ভাষা শহীদ- শহীদ বরকত । আইভি রহমান

  
    

১৯৯৯ যখন সালে ইউনেস্কো ঘোষণা দিয়েছিল আমাদের প্রাণের জাতীয় শহীদ দিবস ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম আমার চোখ ভিজে একাকার আর সেই ভেজা চোখের তারায় আমার আব্বার মুখটা কি উজ্জ্বল হাসছে!
কারণ আমি সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আব্বার কাছে গল্প শুনে বড় হয়েছি, আর আমার শোনা গল্পের ঝুলিতে রূপকথা, রাজকুমার বা আলাদীনের চেরাগের গল্প থাকত না, আমি শুনতে চাইতাম দেশের কথা, মানুষের কথা, আমাদের পতাকার জন্ম ইতিহাস, আমাদের মুখের ভাষার ইতিহাস। আমাদের জাতীয় শহীদ দিবসের ভেতরের আগুনের গল্প।

আমি নাকি খুব জ্বালাতাম আমার আব্বাকে, অনেক অনেক প্রশ্ন করতাম, এই যে আব্বা , আম্মা ডাকি এটা কে ঠিক করে দিয়েছে, কেন বাংলা হয়েছে এই ভাষার নাম। আমাদের পতাকার রঙ সবুজ আর লাল কেন।
তখন আব্বা আমাকে খুব আস্তে আস্তে বলতেন আমাদের দেশ ভাগের কথা, পাকিস্তানীদের অমানবিক এবং অনৈতিক ভাবে আমাদের উপর তাদের মুখের ভাষা চাপিয়ে দেবার কথা। আমি উত্তেজিত হয়ে যেতাম আর বলতাম, তা কেন হবে ওদের ভাষা পচা আমাদের মত আব্বা , আম্মা ডাক ওদের নেই। আব্বা বলতেন এই যে তুমি বাংলায় কথা বলতে পার, লিখতে পার, ভাবতে পার স্বাধীন ভাবে চলতে পারো এই সব কিন্তু এমনি এমনি হয়নি বাবা, এর জন্য দিতে হয়েছে অনেক অনেক প্রাণ।

কত রক্ত ঝরেছে আমাদের এই মায়ের ভাষা নিজের করে বুকের ভেতরে ধারন করতে। আমাদের মত এমন ইতিহাস আর কারো নেই।
সেই ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয়েছিল তখন পাকিস্তানের দুটো ভাগ ছিল একটা ইষ্ট পাকিস্তান যেটা এখন আমাদের স্বাধীন দেশ আমাদের বাংলাদেশ আর অন্যটা পশ্চিম পাকিস্তান। সেই সময় পাকিস্তানীরা চেয়েছিল তাদের ভাষা উর্দু আমাদের মুখে বসিয়ে দিতে।
কিন্তু চাইলেই তো হবে না তাদের আর আমাদের মধ্যে বিস্তর ব্যাবধান ছিল সব খানেই আর আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলতাম তারা ছিলাম পাকিস্তানীদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি।
তাই আমরা কিছুতেই মেনে নেইনি। দিনে দিনে বেড়েছে অসন্তোষ, বুকের ভেতরে জ্বলেছে আগুন, চোখের তারায় দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ খেলেছে বারবার।

 

তারপর ১৯৫২ সালে যখন সেই চাওয়ার উত্তাপ ছড়িয়েছে অনেকদূর আর মানুষের ভেতরে জেগেছে এক অলৌকিক আন্দোলনের হিরণ্ময়ী জোয়ার সেই সময়েই আমার আব্বার চাচা শহীদ বরকত যিনি ছিলেন আমার আব্বার সমবয়সী। সেই সময় দাদা আর আব্বা প্রবল তারুণ্যের সবুজ আগুনে জ্বলছিলেন।তাঁদের বুকের ভেতরে জ্বলছিল দাউ দাউ আগুন।
দেশ আর নিজের মায়ের ভাষার জন্য তাঁদের অন্তরেও ডেকে যায় তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার এক ডাক। তাঁরা দুজনেই মিছিলে মিছিলে আগুন জ্বেলে উত্তাল করেছিলেন ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। যেদিন দাদা শহীদ বরকত লুটিয়ে পড়েছিলেন কালো পিচের রাস্তা লাল কিংশুকের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সেদিনের কথা আমি যে কতবার শুনেছি তার হিসেব নেই।

সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই দাদা খুব উত্তেজিত ছিলেন। আব্বা আর দাদা হলে থাকতেন তাঁরা দুজনেই সবে মাত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। নিজেদের আদিবাস মুর্শিদাবাদের ‘কাগ্রাম’ নামক গ্রামের শেকড় ছেড়ে এই শহরে এসেছিলেন পড়াশুনা করতে। নিজের  এবং পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে।
সেই সকালে দাদা বারবার তাড়া দিয়েছিলেন আব্বাকে যে জলদি বেরুতে হবে আজ অনেক বড় মিছিলের আয়োজন হয়েছে আর আমাদের সামনের সারিতে থেকে স্লোগান দিতে হবে।
আব্বা খুব ফ্যাশান দুরস্ত একপ্রান ছিলেন তিনি তখনও চুলে বিলি কাটছিলেন তাই আব্বাকে বার বার তাগাদা দিচ্ছিলেন দাদা বলেছিলেন , বাবু মিছিল চলে এলো বলে, আর তুই এখনও দিলিপ কুমারই গিরি করতে থাকবি, আব্বা বুঝতে পেরেছিলেন দাদা রেগে যাচ্ছেন তাই বলেছিলেন, তুমি যাও আমি দৌড়ে গিয়ে মিছিলের সামনের সারিতে পৌঁছিয়ে যাব।
আব্বা চুলের সজ্জা সেরে যখন মিছিলে যোগ দিতে ছুটে গেছেন ততক্ষণে দাদার রক্তাক্ত শরীর কালো পীচের বুকের উপর লুটিয়ে পড়েছে। আব্বা সেই লাল রক্ত স্রোত দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যান।
আর সেদিনের পর থেকে আব্বা আর কোনদিন মেডিক্যাল কলেজে ফিরে যাননি। পড়েননি ডাক্তারি। আব্বা পরে ভর্তি হয়েছিলেন অংকশাস্ত্রে।

২০০০ সাল থেকে যখন প্রায় সারা পৃথিবী আমাদের সাথে পালন করা শুরু করল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ সেদিন বুঝতে পারি আমি কতটা ধারন করে আছি আমার আব্বার কথা, আব্বা সব সময় বলতেন, তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমার প্রতিদিনের সকালে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করবে যে তোমার পতাকা আর তোমার মায়ের ভাষার অসম্মান করার স্পর্ধা যেন কোন দিন কারো না হয়। যে কোন মুল্যে তুমি তা প্রতিহত করবে।
মনে রাখবে তোমার পরিবার এই রক্তের স্রোতে মিশে আছে। ওই পতাকায় তোমার দাদার রক্ত মিশে আছে, এই অহংকার তোমাকে যেন উদ্ধত না করে নম্রতা এনে দেয় তোমার জীবনের সবখানে।
সেই থেকে আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় নতজানু, সেই থেকে আমার কেবলই চোখ ভিজে যায়- আমার চোখ ভিজে থাকে এক অন্য রকম আলোর বন্যায়।
আমি হিরণ্ময়ী গর্বের আলোতে আলোকিত বিনম্র অহংকারী এক শহীদ পরিবারের সদস্য। যে ত্যাগ আমাকে দিয়েছে উদ্ধত অবিচল থাকার মন্ত্রণা। মাথা নত না করার সুযোগ্য শিক্ষা। যে রক্ত আমাকে দিয়েছে দ্রোহের সুনাম।
আমি অন্তরের সবটুকু শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সমস্ত ভাষা শহীদদের যাদের রক্তে আমাদের মায়ের ভাষা আজ বিশ্বময় এক বিস্ময়।
তাবৎ দুনিয়ায় সকল মায়ের ভাষা উজ্জ্বল থাকুক নিজের গৌরবে, নিজস্ব কর্মে আর বলিদানে।
আমার মায়ের ভাষা ‘বাংলা ভাষা’ অমর হোক।


আইভি রহমান
কথাসাহিত্যিক, সমাজকর্মী
ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments