সবুজ পাহাড় মেঘকে ডেকে বললো- তুই আমায় এভাবে ভেজালি!
মেঘ মৃদু হেসে উত্তর দিলো- ভেজালাম কোথায়?
একটু না হয় ছুঁয়েই দিলাম, সফেদ-শুভ্রতায়।
মেঘ-পাহাড়কে ছুঁয়েছিলো বলে পাহাড় কতটুকু ভিজেছিলো জানি না, তবে আমি ভিজেছিলাম পুরোপুরি। সাজেক ভ্যালির পাহাড় আর মেঘ আমার মনকে ভরিয়ে দিয়েছিলো এক অনাবিল আনন্দে। সবুজ পাহাড়ের বুকে পেজো তুলোর মত সাদা মেঘের চাঁদর আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিলো দীর্ঘক্ষণ। অতি সাধারণ একজন মানুষ আমি। ভালোবাসি ভ্রমণ করতে আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে। মাত্র ক’দিন আগে ঘুরে এলাম সাজেক ও কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি। যেখানেই যাই, যা কিছু দেখি সবার সাথে শেয়ার করতে ভালোবাসি বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন- ভ্রমণ তোমাকে প্রথমে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে। আমিও আজ সাজেক আর রাঙামাটি ভ্রমণের গল্প সবার সাথে শেয়ার করছি।

মেয়ের পরীক্ষা শেষ। এদিকে বছরও শেষ হয়ে আসছে, তবে শীত তেমন জেঁকে বসেনি এখনও। অফিস কলিগ মাসুদ ভাই একদিন প্রস্তাব রাখলো- চলেন ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরে আসি নতুন কোন জায়গা থেকে। তার মেয়েদেরও পরীক্ষা শেষ। ঠিক হলো- অফিসের কাজের চাপ কিছুটা কমে এলে বেরিয়ে পড়বো। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? কক্সবাজার, কুয়াকাটা, রাঙামাটি, সিলেট, টাঙুয়ার হাওর- এসব জায়গায় ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছি। তবে সাজেক কিংবা বান্দববান যাওয়া হয়নি। ইদানীং অনেকেই দেখছি সাজেক ভ্যালী ঘুরে আসছে। এবার তাহলে ঘুরে আসা যাক মেঘের দেশ সাজেক থেকে। মাসুদ ভাইয়ের একই কথা- সাজেকেই যাওয়া যাক। তবে সাজেকে দেখার মত যা আছে তার জন্য দু’দিনই যথেষ্ট। সাজেক যেতে হলে খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হয়, আর খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটির দূরত্ব খুব বেশি নয়। মাসুদ ভাইয়ের যেহেতু রাঙামাটি যাওয়া হয়নি, তাই ঠিক হলো- ঢাকা থেকে সাজেক ঘুরে আমরা সরাসরি রাঙামাটি চলে যাবো। আমাদের ট্যুর প্ল্যান ফাইনাল হলো- ১১ই ডিসেম্বর রাতে আমরা ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবো, আর ১৫ই ডিসেম্বর রাতে রাঙামাটি থেকে ঢাকা ফিরবো।
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি থেকে ঢাকা ফেরার জন্য সেন্টমার্টিন পরিবহনের এসি বাসের টিকিট কনফার্ম করা হলো। এবার হোটেল বুকিং। বন্ধু সাত্তারের সহায়তায় সাজেকে হোটেল বুকিং সম্পন্ন হলো, আর আলমগীরের বিআরডিবির খাগড়াছড়ি অফিসের লোকজনের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকে যাওয়া-আসার জন্য একটা মাহিন্দ্র (স্থানীয় লোকজন বলে চাঁদের গাড়ি) ভাড়া করা হলো। আমি রাঙামাটিতে পর্যটনের মোটেলে রুম বুক করে ফেললাম। ব্যাস, আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন, এবার শুধু নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়া।
১১ই ডিসেম্বর রাতে কলাবাগান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। সবাই পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র সাথে নিয়েছি। ঢাকায় তেমন শীত না পড়লেও সমতল থেকে ১৮০০ ফুট উপরে সাজেক ভ্যালীতে শীতের মাত্রা কেমন আমাদের জানা নেই। হঠাৎ সাজেকে যাওয়া নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম। কিছুক্ষণ পর বন্ধু ড. মাকসুদের ফোন। ওরা তখন বান্দরবান যাচ্ছে। হয়তো সেই মুহূর্তে ওদের বাস আমাদের কাছাকাছি কোথাও ছিলো। কিছুটা আফসোস হলো। আগে জানলে হয়তো ট্যুর প্ল্যান চেঞ্জ করতে পারতাম। এ যাত্রায় আমরাও ওদের সাথে বান্দরবান ঘুরে আসতে পারতাম। পরে সময় বুঝে সাজেকে যাওয়া যেতো। যাই হোক, আমাদের গাড়ি ঘুটে চলেছে চেনা পথে। এই পথে বহুবার ঢাকা-চিটাগাঙ জার্নি করা হয়েছে। তবে এখন রাস্তা ওয়ানওয়ে, লেন সংখ্যাও বেড়েছে, তাই গাড়ির গতিও আগের তুলনায় বেশি। বাসের মধ্যে ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে গেছে। আমি কিছুক্ষণ পর পরই দেখছি মেয়ের ঠাণ্ডা লাগছে কি-না, কারণ ওর এমনিতেই কোল্ড এলার্জির সমস্যা আছে, তাই টুপি, মাফলার দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়েছি। মাসুদ ভাইও তাই করলো। রাত দেড়টার দিকে আমাদের বাস কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে হোটেল অফ-বিটে যাত্রা বিরতি করলো। আমরাও ওখানে নামলাম। ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম সবাই। প্রায় বিশ মিনিট পর আবার শুরু হলো আমাদের যাত্রা। ফেনী এসে আমাদের গাড়ি দিক পরিবর্তন করলো। ঢাকা-চিটাগাঙ হাইওয়ে ছেড়ে গাড়ি খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে বাম দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়লো। এদিকের রাস্তা ঢাকা-চিটাগাঙ হাইওয়ের মত অতটা স্মুথ নয়, কিছুটা সরুও বটে, তবে রাস্তা ফাঁকা থাকায় তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না।
সমস্যা শুরু হলো যখন আমাদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় প্রবেশ করলো। উচু-নিচু রাস্তায় অসংখ্য বাঁক, সেইসাথে ড্রাইভারের বেপরোয়া ড্রাইভিং। গাড়ি পাহাড়ি পথ ধরে কখনও উপরে ওঠে আবার নিচে নেমে আসে। এভাবেই এগিয়ে চলছিলো। আমরা ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বললাম। বিশেষ করে বাঁকগুলো ক্রস করার সময়। তবে খুব একটা কাজ হলো না। যাত্রীদের কথায় গতি কমালেও কিছুক্ষণ পর আবার ড্রাইভার আগের অবস্থায় চলে গেলো। কখনও কখনও মনে হচ্ছিলো এই বুঝি গাড়ি উল্টে খাদে পড়লো! যাত্রীদের মধ্যে বয়স্ক একজন হাঁক ছাড়লো ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে- এই ড্রাইভার, তোমাকে না আস্তে চালাতে বলেছি! এবার কিছুটা কাজ হলো। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি আস্তে চললো। বিশেষ করে বাঁকগুলোতে ড্রাইভার সাবধানে গাড়ি ঘোরালো। আমরা পাহাড়ি রাস্তায় ক্রমশঃ উপরে উঠছিলাম। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো সমতল থেকে কয়েকশ ফুট উপরে। তবে কিছুক্ষণ পরই গাড়ি আবার নামতে শুরু করলো। এক সময় নেমে এলো সমতলে। আমরা যখন মাটিরাঙা নামক এক জায়গায় পৌঁছেছি, তখনই শুরু হলো আরেক বিপত্তি। গাড়ির টায়ার পাঙচার! তখন আমরা খাগড়াছড়িতে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল থেকে মাত্র পনেরো মিনিট দুরত্বে। কি আর করা! শুরু হলো স্পেয়ার চাকা লাগানোর কাজ। গাড়ি ঠিক হতে একঘণ্টার বেশি সময় লাগলো। আমরা প্রায় সোয়া সাতটার দিকে খাগড়াছড়ি পৌঁছালাম।
আলমগীর নেওয়াজের বিআরডিবি অফিসের ড্রাইভার মান্নান ফজরের নামাজের পর থেকেই চাঁদের গাড়ি (মাহিন্দ্র) নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমরা যখন অরণ্য বিলাস রিসোর্টের সামনে বাস থেকে নামলাম তখন দেখলাম অসংখ্য পর্যটক রাস্তায় ভিড় করে আছে। এরা সবাই সাজেকে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে, কারণ পথে আর্মিদের চেকিং, যা বেলা দশটার আগে সম্পন্ন হয় না; আর আর্মি চেকিং ছাড়া কোন পর্যটকের গাড়ি সাজেকের রাস্তায় যেতে পারে না। আমরা সবাই স্থানীয় রেস্টুরেন্টে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা মাহিন্দ্র নিয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো। এই মাহিন্দ্র ভাড়া করার ক্ষেত্রে মান্নান আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। আমরা এই গাড়ি নিয়ে সাজেকে যাব, ওখানে আজ সারাদিন আর রাত্রি যাপন করে আগামীকাল সকালে আবার খাগড়াছড়ি ফিরবো। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে বেলা তিনটার দিকে এই গাড়ি নিয়েই রাঙামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে আমাদের গাড়ি খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে চলতে শুরু করলো। নতুন জনপদ আর মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলছিলাম। আমাদের মাহিন্দ্রর ড্রাইভার ও তার সহকারী- দু’জনই স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। ড্রাইভার চাপাই মারমা বেশ হাসিখুশি ও ভদ্র, ড্রাইভার হিসেবেও দক্ষ আর তার সহকারী বাবু চাকমা কম কথা বললেও তার সাথে সাথে কথা বলে তাদের কালচার, জীবনধারা সম্মন্ধে বেশ কিছু মজার তথ্য জানা গেলো। চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা ছুটে চলছিলাম। হঠাৎ ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে গেলো। চারিদিক থেকে একটা হিম-শীতল বাতাস আমাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো। বাচ্চাদের ঠিকমত ঢেকে দিলাম। আরও কিছুটা পথ সামনে এগোনোর পর বাঘাইহাটে এসে আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। সামনে আর্মি চেকিং। এখানে নাম রেজিস্ট্রি করতে হবে। আমি এগিয়ে গিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করে এলাম। বাবু চাকমা জানালো এখানে চেকিঙের পর আর্মিদের এস্কর্ট যাবে বেলা দশটার দিকে। তখন গাড়ি ছাড়বে। আমরা কিছুটা হতাশই হলাম কারণ দশটা বাজতে এখনও অনেক সময় বাকি। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। স্থানীয় লোকজন নানা রকম সওদা ফেরি করে বেড়াচ্ছে। পেঁপে, জাম্বুরা, আঁখ, কলা ইত্যাদি। আমরা কিছু কলা কিনলাম। মাসুদ ভাই কিছুটা সামনে এগিয়ে বড় সাইজের তিনটা পাকা পেঁপে কিনলো মাত্র একশ টাকায়। পাশের দোকানে বাঁশের চা বিক্রি হচ্ছে। ‘বাঁশের চা’ বলতে আসলে কাপের পরিবর্তে বাঁশের চোঙায় করে চা দিচ্ছিলো দোকানি। মেয়েরা সেই বৈচিত্র্যময় বাঁশের চা খাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। আমরা দোকানে গিয়ে দেখলাম চা শেষ। আশেপাশের লোকজন জানালো সাজেকেও পাওয়া যাবে এই চা। মেয়েদেরকে তাই বোঝালাম- ‘সাজেকে গিয়ে বাঁশের চা খাওয়াবো’। ওরা মেনে নিলো।
কিছুক্ষণ পরই আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলো। যতই সামনে এগোচ্ছিলাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী বদলে যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে পাহাড়ি এলাকা দৃশ্যমান হচ্ছিলো। গতরাতে খাগড়াছড়ি আসার পথে রাস্তায় যে ধরনের বাঁক ছিলো এখন তার থেকেও বেশি। তবে গতরাতে অন্ধকারে প্রকৃতি ছিলো আমাদের দৃষ্টির বাইরে আর আজ দেখছি অন্যরকম এক বাংলাদেশ। রাস্তার দু’পাশে চোখ জুড়ানো অপার সৌন্দর্য। শুধু সবুজ আর সবুজ। বহুদূর পর্যন্ত উঁচুনিচু সবুজ পাহাড়, গিরিখাত, আর অনেক নিচে সরু জলধারা আঁকাবাঁকা পথ ধরে বয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যে। এ যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর এক রূপকথার রাজ্য। এই সবুজের মধ্যেই সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা পাহাড়ের বুক চিরে ছুটে চলেছে। কখনও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সর্পিল গতিতে উপরে উঠে যাচ্ছে আবার কখনও ঢাল বেয়ে নিচে নামছে। যাত্রার পূর্বে আমি কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম এই ভেবে যে বাচ্চারা হয়তো পাহাড়ি পথে চলতে ভয় পাবে, তবে এখন দেখছি- না, ওরা ভয় তো পায়ই-নি, বরং প্রত্যেকেই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলো; যেন ওরা রোলার কোস্টারে চড়েছে।

আমাদের মাহিন্দ্রর সহকারী বাবু চাকমা হঠাৎ দূরে একটা পাহাড়ের দিকে ইশারা করে দেখালো “ঐ যে পাহাড়টার উপরে একটা সাদা ঘর দেখা যাচ্ছে, ওটাই সাজেক; আমরা ওখানেই যাবো” আমরা সবাই উৎসুক হয়ে সেদিকে তাকালাম। আমি জানতে চাইলাম- আর কতক্ষণ লাগবে? ও জানালো- আরও আধাঘণ্টা। তবে বাবুর সেই আধাঘণ্টা শেষমেশ ৪৫ মিনিটে শেষ হয়েছিলো।
আমরা ছুটে চললাম সাজেকের পথে। মাহিন্দ্র খুব দ্রুতগতিতে চলছিলো। আমি চলন্ত গাড়ি থেকে স্থির ছবি তুলছিলাম, তবে গাড়ির দ্রুত গতি আর রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ের (রাস্তার দু’পাশে নলখাগড়ার মত অসংখ্য গুল্ম এবং সেসব গাছে কাশফুলের মত গোলাপি রঙের ফুল) জন্য মনের মত ছবি তুলতে পারছিলাম না। যাই হোক প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছালাম। বাবু তখন জানালো- এখন আমরা শুধু উপরে উঠবো। আমরা লক্ষ করলাম রাস্তাটা যেন হঠাৎ খাড়া হয়ে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে উপরে উঠে গেছে। চাপাই মারমা যে একজন সুদক্ষ ড্রাইভার তা আমরা আবার টের পেলাম। সেই খাড়া পথ বেয়ে কেমন সুচারুভাবে একই গতিতে উপরে উঠে যাচ্ছে সে। আমার যতটুকু মনে হয়েছে কখনও কখনও সেই পথ ৫৫ থেকে ৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত এঙ্গেলে উঠে গিয়েছে। এভাবে প্রায় পাঁচ মিনিট ওঠার পর আমরা পাহাড়ের উপরে পৌঁছে গেলাম। বাবু জানালো- এটাই সাজেক। আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। আমি চারপাশে তাকিয়ে দোকানপাটের সাইনবোর্ড দেখলাম। হ্যা, আমরা পৌঁছে গেছি সেই রুইলুই পাড়া, সাজেক ভ্যালী। কিছুক্ষণের মধ্যে মাহিন্দ্র এসে দাঁড়ালো আমাদের নির্ধারিত হোটেল সাজেক বিলাসের সামনে।
আমাদের রুমের সামনেই কিছুটা খোলা ছাদ। মালামাল রুমে রেখে আমি করিডোর ধরে এগিয়ে খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। সামনে এবং চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি, আর সেই সবুজ পাহাড় তার ভাঁজে ভাঁজে ধরে রেখেছে এক অপার সৌন্দর্য। অনেককেই বলতে শুনেছি- সাজেকের রূপ তার সবুজ পাহাড়ে আর সাদা মেঘে। এখন দেখলাম কথাটা সত্য। প্রকৃতি যেন খুব যত্ন করে সাজিয়েছে এই পুরো এলাকা। এখানে না এলে প্রকৃতির এই অসাধারণ সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম।

গতকাল রাত থেকে জার্নির ধকল, তাই গোসল করাটা জরুরি। তবে পানি বেশ ঠাণ্ডা। কিচ্ছু করার নেই, অভ্যেস না থাকলেও আজ সেই ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল সেরে নিলাম। স্ত্রী-মেয়েকে বললাম তোমরা গোসল করে রেডি হও, আমি একটু ঘুরে আসছি। মাসুদ ভাইও রেডি হচ্ছেন। আমি চারপাশটা একটু দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রকৃতির পাশাপাশি স্থানীয় আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনযাত্রার প্রতিও আমার কিছুটা আগ্রহ আছে।
সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া। রুইলুই পাড়ায় ঢুকে কিছুদূর এগিয়েই সাজেকের মূল পর্যটন এরিয়া শুরু। এই স্থানটা মূলতঃ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত। সাজেকের শুরুতেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিজিবি ক্যাম্প। এখানে একটি হেলিপ্যাড আছে। আরও সামনে এগোলে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যে গ্রামটি দেখা যায় ওটাই সাজেকের শেষ গ্রাম, নাম কংলাক পাড়া। বিকেলে আমরা কংলাক পাহাড়ে যাবো। সাজেকে প্রচুর হোটেল আর রিসোর্ট হয়েছে; এখানকার ঘরগুলো বেশির ভাগই লাল-নীল-সবুজে রাঙানো। কিছু পাকা বিল্ডিং আর বেশ কিছু টিন আর ছনের তৈরি কটেজ। বেশির ভাগ হোটেল রিসোর্টেই রয়েছে পাহাড়ের দিকে মুখ করা ঝুল বারান্দা, যেখান থেকে দূরে তাকালে সবুজ পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। ফুটপাথের পাশে নানান রকম ফলমুল আর শাক সব্জি নিয়ে বসেছে আদিবাসী নারী-পুরুষ। এ সবই তাদের নিজস্ব বাগানে ফলানো। হোটেলে ফিরে দেখি মাসুদ ভাই তৈরি হয়ে গেছে। মেয়েরা খোলা ছাদে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা লাঞ্চে যাব।
সবাই তৈরি হয়ে এলে আমরা লাঞ্চে বের হলাম। হোটেলে পৌঁছেই দুপুরের খাবার বুকিং দিয়ে গিয়েছিলাম। এখানে আগে থেকে বুকিং দিয়ে না রাখলে খাবার পাওয়া কষ্টকর। খাবার দামটাও কিছুটা বেশি। আমার হাঁসের মাংস খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো, তবে মেয়েরা কেউ খেতে রাজি ছিল না, তাই মুরগি, সবজি, আলু ভর্তা, ডাল বুকিং দেয়া ছিলো। আমরা হোটেলে পৌঁছে দেখি- প্রচুর ভিড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর টেবিল খালি পাওয়া গেলো। খেতে গিয়ে কেউ তেমন খুশি হতে পারলো না। তাদের কাছে খাবার মজা লাগেনি। লম্বা জার্নির পর পেটে বেশ ক্ষুধা ছিল, তাই আমার তেমন খারাপ লাগেনি। যাই হোক, লাঞ্চ শেষে আমরা আশপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। রাস্তার দু’দিকে যেখানেই তাকাই শুধু সবুজ পাহাড়। অবশ্য এমনটাই তো হবার কথা! এখন তো আর মেঘ দেখা যাবে না। মেঘ দেখার জন্য আগামীকাল সকালটা বরাদ্দ থাক। আমরা হোটেলেই ফিরে গেলাম। কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।
কেউ কেউ শুয়ে রেস্ট নিলেও আমি খোলা ছাদে চলে এলাম। এখান থেকে সাজেকের একপাশের পুরোটা দেখা যায়। পাহাড়ে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য লাল-নীল-সবুজ রঙ করা কাঠ আর টিনের তৈরি কটেজ, যেখান থেকেও এই মেঘের রাজ্যের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমার মেয়ে পেছনে এসে দাঁড়ালো। বাবা, ঐদিকটায় কি? আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো। আমি বললাম- ওদিকটায় ভারতের মিজোরাম। সে বেশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো- ভারত এত কাছে? আই বললাম- হ্যা, আমরা এখন ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারের কাছাকাছি। একে একে অন্যরাও ছাদে এসে দাঁড়ালো। মাসুদ ভাই বললো- চলেন কংলাকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি, আবার ফিরতে হবে তো।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। আমাদের সেই মাহিন্দ্র হোটেলের সামনেই দাঁড়ানো। সবাই উঠে বসলে চাপাই মারমা গাড়ি ছেড়ে দিলো। বাবু জানালো এদিকে একটা হেলিপ্যাড আছে, তবে আমরা সেখানে না গিয়ে আরও সামনে কংলাকের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। ওখান থেকে ফিরে হেলিপ্যাডে যাবো। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি থেমে গেলো। বাবু জানালো- গাড়ি আর যাবে না, এবার হেঁটেই যেতে হবে। কি আর করা! আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। এখান থেকেই পাহাড়ে ওঠা শুরু। পথে দেখা গেলো কয়েকজন বাঁশের লাঠি বিক্রি করছে। দেখলাম যারাই পাহাড়ে উঠছে সবার হাতে বাঁশের লাঠি। আমরা প্রত্যেকে একটা করে লাঠি নিয়ে নিলাম। মাটির রাস্তা ধরে উঁচুনিচু পথে এগিয়ে চললাম। আমরা ক্রমশঃ উপরে উঠছিলাম আর পথের দু’পাশে ভয়ঙ্কর সুন্দর সবুজ পাহাড়ের মাঝে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বাচ্চারা সবার আগে আগে উৎফুল্ল চিত্তে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। যেন এটা একটা মজার খেলা। আমি সবার পেছনে পেছনে যাচ্ছিলাম এবং ওদের থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ছিলাম, কারণ আমি সামনে এগোচ্ছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। যেদিকেই তাকাচ্ছি, মনে হচ্ছে এ জায়গাটার ছবি তুলে রাখি। ওরা বেশ সামনে চলে গেছে। আমি কিছুটা দ্রুত ছুটতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম। একসময় ওদের ধরে ফেললাম। লাঠিসোঁটাসহ ওদের কিছু ছবি তুলে রাখলাম। কিছুটা রেস্ট নিয়ে আবার এগিয়ে চলা। একসময় চূড়ার কিছুটা আগে সবচেয়ে উঁচু খাঁড়া অংশের গোরায় উঠে আসলাম, তবে এর পরের পথটা বাচ্চাদের যাওয়ার উপযোগী নয়। তাই আমরা আর এগোলাম না। ওখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। পাহাড়ের চূড়ায় কংলাক গ্রামে আর যাওয়া হলো না আমাদের। এ নিয়ে আফসোস নেই, বাচ্চারা বেশ মজা পেয়েছে, এতেই খুশি। নামতে গিয়ে আমাদের বেশ সাবধানী হতে হলো। ওঠাটা কঠিন ছিলো, তবে নামাটা যতটা সহজ ভাবছিলাম ঠিক ততটা নয়। কোথাও কোথাও বেশ খাঁড়া। একটু অসাবধান হলে বিপদ হতে পারে, তাই বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। নামার সময় লাঠিটা বেশ কাজে দিয়েছে। এভাবেই একসময় নেমে এলাম। আমাদের কংলাক ভ্রমণ শেষ।
হোটেলের সামনে এসে বাচ্চারা সেই বাঁশের চা খাওয়ার বায়না ধরলো। সবাই মিলে চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানির বাঁশের চা বানানোর কৌশল দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। একটা বাঁশের চোঙায় দুধ-চিনি দিয়ে তার মধ্যে গরম চায়ের পানি ঢেলে দিলো, তারপর চিকণ বাঁশের কঞ্চির তৈরি এক ধরনের ঘুটনি দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি আর মাসুদ ভাই হাসলাম। এই তাহলে বাঁশের চা! তবে বাচ্চারা বেশ মজা পাচ্ছিলো। বাঁশের চা খাওয়া শেষ, এবার কি করা যায়? চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, এখন কোথাও গিয়ে লাভ নেই। চাপাই মারমা জানতে চাইলো- রাতের খাবার কোথায় খাবো। আমরা দুপুরে যেখানে খেয়েছি সেখানে আর খেতে চাইলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- নতুন ধরণের খাবার কোথায় আছে? পেদা টিন টিনে যেতে পারেন, ওখানে ব্যাম্বু-চিকেন পাওয়া যায়। সবাই ব্যাম্বু-চিকেন খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। আমি আর মাসুদ ভাই চললাম ব্যাম্বু-চিকেনের বুকিং দিতে। অনেকটা পথ হাঁটতে হলো, তবে রাতের খাবারের বুকিং দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। আমি ছাদে গিয়ে বসলাম। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। ঢাকায় শীত এখনও শুরু হয়নি কিন্তু সাজেকে বেশ শীত। ব্লেজারের সাথে মাফিলারও পড়তে হচ্ছে।
মাসুদ ভাইকে ছাদে দেখে আমি বলে উঠলাম- ইটালিয়ান জ্যাকেট পরে তো দেখি পুরাই প্যাকেট হয়ে গেছেন! মাসুদ ভাই হেসে বললো- শীত তো কম না। আমার মেয়েকেও সোয়েটার টুপি, গলাবন্ধ পরিয়ে দিয়েছে তার মা। দূরে কুয়াশা জমেছে, ছাদ থেকে এখন আবছাভাবে পাহাড় দেখা যায়, তবে মেঘের দেখা এখনও পাইনি। হোটেলের বয়টাকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো- কাল সকালে দেখতে পাবেন। আমি জানতে চাইলাম- ক’টায় উঠতে হবে? সাড়ে পাঁচটায় উঠলেই দেখতে পাবেন। আমি মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখলাম। রাতে পেদা টিন টিনে খেতে গিয়েও দুপুরের মত হতাশ হতে হলো। সব্জিটাই যা একটু মজা হয়েছে, বাকী রান্নাটা যাচ্ছে-তাই। ব্যাম্বু-চিকেন কারো কাছেই মজা লাগেনি। যাই হোক, রাতের খাবার শেষে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম এবং সকালে মেঘ দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এলার্ম বাজবার আগেই ভোর পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। মেঘ দেখার লোভে কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে বেরিয়ে অনুভব করলাম ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ। কুয়াশাও জমেছে। চারপাশ ঘোলাটে লাগছে এখন। সামনে তাকিয়ে দেখলাম কোন সবুজের চিহ্ন নেই, সামনের পুরা এলাকাই সাদা। আমি কিছু ছবি তুললাম, তবে কুয়াশার জন্য মেঘ ভালমত দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে আবছায়া আঁধার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম লোকজনের সাড়া নেই। আমি তখনকার মত ভেতরে চলে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম ঘণ্টাখানেক পরে উঠে মেঘ দেখবো।

মেয়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেলো আবার। বাবা, মেঘ দেখবে না? দেখো কি সুন্দর মেঘ জমেছে! আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম- তুমি দেখেছো? তাকে খুব উচ্ছ্বাসিত দেখে বুঝলাম- সে মেঘ দেখে খুব খুশি। ওর এই আনন্দে আমিও খুশি। আবার কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ছাদে গিয়ে আমি নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম। ভোরে যখন এখানে এসেছিলাম তখন একেবারেই বোঝা যায়নি। এখন দেখছি আমি একটা মেঘের নদীর সামনে দাঁড়িয়ে! কী অসাধারণ ! আমাদের সামনে যে সবুজ গিরিখাতটা ছিলো সেটা এখন নেই! ওখানে শুধু তুলোর মত সাদা মেঘ। দূরের পাহাড়গুলোও মেঘে ঢেকে আছে। আমার মনে হলো এই যে এত পরিশ্রম, ধকল সহ্য করে আমরা এতদূর এলাম- সেটা এখন সার্থক হলো। এদিকে-ওদিকে যেদিকেই তাকাই একটা নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ; মনে হচ্ছে একটা মেঘের নদী বহুদূর পর্যন্ত বয়ে গেছে। আকাশ-পাহাড় আর মেঘের অদ্ভুত এক মেলবন্ধন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি, সবুজ পাহাড় আর মেঘের মিতালী দেখি। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। তারপর বেশ কিছু ছবি তুললাম। চারিদক পরিষ্কার হয়ে এসেছে তবে সূর্য এখনও ওঠেনি। আমরা অপেক্ষা করছিলাম সুর্য ওঠার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘ-কুয়াশার চাঁদর সরিয়ে পূব দিগন্তে সূর্য যখন উঁকি দিলো আমার মেয়ের সে কী আনন্দ! সে পুরো দৃশ্যটি ভিডিও করতে শুরু করলো। সূর্য একটু একটু করে বড় হতে হতে যখন গোল থালার মত রুপ নিলো- সে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো- দেখো বাবা, কেমন লাল টুকটুকে সূর্য উঠেছে! তখনই আমার মনে পড়লো- এই প্রথম সে সূর্যোদয় দেখছে। মাসুদ ভাইয়ের মেয়েরাও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের মাত্রাও কম নয়, হয়তো এটা ওদেরও প্রথম সূর্যোদয় দেখা।

মেঘকন্যা সাজেকে আমাদের সময় ফুরিয়ে এলো, এবার ফেরার পালা। খাগড়াছড়ি ফিরে ওখানকার কিছু স্পট ঘুরে আজ বিকাল তিনটার মধ্যে আমাদের রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। চাপাই চাকমা জানালো দেরি করলে পাহাড়ি পথে রাঙামাটি যেতে সমস্যা হবে। সকাল দশটায় এখান থেকে আর্মি এস্কর্ট ছাড়ে। আমাদের তাদের সাথেই যেতে হবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বেরিয়ে পড়লাম। নাস্তা সেরে হোটেলে ফিরে সবাইকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললাম। মেয়েদের তৈরি হতে কিছুটা সময় বেশি লাগে, তাই আমি আর মাসুদ ভাই তাড়া দিচ্ছিলাম। সময়ের নিঁখুত হিসেব করেও বেলা সাড়ে ন’টার আগে আমরা বের হতে পারলাম না। তাই গাড়ির সিরিয়ালে অনেকটা পেছনে পড়ে গেলাম। যাই হোক, আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমরা সাজেক ভ্রমণ শেষে ফিরে চললাম পরবর্তী গন্তব্য খাগড়াছড়ির পথে। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমাদের গাড়ি যখন নামছিলো, প্রথমে কিছুটা ভয় ভয় লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা কেটে গেলো। মেয়েরা এবারও ভয় পাবার পরিবর্তে মজাই পাচ্ছিলো। খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে খুব দ্রুতবেগে নেমে আসছিলো গাড়ি। আমরা খুব শক্ত করে সামনের সিটের হ্যাণ্ডেল ধরে রাখছিলাম। রাস্তার দু’পাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চিরদিন আমার মনস্পটে আঁকা থাকবে। অনেকটা পথা আসার পর আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। বাবু জানালো- সামনে জ্যাম। এখানে আর্মিরা পালা করে গাড়ি ছাড়ে। কিছুক্ষণ সাজেক আসার গাড়ি ছাড়ে এবং কিছুক্ষণ যাওয়ার গাড়ি। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে আসা গাড়ির লম্বা লাইন। ক্রমাগত গাড়ি আসছে তো আসছেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে ছিলাম আমরা। তারপর আবার চলতে শুরু করলো। চাপাই মারমা সময় বাঁচানোর জন্য খুব দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিলো, তবে আমাদের খাগড়াছড়ি পৌঁছুতে প্রায় দুপুর দু’টো বেজে গেলো। হাতে সময় আর বেশি নেই। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। লাঞ্চ সেরে যতটা সম্ভব খাগড়াছড়িতে দেখার মত স্পট দেখে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। খাওয়া শেষ হতে বেলা আড়াইটা পার হয়ে গেলো। চাপাই মারমা জানালো- রাঙামাটি যেতে হলে আপনারা এখানকার একটি মাত্র স্পটে যেতে পারবেন। খাগড়াছড়ির বিখ্যাত সেই রিসাং ঝর্ণা দেখা হলো না আমাদের। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আলুটিলা পাহাড়ের গুহা দেখে সোজা রাঙামাটি চলে যাবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আলুটিলা পাহাড়ের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে একটু সামনে এগিয়ে পর্যটকদের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তার পাশেই রেলিঙ দেয়া একটি গোলাকার পাকা চত্বর, যেখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের প্রায় সবটুকুই দেখা যায়। লোকমুখে শোনা যায় এটি খাগড়াছড়ির সবচেয়ে উঁচু পর্বতশ্রেনী। সন্ধ্যার পর এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের দৃশ্য দেখার মজাই আলাদা। আমর সবাই এই চত্ত্বরে কিছু ছবি তুললাম। যাই হোক আমরা আমাদের মূল গন্তব্য আলুটিলা গুহার দিকে এগিয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নামছি তো নামছিই। অসংখ্য ধাপ অতিক্রম করে আমরা পাহাড়ের পাদদেশ তথা গুহামুখের কাছে পৌঁছালাম। তবে গুহামুখে পৌঁছে বেশ হতাশই হলাম, কারণ আমরা কেউ গুহায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। ভেতরটা অন্ধকার, পিচ্ছিল এবং স্যাঁতসেঁতে। মাসুদ ভাই একবার চেষ্টা করে ফিরে এসে জানালো ভেতরে পানি আছে। তাছাড়া সাথে মহিলা ও বাচ্চারা থাকায় গুহায় প্রবেশের চিন্তা বাদ দিলাম।
আশপাশটা ঘুরে দেখে আমরা ফিরে চললাম। গুহায় নামতে গিয়ে সবাই যে রকম আনন্দ পেয়েছিলো উপরে উঠতে গিয়ে টের পেলো ওঠাটা কত কষ্টকর। সবাই মোটামোটি হাঁপিয়ে উঠলাম। প্রায় তিন’শর কাছাকাছি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। যাই হোক, কিছু সময় রেস্ট নিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। আমরা গাড়িতে উঠতেই চাপাই মারমা রাঙামাটির পথে চলতে শুরু করলো। খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলাম, চলতে গিয়ে তেমন মনে হচ্ছে না। রাস্তায় প্রচুর বাঁক আর উঁচুনিচু। পথ সমস্যার কারণ না হলেও বাঁক গুলোই ভোগাচ্ছে বেশি। গাড়িতে বসে থাকাই কষ্টকর। চাপাইকে বললাম একটু আস্তে চালাতে। কখনও সবুজ পাহাড় আবারর কখনও সমতল ভুমি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের ঢালে আনারসের চায হচ্ছে, কোথাও নতুন চারা লাগানো হচ্ছে। সেগুলো দেখে বাচ্চাদের নানা প্রশ্ন, উত্তর দিতে হচ্ছে। রাস্তা মোটামাটি নির্জনই বলা যায়। চাপাই মারমা সন্ধ্যার আগে রাঙামাটি পৌঁছুতে চায়, তাই গাড়ি বেশ দ্রুত চালাচ্ছিলো। পথে দু’জায়গায় আর্মি চেকিঙের জন্য গাড়ি থামালো। ড্রাইভারকে কিছু রুটিন প্রশ্ন করে ছেড়ে দিলো। সন্ধ্যা নামার কিছুটা আগেই আমরা রাঙামাটি পৌঁছে গেলাম।
রাঙামাটির পথে পথে, নীল জলে ভেসে
আগেরবার যখন রাঙামাটি এসেছিলাম তখন আমার মেয়ে রিয়াসা অনেক ছোট। ওর স্মৃতিতে হয়তো তখনকার কোন ছবিই নেই। তাই ভাবলাম এবারের রাঙামাটি ভ্রমণ ওর জন্যও অনেক আনন্দদায়ক হবে। মাসুদ ভাইদের জন্য এটি নতুন জায়গা। রিয়াসা জিজ্ঞেস করলো- বাবা, এখানেও কি পাহাড়-মেঘ দেখা যাবে? আমি বললাম- পাহাড় দেখা যাবে তবে সাজেকের মত মেঘ দেখা যাবে না। লেক দেখতে পাবে, আমরা সবাই মিলে বোটে চড়ে ঘুরবো সেই লেকে। তোমরা ঝুলন্ত ব্রিজে উঠবে, বোটে করে সুবলং ঝর্ণার কাছে যাবে, তবে মনে হয় না ঝর্ণায় এখন পানি দেখতে পাবে। এতকিছু দেখতে পাবে শুনে ওরা বেশ খুশি।
যাই হোক, রাতে আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না। পর্যটনের মোটেলটা বেশ পছন্দসই ছিলো। আমার স্ত্রী এসব ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে, সেও পছন্দ করলো। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সামনে লম্বা করিডোর, পেছনে প্রশস্ত বারান্দা। হোটেলের পেছন দিকে কিছুটা খোলা জায়গা, সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য কয়েকটা রাইড বসানো আছে। মেয়েরা সেখানে দোলনায় বসে কিছুটা সময় কাটালো। তবে বারান্দার দরজায় বানরের বিষয়ে সতর্কবাণী দেখে ওরা আমাদের পাহারাদার হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখলো। সাজেকের তুলনায় এখানে শীত কিছুটা কম। আমি ও মাসুদ ভাই ঝুলন্ত ব্রিজের ওপারে গিয়ে পরেরদিন সকালে লেকে ভ্রমণের জন্য বোট ভাড়া করে আসলাম। সকালে বোটে করে রওনা দেবো, সারাদিন ধরে লেকের আশেপাশে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসবো এখানেই- এভাবেই বোট মালিকের সাথে কথা ফাইনাল হলো। আমরা পর্যটনের রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেলাম, তারপর রুমে ফিরে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে রাতের ঘুমটা চমৎকার হয়েছিলো।
খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত ভাললাগায় ছেয়ে গেলো মনটা। সবুজ গাছপালা ঘেরা নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারিদিকে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। সেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে পেছনের কাপ্তাই লেকের টলটলে নীল জল দেখা যাচ্ছিলো। একপাশ থেকে ঝুলন্ত ব্রিজের কিছুটা অংশও চোখে পড়ছিলো। আমি মেয়েকে ডেকে তুললাম। প্রথমে কম্বলের ওম ছেড়ে বের হতে চাচ্ছিলো না, তবে ঝুলন্ত ব্রিজের কথা শুনে উঠে পড়লো। মেয়েকে তুলে দিয়ে আমি গোসলে চলে গেলাম। গোসল সেরে বের হতেই দেখি গিন্নি বিছানা পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলেছে। আমি তৈরি হয়ে নিচে চলে গেলাম। মুমু-ইরা-রিয়াসা যথারীতি দোলনায় দোল খাচ্ছে আর লেকের টলটলে নীল জলের গুণগান করছে। আমি ওদের তাড়া দিয়ে বললাম- ওখানে যেতে হলে গোসল সেরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো। ওরা রুমে চলে গেলে আমি আর মাসুদ ভাই হোটেলের সামনে আদিবাসীদের তৈরি দ্রব্যের দোকানে গেলাম। এখানে স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রামে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি হয়। দামও তেমন বেশি নয়। আমরা ঠিক করলাম লেক থেকে ঘুরে এসে কিছু কেনাকাটা করবো।

নাস্তা সেরেই আমরা ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে এগোলাম। ব্রিজের ওপার থেকে বোটে উঠবো। মেয়েরা ব্রিজে এবং তার আশেপাশে কিছুক্ষণ ছবি তুললো। অব্যবস্থাপনা এবং তত্ত্বাবধানের অভাবে ব্রিজটা আর আগের মত আকর্ষণীয় নেই। কাঠগুলো বেশ নড়বড়ে হয়ে আছে। যাই হোক, আমরা ব্রিজ পার হয়ে বোটে উঠে বসলাম। কিচ্ছুণের মধ্যেই আমাদের প্রমোদ তরী লেকের জল কেটে চলতে শুরু করলো। লেকের শান্ত জলের উপর দিয়ে আমরা ভেসে চলছিলাম তবে নৌকার ইঞ্জিনের ভটভট শব্দটা পরিবেশের সাথে বেমানান লাগছিলো। মাঝে মাঝে বিরক্তিকরও। ইঞ্জিনের শব্দে আমরা নিজেদের কথাই ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলাম না। আহা! এমন চমৎকার পরিবেশে এই শব্দটা যদি না থাকতো! মাসুদ ভাইয়ের আক্ষেপের উত্তরে আমি হাসতে হাসতে বললাম- এই ইঞ্জিঞ্চালিত বোটে করে সুবলং ঝর্ণার কাছে যেতে এবং ফিরে আসতেই তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে, আর বৈঠা চালিত নৌকায় গেলে তো আজ আর ফেরা হতো না। তাছাড়া আমাদের আরও কয়েকটি স্পটে যেতে হবে। আমরা এগিয়ে চলছিলাম নীল জলে ভেসে ভেসে আর চারপাশে দেখছিলাম সবুজ পাহাড়ের সারি; দুরে-কাছে, উঁচুনিচু। কোথাও ঝাপসাভাবে পাহাড়ের অবয়ব চোখে পড়ছে অনেক দূরে। আবার থেকে থেকেই লেকের জলরাশির মাঝে দ্বীপের সদৃশ ছোট ছোট পাহাড় চোখে পড়ছিলো। মোটকথা এমন চমৎকার পরিবেশে সারাদিন অনায়াসেই পার করে দেয়া যায়। আমাদের বোট চালকের নাম মিল্টন। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- এখানে কোথাও একটা পুরনো রাজবাড়ী ছিলো, আমরা কি ওখানে যাবো? ও জানালো- রাজবাড়িটা এখন আর নেই, ওটা পানির নিচে চলে গেছে। আমার মনে পড়ছিলো আগেরবার আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। তখন ওখানে পুড়ে যাওয়া কিছু ঘর দেখেছিলাম। আমি আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম- আর ‘রাজবন বিহার’? উত্তরে মিল্টন বলল- ওখানে তো শহর থেকেও যাওয়া যায়, তাছাড়া ওখানে বাঙালিরা আর তেমন যায় না। আমি জানতে চাইলাম- কেন? ও জানালো- রাজবন বিহারে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের আনাগোনার ফলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপাসনা ও ভান্তেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়, তাই পর্যটকদের জন্য রাজবন বিহারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি বললাম- ও আচ্ছা! আমাদের তাহলে রাজবন বিহারে যাওয়া হচ্ছে না!

কাপ্তাই লেকে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে মেয়েরা খুব খুশি ছিলো। হঠাৎ আমি ওদের আনন্দে ব্যঘাত ঘটালাম। জিজ্ঞেস করলাম- এই কাপ্তাই লেক কীভাবে তৈরি হয়েছে জানো? আজ আমরা এই নীল জল দেখে আনন্দিত হচ্ছি, অথচ জানো এই জলের নিচে জমে আছে কত মানুষের কান্না? ওরা সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কেন?
কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে আমি যতটুকু শুনেছি তাই ওদের বললাম। ওরা খুব মনোযোগী শ্রোতার মতই শুনছিলো। আমি বললাম- তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়। এই বাঁধের কারণে এই অঞ্চলের চুয়ান্ন হাজার একর কৃষিজমি ডুবে যায় যা এখানকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। সেই সাথে প্রায় আড়াই’শ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়। এই এলাকায় বেশির ভাগই ছিলো চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের এক লাখের মত মানুষ তাদের বসতবাড়ি আর কৃষিজমি হারিয়েছিল। তাই বলা হয়- কাপ্তাই লেকের নীল জলে মিশে আছে এখানকার আদিবাসিদের কান্না।
আমার কথা বলা শেষে দেখলাম ওদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। পরিবেশটা হালকা করতেই বললাম- তোমাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। বৃহত্তর স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রেই কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই স্থানকেই হয়তো তৎকালীন বিশ্লেষকরা উপযোগী মনে করেছিলো। এটা বিশ্বের সব দেশেই হয়ে থাকে। নদীতে বাঁধ নির্মান, ব্রিজ তৈরি কিংবা রাস্তা তৈরির জন্য অনেক মানুষের ঘরবাড়ি সরকার চাইলেই নিয়ে নিতে পারে। এই যেমন পদ্মা সেতুর জন্য অনেক মানুষের বাড়ি-ঘর, চাষের জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে। যাদের কাগজপত্র ছিলো- তারা এই জমির পরিবর্তে টাকাও পেয়েছে। মন খারাপ না করে তোমরা মজা করো।
আমাদের এখনকার গন্তব্য সুবলং ঝর্ণা, ওটাই সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। আমরা সেদিকেই ছুটে চলছিলাম। ঝর্ণা দেখে বাকী স্পটগুলো দেখতে দেখতে ফিরে আসবো আবার সেই ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে। চারিপাশের দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছিলো। কোথাও টিলাসদৃশ ছোট ছোট পাহাড়, কোথাওবা উঁচু। পাহাড়ের পাড়গুলো অনেকটা পাথরের মত শক্ত। লেকে জেলেনৌকা খুব একটা দেখা যাচ্ছিলো না। দু’একটা নৌকা চোখে পড়ছিলো এই দীর্ঘসময় ধরে। আমি বিভিন্ন এঙ্গেলে লেকের ছবি তুলছিলাম। মেয়েদেরও দেখলাম মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কখনও নিজেদের আবার কখনওবা লেকের দৃশ্য। এভাবে চলতে চলতেই আমরা পৌঁছে গেলাম সুবলং ঝর্ণার কাছে। জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। চারিদিকে অনেকগুলো উঁচু পাহাড়, তার মধ্যে দিয়ে একটা সরু চ্যানেল বেরিয়ে গেছে অন্য প্রান্তে। সেখান দিয়ে ছোট বড় নৌকা ছুটে চলছে। আমরা সবাই ঝর্ণার স্পটে নামলাম। তবে সবচেয়ে হতাশার কথা হলো- এবারও ঝর্ণায় পানি নেই। আগেরবারও যেমন দেখতে পাইনি। আমরা সবাই ওখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কিছুটা সময় কাটিয়ে সুবলং ত্যাগ করলাম।
আমরা ফিরে চলেছি সেই একই পথ ধরে, অর্থাৎ লেকের যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। এখান থেকে অল্প কিছুদূর এগোলেই একটি আদিবাসিদের গাঁ রয়েছে। এখানে গাঁ বলতেও সেই পাহাড়। পাহাড়ের কোলঘেঁষে ভিড়লো আমাদের বোট। আমরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম পাহাড়ের উপরে। লেক থেকে পাহাড়ের উচ্চতা কম-বেশি এক’শ ফুটের মত হবে। আমার কাছে সেই পাহাড়ি গাঁয়ের আলাদা কোন বিশেষত্ব চোখে পড়েনি। কয়েকটি টিনের ঘর, সবজী মাচা ও বিভিন্ন ফলমূলের গাছগাছালি আর আদিবাসী মানুষজন। তবে সেখানে কয়েকটি দোকান ছিলো, আদিবাসিদের হাতে বোনা কাপড়চোপড়, শাল, ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিলো। আমরা সেখান থেকে কিছু কেনাকাটা করে নেমে পড়লাম।
আবার চলতে শুরু করেছে আমাদের নৌকা। এবারের গন্তব্য- রেস্টুরেন্ট। কাপ্তাই লেকে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। লেকে ভ্রমণরত পর্যটকদের একটা বড় অংশ এসব রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবার খেয়ে থাকে। এমনই দু’টো রেস্টুরেন্ট পেদা টিং টিং অথবা চাংপাং। এর যে কোন একটিতে আমরা দুপুরের খাবার খাবো। ‘আর যাই হোক- ব্যাম্বু-চিকেন আমি খাবো না’ মাসুদ ভাইয়ের বলার স্টাইলে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম- ‘ঠিক আছে আপনি ব্যাম্বু-ফিশ খাইয়েন’ মাথা নেড়ে সে বলল- ‘দরকার নাই আমার ব্যাম্বু-ফিশ চিকেনের। তবে বাঁশকোড়ল দিয়ে চিংড়ি খাওয়া যেতে পারে, না পেলে আমার জন্য ডাল-আলু ভর্তাই যথেষ্ট’। এমনি হাসি আনন্দে আমাদের সমটা কেটে যাচ্ছিলো। চাংপাং এর কাছে পৌঁছুতেই নৌকা ভিড়ালাম। চলেন এখানেই খাই। মনে পড়লো- ন’বছর আগে আমরা এখানেই খেয়েছিলাম। মাসুদ ভাইয়ের জন্য দুঃসংবাদ; ডাল-আলুভর্তা পাওয়া যায়নি। তাই আমরা মুরগী আর রুই মাছ অর্ডার করলাম। আমাদের আধা ঘণ্টা বসিয়ে রেখে রাধুনি রান্না করলো, তারপর যা খাওয়ালো তাতে আমাদের মুরগী খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। সে খাবার কোনরকম গলদকরণ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
আরও কিছুদূর এগিয়েই দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপরে একটি বৌদ্ধমূর্তি। আমাদের বোটম্যান মিল্টন পাহাড়ের পাদদেশে নৌকা ভিড়ালো। মাসুদ ভাই আর মহিলারা বোটেই রয়ে গেলেন, বাচ্চাদের নিয়ে আমি নেমে পড়লাম। ওদের নিয়ে কিছুদূর উঠলাম। তবে মেয়েদের নিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে বেশি উপরে ওঠা বিপদজনক হতে পারে ভেবে আর উঠলাম না। পাহাড়ের শুরুতে, লেক থেকে কিছুটা উচ্চতায় একটি ছোট বাজার রয়েছে। এখানেও আদিবাসিদের হাতে বোনা কাপড়চোপড় অন্য অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। আমরা নেমে আসতেই দেখি মাসুদ ভাই ডাব নিয়ে বসে আছে। সবাই সেই ডাবের সুমিষ্ট পানি খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। ঝুলন্ত ব্রিজের কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে পলওয়েল পার্ক। লেক সংলগ্ন একটি বিনোদন কেন্দ্র। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের নৌকা পলওয়েল পার্কের পাশে এসে নোঙর করলো। পাড়ে নেমে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ডিসি বাংলো রোডে গড়ে তোলা পলওয়েল পার্কটি রাঙামাটির পর্যটকদের জন্য বিনোদনের একটি নতুন সংযোজন। আগেরবার যখন রাঙামাটি এসেছিলাম, তখন এই পার্কটি ছিলো না। যাই হোক, এখানে রয়েছে শিশুদের জন্য একটি কিডস জোন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরবার জন্য কিছু ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। পায়ে চলা রাস্তার পাশে লেকের পাড় ঘেঁষে পর্যটকদের বসার জন্য রাখা আছে কিছু বিচ চেয়ার, এখানে বসে পর্যটকরা লেক আর পাহাড়ে সন্ধ্যা নামার দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। দেখতে পারে লেকের টলটলে নীল জল; কাছে-দূরে সারি সারি সবুজ পাহাড় আর আকাশের নিবিড় মিতালী। এছাড়া পার্কটিতে রয়েছে পলওয়েল কটেজ ও সুইমিং পুল। আরও রয়েছে পুনাক কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র; যেখানে স্যুভেনির, আদিবাসীদের হাতে বোনা কাপড়চোপড় পাওয়া যায়। মেয়েরা কিডস জোনে খেলায় মেতে উঠলো। আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম। পার্কটির একেবারে শেষ প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে একটি ‘লাভ পয়েন্ট’। এই ভালোবাসার স্মারকটি তৈরির পেছনে একটি মর্মান্তিক গল্প আছে। ২০১৪ সালের ২৯শে মার্চ কাপ্তাই লেকে বোট উল্টে মৃত্যু হয় আমেরিকা প্রবাসী দম্পত্তি আলাউদ্দিন ও তার স্ত্রী আইরিন লিমা’র। তিনদিন পর কাপ্তাই লেক থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সম্মিলিত অভিযানে উদ্ধারকৃত এই দম্পত্তির মৃতদেহ দুটিকে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় লেকে পাওয়া যায়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা একটি বিরল ঘটনা। তাদের এই ভালোবাসাসহ পৃথিবীর সকল মানুষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উনয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নির্মাণ করা এই ‘লাভ পয়েন্ট’। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে আমরা পলওয়েল পার্ক থেকে নেমে আসলাম। আবার আমাদের বোট ছুটে চলেছে নীল লেকের জল কেটে। তার কিছুক্ষণ পরই পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য তার বিদায় বার্তা জানান দিলো। পশ্চিম দিগন্তে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে লেকের জলে। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। দিনের এই বিশেষ সময়টার প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে। আর নৌকায় বসে এমন দৃশ্য দেখা সত্যিই এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গিয়ে চারিদকে আঁধার নেমে আসলো, আর আমরাও পৌঁছে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে। এখানেই আমাদের লেক ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটলো।
রাতে মোটামোটি বিশ্রাম নিয়েই সময়টা কাটালাম। মহিলারা হোটেলের পাশের বিক্রয়কেন্দ্রে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলো। তারপর রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে চলে গেলাম। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসলাম। রিসেপশনের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম আর কোথায় যাওয়া যায়। ও জানালো ক্যান্টমমেন্টের কাছে আছে আরণ্যক রিসোর্ট, ওখানে যেতে পারেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওখানে কি কি আছে? ও জানালো- ওটা একটা পার্কের মত। সুইমিং পুল, বোটে ভ্রমণ, বাচ্চাদের জন্য কিছু রাইড আছে। আর কোথাও যাওয়ার আছে? রাজবন বিহারে যেতে পারেন, ছেলেটা বললো। ওখানে তো আমাদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ, তো ওখানে গিয়ে লাভ কি? ছেলেটা হেসে সায় জানালো। রুমে ফিরে সবাইকে জানালাম। মেয়েরা আরণ্যক রিসোর্টে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না। তো কোথাও গিয়ে কাজ নেই। কিছু কেনেকাটা থাকলে টেক্সটাইল মার্কেটে চলো। সবাই তৈরি হয়ে নাস্তা সেরে মার্কেটের দিকে চললাম। আবার সেই স্থানীয় আদিবাসিদের তৈরি কাপড়চোপড় কেনা হলো, তবে এখানে দাম অন্য জায়গা থেকে কম।
দুপুরের খাবার পর কিছু সময় রেষ্ট নিয়ে নিলাম। আমাদের গাড়ি ছাড়বে রাত সাড়ে আটটায়। হাতে অনেক সময়। ঝুলন্ত ব্রিজের ওপারে আদিবাসিদের একটা গাঁ আছে। গতকাল বোটে চড়ার সময় দেখেছিলাম, যাওয়া হয়নি। এখন সেখানে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই পাহাড় বেয়ে নামা এবং ব্রিজের ওপারে গিয়ে উপরে ওঠা। আমাদের নামতে উঠতে কিছুটা সময় লাগলেও মেয়েরা খুব দ্রুত উঠে যাচ্ছিলো। পাহাড়ের উপরে উঠেই দেখলাম একটা বাজারের মত। আদিবাসী নারীপুরুষ তাদের নিজস্ব বাগানো ফলানো নানান ধরণের ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসেছে। আনারস, পেঁপে, কলা, বড়ই, তেঁতুল, ডাব ও বিভিন্ন ধরণের সবজী। কেউ কেউ বাহারি স্যুভেনির ও হস্তশিল্পদ্রব্য নিয়ে বসেছিলো। এদের মধ্যে অবশ্য পাহাড়ি আদিবাসিদের সাথে বিভিন্ন বয়সী বাঙালিদেরও দেখা যাচ্ছিলো। আরও কিছুদূর এগিয়ে আবার কিছু কাপড়চোপড়ের দোকান। তার পাশ দিয়ে গ্রামে ঢোকার রাস্তা চলে গেছে। আমরা গ্রামের কিছু অংশ ঘুরে দেখলাম। খুব সাধারণ জীবনযাপন। তবে এখানে বাঙালি-আদিবাসী উভয়ের বসবাসই চোখে পড়লো। আমরা আরও কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসলাম হোটেলে।
টুকটাক গোছগাছ যা বাকি ছিল সম্পন্ন করে রাখলাম। রিসেপশনে গাড়ির জন্য বলে রেখেছিলাম। সাড়ে সাতটার দিকে আমাদের গাড়ি এসে হাজির। আমরা হোটেল থেকে বিদায় নিলাম। রাঙামাটি শহরে কোন রিক্সা নেই, তাই ট্রাফিক জ্যামও নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছে গেলাম। যাত্রার আগে কেউ কিছু খেতে চাইছিলো না, তাই রাতের জন্য কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নিলাম। নির্ধারিত সময়ে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমরা ফিরে চললাম আমদের নীড়ে।
চীনা লেখক লিন ইউভাং বলেছেন- ভ্রমণ শেষে নিজ বাড়িতে ফেরার আগ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারে না ভ্রমণ কত সুন্দর ছিলো। তবে আমি ভ্রমণের সময়কালীন প্রতিটা মুহূর্তই উপভোগ করেছি। সবুজ পাহাড়, সফেদ-শুভ্র মেঘ, নীল জলের কাপ্তাই লেক, আদিবাসিদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন- সবকিছুই। আর আমাদের মেয়েরাও দারুণভাবে উপভোগ সেই খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক গমণ থেকে শুরু করে কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ- পুরো সময়। আমার কাছে এটাই এই ভ্রমণের সার্থকতা।