যে কোনো মানুষের জীবনে ভাল-মন্দ দুটো দিকই থাকে। মওদুদ আহমেদেরও আছে। গতকাল তিনি প্রায় ৮১ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন (১৯৪০-২০২১)। সুতরাং একজন মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে কিছু বলার আগে একটু ভেবে-চিন্তে বলা ভাল।
তিনি বেশ বড় একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশের বেশ বড় একজন আইনজীবী এবং লেখক ছিলেন। রাজনীতির প্রসঙ্গে বলার আগে আইনজীবী এবং লেখক মওদুদ আহমেদের কথা বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের আগে ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের জুনিয়র হিসেবে তিনি আইন-পেশা শুরু করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের (আসামীদের) পক্ষে আমির উল ইসলামসহ যেসব আইনজীবীরা কাজ করেছিলেন, মওদুদ আহমেদ তাদের একজন।
উল্লেখ্য, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তিনি ছিলেন। একজন মানুষের জীবনে ইতিহাসের অংশ হতে আর কি লাগে? এই দুটো ঘটনাই কি যথেষ্ট নয়?
মওদুদ আহমেদ একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকধর্মী লেখক। বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি ও আইনের উপর তাঁর লেখা কমপক্ষে পাঁচটি বই আছে, যা বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা, বাংলাদেশ’ ‘শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’, ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ – প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামরিক শাসন, ‘এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস’, ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’, ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড আফটারম্যাথ ২০০৭-২০০৮’ তার উল্লেখযোগ্য বই। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদ এতগুলো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেননি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল করা হয়। একটা দেশের ডাক বিভাগের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ। উক্ত পদে থাকা অবস্থায় তিনি সিআইয়ের এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হন। পল্লী কবি জসিম উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তার মেয়ের জামাইকে (মেয়ের নামঃ হাসনা জসিম উদ্দিন) মাফ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু কবি জসিম উদ্দিনকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। তাই তাঁর অনুরোধ ফেলতে পারেননি। যথারীতি মওদুদ আহমেদ ছাড়া পেয়ে গেলেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলেন। তারপর আর মওদুদকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জেনারেল জিয়ার আমলে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও মোট ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে মওদুদ আহমেদ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন- (১) শিল্প মন্ত্রণালয় (২) পরিকল্পনা, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় (৩) বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় (৪) পানি সম্পদ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয় (৫) যোগাযোগ ও রেলযোগাযোগ মন্ত্রণালয় (৬) সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয় (৭) টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন মন্ত্রণালয় (৮) অষ্টম জাতীয় সংসদে মওদুদ আহমেদ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
এরশাদ আমলে কাজী জাফর আহমেদ এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে তাঁর প্রতিযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এরশাদ তাঁকে প্রধানমন্ত্রী এবং উপ-রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় কিংবা এতগুলো মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে ছিলেন না।
মওদুদ আহমেদ সবসময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতার কেন্দবিন্দুতেই ছিলেন।
অনেকের মতে, ক্ষমতার মোহ তাকে অসম্ভব নীতি বিবর্জিত এবং আদর্শহীন করেছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৬ সালে জিয়ার কাছে যেতে একটুও দেরি করেননি; আবার জিয়া হত্যার ছয় মাসের মাথায় ১৯৮২ সালে এরশাদের কাছে গিয়েছেন। এরশাদ পতনের পর আবার খালেদা জিয়ার কাছে গিয়েছেন। এত বড় সফল ডিগবাজি চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশে আর একজনও নেই।
তিনি ক্ষমতার বাইরে গেলেই দল পরিবর্তন করেছেন। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার পতনের পর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আরোহন করলেন। ২০১১ সালে ১৫ আগস্ট এটিএন টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মওদুদ আহমদ বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অবস্থান জিয়ার চেয়ে অনেক ওপরে। সবার ওপরে। ইতিহাসের যার যে অবস্থান তা তাকে দেওয়া উচিত।’
অনেকেই মনে করেন, এই সাক্ষাৎকারটি ছিল মওদুদ আহমেদের শেষ ডিগবাজির অংশ বিশেষ। আওয়ামী লীগের সাথে একটা সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ যাত্রায় তিনি সফল হতে পারেননি; কারণ আওয়ামী লীগের এক্সিট ডোর খুব কঠিন। এই পথ দিয়ে একবার বাহির হইলে আর প্রবেশ করা যায় না। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, ডক্টর কামাল হোসেনরা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
উক্ত সাক্ষাৎকারের পর বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান বেশ উষ্মা প্রকাশ করেন। রুহুল কবীর রিজভি প্রকাশ্য জনসভায় তাঁকে হুমকি দেন। প্রায় এক দেড় বছর মওদুদ আহমেদ কোনো সভা-সমাবেশ-সেমিনারে যেতেন না। অনেক দিন বিএনপির মধ্যে তিনি বেশ চাপে ছিলেন। তবে বিএনপি বলে কথা!
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একবার খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘কুকুরে লেজ নাড়াচ্ছে নাকি লেজে কুকুর নাড়াচ্ছে?’। তারপরেও বিএনপিতে তিনি বহাল তবিয়তেই ছিলেন।
সুতরাং আইনজীবী, লেখক এবং আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিবিদ, মওদুদ আহমেদের প্রয়ানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘মওদুদ আহমদের এই চলে যাওয়ায় জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি সারাদেশের একজন মুরুব্বি ছিলেন।… তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে, দেশের জনগণ একজন জনপ্রতিনিধিকে হারাল’।
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।