ভাঙ্গাঘর । ইসহাক হাফিজ

  
    
গাভীটিকে তিনজনে মিলে শুইয়ে পাগুলো চেপে ধরেছে, আরেকজন চাপ দিয়ে ধরে গলা। নিকটস্থ মসজিদের ইমাম সাব বেশ লম্বা একটা ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভোরের আলো ফুটে উঠলেও ঘন কুয়াশা আছে। পাশেই নদী। চলন্ত নৌকায় ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায়। দেখা যায় না কিছুই। একটু পরেই বাজার জমতে শুরু করবে।
মিনু পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। গাভীটার বয়স সাত বছর, এ পর্যন্ত চারটা বাচ্চা দিয়েছে। এ যেন শুধুমাত্র একটি গাভিই নয়, অম্লান এক স্মৃতির ভান্ডার। এদিকে গোয়ালের দরজাটা ঘেঁষে, এক ফুটেরও কম দূরত্বে মিনুর ছোট ভাই নুরু এসে, দেয়াল তুলে  পৈত্রিক ভিটা বুঝে নিয়েছে। সীমানা ঘেঁষে দেয়াল করার কারণে ছোট গোয়ালটা থেকে গরুটা বের করার আর পথ রইল না। মিনুর মা গরুটাকে খুব ভালোবাসতেন। নিজ হাতে খাওয়াতেন গোসল করাতেন। তাই দেখে বাবা শখ করে গোয়ালের দেয়াল আর মেঝেটা পাকা করেছিলেন। পাশেই রান্নাঘরটা পড়ে গেল ছোট বোন রানুর অংশে। তাই এ রান্না ঘরটাও এখন সরিয়ে নিতে হবে। বড় ঘরটিও এক মাসের মধ্যে সরিয়ে নিতে নুরু বড় ভাইকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে গেল। এসব ভাবতে গিয়ে মিনুর মাথা আর এখন কাজ করে না। গালে হাত দিয়ে দরজার সামনে বসে থাকে। কখনো ভিজে আসা চোখ দুটো তাকে উপহাস করে। এ উপহাসের কারণ সে নিজেই পারে না নিজেকে ব্যাখ্যা করতে। অপরের কল্যাণে ব্যয় হয়ে যাওয়া জীবনে অবশিষ্ট বলে আর কিছু থাকে না যে।
মিনুর প্রতি ভাইবোনের কৃজ্ঞতার কিছু নেই। কারণ তাদের লেখাপড়া, প্রতিষ্ঠা পাওয়া কোথাও শুধুমাত্র দুটো কথা বলে উৎসাহ দেওয়া ছাড়া তার আর কোন অবদান নেই। এমন কি বড় ভাই হিসেবে আদর করে তাদের হাতে দুটো টাকা এ পর্যন্ত সে দিতে পারে নি। এক পর্যায়ে ভাই বোনের সামনে আসতে তার লজ্জা করতে থাকে। বাবা মায়ের প্রতি সার্বক্ষণিক কর্তব্যনিষ্ঠা তাকে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জবিত করে রেখেছে। সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব বাবার হাত থেকে গড়িয়ে মিনুর হাত পর্যন্ত আসার প্রয়োজন পড়ে নি। তাই মিনু পারুর জীবনে কোন হিসাবের খাতা নেই। তার বাবা বড় ছেলেকে অতি অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনে তিনি বাকী জীবন র্নিবিঘ্নে কাটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বাবা মা দুজনেই এই অপরিণত ছেলে এবং ছেলের বউকে চোখে চোখে রাখতেন। এ যে শাসনে রাখা বিষয়টা এমন নয়। সার্বক্ষণিক এক স্নেহ মমতায় মাখামাখি। পারুর বিয়ে হয় আজ ষোল বছর। বিয়ের আগেই বাবা মা হারা পারুর মাঝে মাঝে জন্মের বাড়িটা একটু ঘুরে আসতে ইচ্ছা করতো। বছর দুই তিন পর অনুমতি মিললেও, সকালে এলে বিকালেই শ্বশুর এসে পারুকে নিয়ে আসত।
মা গো। তুমি না থকলে বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তোমার শ্বাশুড়ি তুমি আসার পর এই যে শুইছে। আর উঠেই না। এখানে কই থাকবা গো মা। তোমার বাবা মা নাই, ভাই ভাবির কাছে বেশিক্ষণ থাকা ভালা না। চল গো মা। বাড়ি চল।
পারুর চোখ ভিজে আসে। অনুনয়ের স্বরে কি যেন বলতে গিয়ে আর পারে না। বাবার অধিক এই শ্বশুর। ছেলেকে না পাঠিয়ে, নিজেই চলে এসেছেন। কি আর বলবে পারু। ভাই ভাবি আর তিন বছর বয়সী ভাইঝি’র সাথে আদর সোহাগে ইতি টেনে, চোখের জল আড়াল করে পারু শ্বশুরকে অনুসরণ করে। এসবের মাঝেই একদিন আদর স্নেহে আগলে রাখা দুজন মানুষ মহাকালের শ্রোতে মিশে গেলে, মিনু আর পারু সংসার বাস্তবতার আসল চেহারা দেখতে পায়।
বাবা মারা যাওয়ার শোক সামলে উঠতে না উঠতেই চলে গেলেন মা। তিন মাসও পার হল না। এখন এই ভাগ বাটোয়ারা। বাবা মায়ের স্মৃতিমাখা বাড়িটাও হয়ে গেছে এলোমেলো। মিনু যে দিকে তাকায়, বুকটা তার কেমন করে উঠে। হঠাৎ পিপাসা লেগে গলাটা শুকিয়ে আসে। এদিকে পারুর আচার আচরণে কেমন অস্থিরতা দেখা দেয়। যা মুখে আসে গালিগালাজ করে। কিছুক্ষণ পরেই আবার সব ঠান্ডা। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ক্ষমা চায়। মিনু শিশুর মতো র্নিবিকার চেয়ে থাকে।
সারাজীবন ভাইবোন ভাইবোন করছ। অহন মজা বুঝ। গাছের আম জাম বরই। পুকুরের মাছ। দুই মনি চাউলের বস্তা মাথায় করে নিয়া ভাইবোনকে খাওয়াও। ভাইবোন না খেলে যে তোমার গলা দিয়া খাওন নামে না। এই তার ফল।
এই তুমি চুপ করবা। বাপের সম্পত্তি ভাগ অইছে, ভালো হইছে।
পারু তেড়ে এসে কয়, হ ভালো তো হইছে। বাবা মার জন্যে একটা দুইটা কাপড় দূরে থাক। জীবনে এক পাতা ট্যবলেটও…।
এই! মনডা আমার ভালা না। দোহাই লাগে, অহন চুপ থাহ।
ভাইবোনের শহরে বাড়ি। পরিবার নিয়া কি সুন্দর সংসার। তোমার কিছুই নাই। এই যে বাড়িঘর আউলায়ে দিয়ে গেছে, অহন সব ঠিক কর। গালে হাত দিয়া বইয়্যা থাহ কেনে?
মিনু গালে হাত দিয়ে দরজার সামনে বসেই থাকে। কোন কথারই জবাব নেই দেখে পারু কাছে এসে বলে–
আমার একটা কথা। শোনবা?
বল।
তোমার শরীরটা ভালো থাকে না। এদিকে দেয়াল তোলছে। ওই দিকে তোলছে। অহন এই আধহাত জায়গা দিয়ে গরুটা কেমনে বাইর করবা। তার চেয়ে সোলমানকে বলে একটা দাম ঠিক করাও। গরুডা জবাই কইরা মাংস বেইচ্চা দেওক। ওই টাকা দিয়া আমি হাঁস মুরগির খামার করুম, আর তুমি কোন একটা ব্যবসা শুরু কর। কি হয় দেখা যাক।
হ। ঠিক আছে। বলেই মিনু বাড়ি থেকে বের হয়।
গাভিটা যখন বাচ্চা দিত, বাবা মায়ের ওই হাসিমাখা মুখটা মনে পড়তেই মিনুর চোখ ভিজে আসে। দুটো পা আর সামনে চলে না। বাবা নাই, মাও নাই। অহন গরুটাও যদি না থাকে, বাঁচমু ক্যমনে। এমন নানান কথা ভাবতে ভাবতে মিনু নিজেকে স্বান্ত্বনা দেয়। ‘গরুটা কি আর আজীবন থাকবো? জগতে মানুষ পশু পাখি কেউ তো আর অমর না। আমি নিজেই বাঁচবো আর কয় দিন।’
ইমাম সাব দোয়া দরূদ পড়ে ছুরি নিয়া এগোচ্ছেন। এদিকে সোলমান গাভির গলা চাপ দিয়ে ধরে। বসির আর দুলাল-একটা বাঁশ দিয়ে চেপে ধরেছে গাভীটার শরীর। ঠিক তখনই গাভীটা চোখ ঘুরিয়ে এক দৃষ্টে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মিনুর দিকে চেয়ে থাকে।
মিনু হঠাৎ করেই করেই চিৎকার দিয়ে বলে–
এই! এই হুজুর। সাবধান! আপনে সরে দাঁড়ান!
ইমাম সাব দুই কদম পিছিয়ে পড়তেই মিনু আরো জোরে চিৎকার দিয়ে বলে–
এই সোলমান গরুটা ছাড়! ছাড় কইলাম! তোর টেহার খেতা পুড়ি। নে তোর টেহা।
সোলমান হতবুদ্ধি। কী করবে না করবে। ফ্যাল ফ্যাল করে মিনুর দিকে চেয়ে রইল। ঠিক এ সুযোগে গাভিটা ক্ষিপ্ত গতিতে উঠে দৌড় দিতেই মিনু এক লাফে গাভির গলা ঝাপটে ধরে। নদীর পাড়ে ধাপুড় ধুপুড় শব্দে শিহরণ তোলে দৌড়াতে থাকে গাভিটা। সাথে চলতে থাকে মিনুর চিৎকার আর গালি। হাত ঘুড়িয়ে গাভিটারে কখনো দেয় কিল, ঘুষি, কখনো থাপ্পড়। আবার অস্থির মুখে গাভির গালে দেয় চুমা, চলতে থাকে আরো অশ্রাব্য গালাগালি–
ওই ফহিন্নির ঝি, বান্দির ঝি। এই বাড়িঘর। এই মানুষ তোর না। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই তুই পালায়ে যা। চির জনমের তারে এই বাড়ির নাম ভুলে যা। এ দুনিয়ায় তোর কেউ নাই।
উপস্থিত সকলে বাকহারা। বোবা চোখে চেয়ে আছে শুধু। গাভির গলা জড়িয়ে ধরে মিনু মিয়া কুয়াশার ঝাপসা আড়ালে ক্রমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments