বৈশাখ মাস এলেই মা ব্যস্ত হয়ে ওঠতেন। বাবাকে দিয়ে আনন্দ বাজার থেকে দুই তিন পদের মুড়ির ধান আনাতেন। মা পরম যতনে তা সেদ্ধ করতেন। শুকানোর পর কাইল-মোসল দিয়ে চাল করা হতো। সবই করা হতো প্রতিবেশী মহিলাদের সহায়তা নিয়ে। মুড়িও ভাঁজতেন অভিজ্ঞ মহিলাদের নিয়ে। খুব সকাল থেকে সারা দিনভর মুড়িভাঁজায় ব্যস্ত থাকতেন মা। তার ফাঁকে রান্নার আয়োজনও থাকত। মহিলাদের ভাত খাওয়াতে হতো। এতেও মায়ের ছিলনা কোন ক্লান্তি। উপরুন্তু মায়ের সে কী আনন্দ! ছেলে, ছেলে বৌ, নাত-নাতনীরা আসবে মধু মাসে আম খেতে। ঘর-দোর লেপাপোঁছা,পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতেন। উঠোন, পাছদুয়ার একদম ঝকঝক তকতকে করে রাখতেন। সবকিছুতেই যেন একটা উৎসব-উৎসব আমেজ। মুড়িও কয়েক পদের করতেন। আমের সাথে খাওয়ার জন্য মচমচে ফোলা ফোলা মুড়ি। তাছাড়া গাইট্যা মুড়ি, চালুইন্যা মুড়ি, খুদের মুড়ি ভাগ ভাগ করে রাখতেন মা। চালুনি দিয়ে চালার পর নীচের মুড়িই চালুইন্যা মুড়ি। অবসরে মা আলাদা করে রেখে দিতেন কাঁসার কলসী ভরে। যার যার যা পছন্দ নিয়ে খেত।
মেজো ভাইজান আসতেন বরিশাল থেকে। ছোট ভাইজান আসতেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা থেকে বড় ভাইজান সপরিবারে আসতেন বাড়িতে। কী যে আনন্দ হতো। যতদিন আম থাকত বড় ভাবী ততোদিন বাড়িতে থাকতেন। বাবা ঠুনি, বড় ছালা, ছোট ছালার ব্যাগ, বড় মোটা লম্ব দড়ি নিয়ে যেতেন পুষ্করিণীর পাড়ে আম পাড়তে। একটা আমও মাটিতে পড়তে দিতেন না বাবা। রোজ রোজ এমনি করে গাছপাকা আম পাড়তেন বাবা। জ্যৈষ্ঠ মাসের ২০/ ২২ তারিখের পর আমের পাকার ধরন বুঝে বাকী আম এক বা দুই তিন দিনে পেড়ে শেষ করতেন। দুই তিন জন গাছে চড়ত, গোছ নেংটি দিয়ে। বাবাকে নিয়ে নাত-নাতনীরা কতই-ই-না মজা করতেন।
হাতে নাগাল পাওয়া আম পেড়ে ছোট ছালার ব্যাগে ভরতো। ব্যাগ রশি বেঁধে নীচে আস্তে-আস্তে নামাত। আমরা দড়ি খুলে ব্যাগ থেকে আম ছালায় ভরতাম। ঠুনি দিয়ে পাড়া হতো হাত দিয়ে নাগাল না পাওয়া আম। আম বেশি হলে, পাড়া আম এক জায়গায় রাখা হতো। পাকা আমের কষের ঘ্রাণের গন্ধটা আজো নাকে বাজে। আম পাড়া শেষ হলে বড় ছালায় ভরে ভরে বাড়িতে পাঠাত। আমহীন গাছগুলোকে তখন সন্তানহারা মায়ের মতো বিষণ্ন মনে হতো।
বড় ভাইজানের বড় মেয়ে পারভীন, মেজো মেয়ে নাছরীন এবং ছেলে রতন, মানিক ও মুক্তা ওরা আম পাড়তে হৈ হৈল্লোরে মাতিয়ে রাখত পুকুর পাড়। ছোট বোন নাহার আর আমিও থাকতাম পুকুর পাড়ে। আমরা তখন স্কুল কলেজে পড়তাম।
আম পাকার আগ থেকেই ওগুর তল লেপাপোঁছা করে চারদিকে ছাই দিয়ে বেঁড়ি দিতেন মা। কারণ, পিঁপড়ে যেন আমের খবর না পায়। তারপর বাঁশের তৈরি মাচা কারও পরিষ্কার করে আম রাখতেন। আবার পাথি বা ধামা ভরেও আম রাখতে হতো। মুড়ির আম, দুধ-ভাতের আম, বুলবুলি খাওয়ার আম, (পাকা মিষ্টি রসালো আমের বোটার বিপরীত দিকে ছিদ্র করে চুষেচুষে খেত বাচ্চারা)। দুধের আম বাছাই করা হতো আমের মিষ্টিগুণ যাচাই করে।
আম গাছের ভিন্নভিন্ন নাম ছিল। বৈশাখ মাসে পাকা গাছের নাম ছিল বৈশাইগ্যা, কুচকুচে কালো বলে বলা হতো কাইল্যা গাছ। পুকুর পাড়ের মাঝে বলে বলা হতো মাইধ্যের চারা, রস খেতে খিরের মতো গাঢ় মিষ্টি বলে বলা হতো খিরা গাছ। আষাঢ় মাস পাকা আম তাই বলা হতো আষাঢ়ী গাছ। ভেতরে সাদা, রসও সাদা তাই বলা হতো কাটাইরা গাছ। সিঁদুরের মতো লাল টকটকে বলে বলা হতো সিঁদুইরা গাছ। দেখতে বেতের তৈরি পুড়ার মতো বড়, ফজলি আমের মতোই দেখতে তাই বলা পুড়া গাছে। মধুর মতো মিষ্টি বলে বলা হতো মধু গাছ এবং একটা ব্যতিক্রম ঘ্রাণ ছিল বলে বলা হতো জইন্যা গাছ।
বাবা ভোরে ওঠেই আম বাছাই করে চিরা-মুড়ির আম, দুধ-ভাতের আম, আমসত্ত্ব তৈরির আম, ভর্তা খাওয়ার আম সব ভাগ করে দিতেন। মেজো ভাইজান আম ছিলে কাঁসার তাগারিতে রাখতেন। এই দায়িত্বটা তিনিই বরাবর পালন করতেন। আমের খোসা মুখে দিয়ে আমের মিষ্টতা পরখ করতাম আমরা। একটু মিষ্টি কম হলে ওটা আলাদা করে রাখা হতো। ওগুলো দিয়ে আমসত্ত্ব বানাতেন মা। শুরু হতো দুধ চিরা-মুড়ি খাওয়ার ধুম! আমাদের ছোট আব্বু রতন ( বড় ভাইজানের বড় ছেলে) ও কাইল্যা গাছের আম আগেই বেছে বেছে নিয়ে রাখতেন। ঐ গাছের আম ছাড়া যেন ওর চলতই না। খুব মিষ্টি ছিল কাইল্যা গাছের আম।
দুপুরে ছিল আম-দুধ-ভাত খাওয়ার ধুম। বিকেলে আম বুলবুলি করে খেতাম হেঁটে-হেঁটে। মা-বাবার আনন্দ যেন আর ধরে না। পরম মমতায় মা-বাবা নাত-নাতনীদের খাওয়াতেন আর প্রাণভরে উপভোগ করতেন। আমাদেরও আদরের প্রাণকেন্দ্র ছিল ভাইঝি-ভাইপোরা। ওদেরকে ঘিরেই যেন সংসারের আনন্দ আকাশে-বাতাসে মুহূর্মুহু ভেসে বেড়াত। আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতেও আম পাঠাতেন মা। আবার বড় ভাইজানের শ্বশুর বাড়ি থেকেও আম পাঠাত আমাদের বাড়িতে।
আজ সে দিনগুলোর স্মৃতিচারণায় চোখের কোনে নোনাজলের স্বাদ নিচ্ছি। মা-বাবা, বড়ভাই-বড়ভাবী নেই। তাঁরা আজ দূর আকাশের তারা। জ্যৈষ্ঠমাস আজো আসে কিন্তু সে দিনগুলো স্মৃতি রোমন্থনে কখনো কাঁদায়-হাসায়। চোখ বুজে স্মৃতির ঝাঁপিতে হাতড়িয়ে খুঁজিফিরি সেই জ্যোতির্ময় মধুর শৈশব-কৈশোরকে।
এখনও পুকুর আছে। পুকুর পাড় আছে। নেই সে গাছগুলো। নেই আগের মতো পুকুরের শ্রী ও সৌন্দর্য। পুকুর পাড় ছিল তখনকার সময়ে বিশ্রাম ও বিনোদনের মিলনমেলা। তাস আর লুডুর আড্ডাও বসত। ছেলেছোকরার পড়ন্ত বিকালে দাড়িয়াবান্ধা খেলত পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড়ের দূর্বাঘাস যেন মনে হতে মখমলের মোলায়েম গালিচা পাতা। চৈত্র-বৈশাখে পাট-তিল-মরিচের ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস মানুষ পুকুরপাড়ে আশ্রয় নিত। আম গাছের ঘনপাতার আচ্ছাদনে শীতল ছায়া, আর ফুরফুরে বাতাসে মানুষ ঘুমাত স্বস্তিতে।
কোথায় হারিয়ে গেল সেই মধুমাসে মধুময় শৈশব? আজ নেই সেই সোনালী শৈশব। নেই সেই পরিবেশ,পরিস্থিতিও। পরিবর্তনের হাওয়ায় নতুনের আমেজে মাতোয়ারা। কিন্তু? মনটা কেন পোড়ে? চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয় বুকের মধ্যে। ভেজা চোখ থেকে ঝরে বেদনা শ্রু। বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে আসে একটা আতপ্ত নিঃশ্বাস।
তারিখঃ ৩০/০৫/২০২২
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক