[এক গল্পের ফেরিওয়ালা। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া গ্রামের গাঁ ঘেঁষে তিরতির করে বয়ে যায় ছোট্ট নদীর অসংখ্য ঢেউ। সেই ঢেউয়ের সাথে ছোট্ট ছেলেটি বুকের ভেতর পুষে রাখতো অসংখ্য গল্প। গল্পেরা ক্রমশই ডানা মেলে ছড়িয়ে যেতে থাকলো মানুষ থেকে মানুষে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম তরুণ কথাসাহিত্যিক তিনি। আরশিনগর, অন্দরমহল, মানবজনম, নিঃসঙ্গ নক্ষত্র, ছদ্মেবেশ, মেঘেদের দিন, মরণোত্তম, নির্বাসন ও অর্ধবৃত্ত’র মতো উপন্যাস দিয়ে চমকে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী বাংলা পাঠকদের। গল্প বলে চলেছেন চলচ্চিত্রেও। তার নির্মিত ‘বোধ’, ‘দ্যা শ্যুজ’, ‘প্রযত্নে’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলোও ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের হৃদয়। জিতেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গের চোখ সাহিত্য পুরস্কার, হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। সাদাত হোসাইন আগামীর বাংলাদেশ আগামীর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পতাকা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এক ঝলমলে তারুণ্যের প্রতীক। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রশান্তিকার প্রিন্ট এডিশনের প্রথম সংখ্যা থেকেই নিয়মিত লিখছেন বিস্ময়লেখক সাদাত হোসাইন। প্রথমদিকে তাঁর কলামের নাম ছিলো ‘মন ও মানুষ’। প্রশান্তিকা ও মাসিক মুক্তমঞ্চের আমন্ত্রণে গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় এক মনোজ্ঞ সাহিত্য সভায় মিলিত হয়েছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে লিখছেন ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী ‘নীল দরিয়ার নোনাজলে’। আজকের এই লেখাটি ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রশান্তিকার প্রিন্ট এডিশনের। প্রশান্তিকা অনলাইন এবং সাদাতের অগণিত পাঠকের জন্য আজ ২১ মে সাদাতের জন্মদিনে লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।]

কদম ফুল আমার পছন্দ।
আমাদের পুকুরপাড়ে কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া দোলানো বাবরী চুলের মতন ডালপালা নিয়ে এক কদম গাছ দাঁড়িয়ে। আমার কেবল সেই গাছের কদম ফুল পছন্দ। অন্য কোন গাছের না। আমার তীব্র মন খারাপ হলে আমি সেই কদম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার তীব্র মন খারাপের কাল হল বর্ষাকাল। বর্ষাকালে কদম গাছে ফুল ফোটে। তখন সেই কদম গাছের নিচে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কান্না পেলে চুপিচুপি কাঁদা যায়। বৃষ্টি এলে বৃষ্টির জলে সেই কান্নার জল ধুয়ে যায়। আমি ঝাপসা চোখে কদম ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি। কদম ফুলেরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মন খারাপ হলে কদম গাছের তলায় কেন দাঁড়িয়ে থাকি?
তাও সেই কদম গাছের তলায়?
সেই গল্প-
এক ভরা সন্ধ্যায় আমি প্রবল মন খারাপ নিয়ে কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। হাঁটবারের দিন। হাঁটে বোম্বাই আখ উঠেছে। চিকন ছোট আখের দাম তিন টাকা, মোটা বড় আখের দাম পাঁচ টাকা। আমার মোটা বড় পাঁচ টাকা দামের বোম্বাই আখের খুব শখ। প্রতি মঙ্গলবার সকালে আমি ৫ টাকার আখের জন্য আম্মার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করা শুরু করি। এই ঘ্যানঘ্যান চলতে থাকে রাত নামা অবধি। আম্মা সেসব ঘ্যানঘ্যানানি পাত্তা দেন না। তার পাত্তা দিলে চলেও না। নুন আনতে পান্তা ফুঁড়ায় সংসার তার। এই সংসারে ২ টাকা, ৫ টাকার অনেক দাম। ৫ টাকায় সে যুগে ছোট পুঁটি মাছ, চিংড়ি মাছের ভাগা পাওয়া যায়! সেই ভাগে’র মাছের একটা দুটা করে খেলে আমাদের দিব্যি দু’দিন চলে যায়! সুতরাং ৫ টাকায় বোম্বাই আখ খাওয়া আমাদের সাজে না। তার চেয়ে কদম গাছের তলায় বসে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদা ঢের ভালো! আম্মা আমার কান্নাকাটিকে মোটেই পাত্তা দেন না। ৫ টাকা কি? দু টাকার একটা তেল চিটচিটে নোটও না!
সেদিন দুপুরে কি মনে করে আম্মা আমার হাতে দু’টাকার চকচকে একটা নোট দিয়েছিলেন। নোট খানা দিয়ে বলেছিলেন,’যা, হাটে গিয়া আউখ কিন্না খা, আর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করিস না, যা’।
আমি হরিণ ছানার মত তিড়িংবিড়িং লাফাতে লাফাতে হাটে গেলাম। ইশকুলে মাঠের পাশে বাঁশের আড়ায় হেলান দিয়ে দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি আখ! আমি সেই সারি সারি আখের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি হেঁটে যাই। বিড়ালের মত নিঃশব্দ ধীর পায়ে। আমার চোখ আটকে থাকে প্রতিটি আখের শরীরে। আমি ওপ্রান্তে হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসি। আবার চোখ দিয়ে গিলি, আবার ধীর পায়ে ও প্রান্তে যাই। আবার ফিরে আসি। একটা তাগড়া জোয়ান ভীমসাই আখ দেখিয়ে আমি আখওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি, ‘এই খানের দাম কত?’

আখওয়ালা তীক্ষ্ণ চোখ মেলে আমার দিকে তাকান। তারপর চোখ সরু করে বলেন, ‘যাহ ভাগ! ভাগ এইখানতন’!
আমি ভাগি না। অন্য সময় হলে আমি এক ঝটকায় দূরে সরে যেতাম। কিন্তু এখন যাই না। ডান হাতটা নিয়ে বুক পকেটের উপর চেপে রাখি। এই পকেটে টাকা! চকচকে দুই টাকার নোট!
আমি পাল্টা চোখ সরু করে জবাব দেই, ‘রাগেন কেন? আমার কাছে টেকা আছে, আমি আউখ কিনতেই আইছি, আম্মায় টেকা দিছে’।
আখওয়ালা আমার মাথা থেকে পা অবধি এক নজরে দেখেন। তারপর বিড়বিড় করে বলেন, ‘কয় টেকা আনছস?’
আমি সোজা গলায় জবাব দেই, ‘কয় টেকা আনছি, সেইটা শুইনা আপনে কি করবেন? আপনে আউখের দাম কন।’
আখওয়ালা তাগড়াই সেই আঁখখানা হাতে নিয়ে বলে, ‘এই খানের দাম কুড়ি টেকা!’
কুড়ি টেকা! একখান আউখের দাম কুড়ি টাকা!!
আমার বুকের ভেতর যেন রক্ত ছলকে ওঠে! কিন্তু আখওয়ালাকে আমি কিছু বুঝতে দেই না। আমি আবার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি হেঁটে যাই। একটা একটা করে আখ দেখি। একটা একটা করে আখের শরীর। আমার দাঁতের ভেতর, গলার ভেতর, বুকের ভেতর কী প্রবল তেষ্টা! আমি সেই তেষ্টা নিয়ে এপ্রান্ত ওপ্রান্ত করতে থাকি।
আবার একটা আখ দেখাই আঙুলের ঈশারায়। ছোটখাট আখ। বলি, ‘এইখান কয় টেকা?’
আখওয়ালা প্রবল সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকায়, তারপর জবাব দেয়, ‘এইখান আট টেকা’।
আমি পাশের আরও ছোট একখানা আখ দেখিয়ে বলি, ‘এইখান?’
আখওয়ালা প্রবল বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘পাঁচ টেকা।’

আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি। এর চেয়ে ছোট আর কোন আখ নেই সেই সারিতে। তাহলে? তাহলে কি দুই টাকায় এখন আর কোন আঁখই পাওয়া যায় না?
আমি প্রবল শঙ্কা নিয়ে বললাম, ‘দুই টেকায় কোন আউখ নাই?’
