জানেন? না তার তারকা খ্যাতির জন্য না। রেসাল্টের জন্য। মেয়েটা ৪.০০ আউট অব ৪.০০ সিজিপিএ নিয়ে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করছিলেন। তার মেয়েটা তখনও ছোট এবং ব্র্যাকের কোন একটা প্রোগ্রামে উনি তখন ম্যানেজার, এই সব নিয়েই। কনভোকেশন লাইনে দাঁড়ায় থাকতে থাকতে পাশের লাইনের মিথিলাকে আমি খুব আনন্দ নিয়ে কংগ্রাচুলেট করলাম, ওর রেজাল্টের জন্য ওর পরিশ্রমের জন্য। তারকা মিথিলাকে না, পরিশ্রমী মেয়েটাকে।
মেয়েটার এই সাফল্য সেদিন ভাইরাল হয়নি । ভাইরাল হয়েছে গত পরশু। পান্তাভাতমার্কা ‘অন্তরঙ্গ’ ছবির জন্য! কারণ তারে ‘বেশ্যা’ বলা গেছে। অথচ অর্জনটাই পাব্লিক, ওতে আপনার মতামত দেয়ার অধিকার আছে, মিথিলার শরীর কিংবা সেই শরীর নিয়ে তিনি কার সাথে শোবেন সে বিষয়ে মতামত কিন্তু আপনার এখতিয়ারের বাইরে!
তানজিনা তাইসিন
কবি, লেখক, রেডিও হোস্ট
প্রশান্তিকা প্রধান, এডিলেইড।
৭ নভেম্বর, অস্ট্রেলিয়া।