আখওয়ালা অনেকখন কোন জবাব দিল না। তারপর হঠাৎ সাথের পিচ্চি ছেলেটাকে ডেকে বলল, ‘নৌকায় যা, ওইখানে আগামরা কয়খান আউখ আছে, একখান আইন্যা এই ছেমড়ারে দে, দুই টেকায় বেচবি’।
ছেলেটা আঁখ নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। আমি সেই আঁখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আঁখটার মাথার পাতাগুলো মরে ঝরে গেছে। কৃশকায় শরীর।
ছেলেটা বাজখাই গলায় বলল, ‘টেকা দে, দুই টেকা’।
আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম, তার চোখভর্তিও প্রবল অবহেলা। আমি সেই অবহেলা উপেক্ষা করে আমার বুকপকেটে হাত দিলাম। দুই টাকা দিয়ে আঁখ নিয়ে বিদেয় হই। কিন্তু সেই চকচকে দুই টাকার নোটখানা আমার সেই ছোট্ট বুক পকেটের কোথাও নেই! কোথাও না!!
তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম।
নেই!
ছেলেটা ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে আখ খানা ছিনিয়ে নিল, ‘এহ, টেকা নাই, আইছে আউখ খাইতে, যা, যা, গাঙ্গের পারেরতন খাইল্যা খা, যা, খাইল্যা খা, খাইল্যা খাইতে টেকা লাগব না’। (নদীর পারে যে কাশফুল হয়, সেই কাশগুলো অবিকল আখের মত, আমাদের অঞ্চলে তাকে বলা হয় ‘খাইল্যা’)
আমি কিছু বললাম না। কাউকে না। চুপি চুপি বাড়ি চলে এলাম। সেই দুই টাকার চকচকে নোটখানা কোথায় গেল, কোথায় হারাল, কিভাবে হারাল, একবার খুঁজেও দেখলাম না।
তখন বিকেলটা মরে এসেছে। আমি সেই মরে যাওয়া বিকেলের ম্লান আলোয় পুকুর ধারের সেই কদম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম একা একা। কেবল একা। একা এবং একা। আমার মাথার চারধারে ঝাঁকড়া কদম গাছের ঘন ডালপালা। সেই ডালপালা জুড়ে শুভ্র টেনিস বলের মতন কদম ফুল। আমি সেই কদমফুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়েই রইলাম। তাকিয়ে রইলাম।
চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। আমার হঠাৎ মনে হল, এই বিশ্ব চরাচরের আমি কেউ না। আমি এক অলীক কল্পনা মাত্র। ‘আমি’ বলতে কোন অস্তিত্ব এই বিশ্ব চরাচরে নেই। এটা অনেকটা স্বপ্নের মতন। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলেই আমি আবিস্কার করব, আমি অন্য কোথাও, অন্য কোন জগতে, অন্য এক আমি, অন্য কেউ। আকাশে মেঘ ডাকল, বিদ্যুৎ চমকাল। সন্ধ্যার বিষণ্ণ আকাশের বুকের ভেতর থেকে তীব্র বেগে নেমে এল প্রবল বর্ষণ। সেই বর্ষণ ছুঁয়ে আমি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলাম। সেই কান্নার কোন রঙ নেই, সেই কান্নার কোন জল নেই। সব বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে গেল। কিন্তু আমি সেইকদম গাছের তলে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলাম। প্রবল হাওয়ায় টুপটাপ করে কদম ফুলেরা ছড়িয়ে পড়ছে আমার চারপাশে। আমি কাঁদছি। কাঁদছি। ঝাপসা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল।
বৃষ্টির জলের ভেতর কান্না।
শক্ত হাতটা আমার কাঁধ ছুঁতেই আমি অবাক চোখে ফিরে তাকালাম, ‘আব্বা!’
এই সময় আব্বা কোত্থেকে আসলো? আজকে তো ঢাকা থেকে আব্বার আসার কথা না!
আব্বা প্যান্ট শার্ট পরে কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। তিনি বাজখাই গলায় বললেন, ‘এই সন্ধ্যাবেলা কেউ বিস্টিতে ভেজে? এই বিস্টিতে ভেজলে জ্বর-জারিরতন রক্ষা নাই, শীগগির ঘরে যা’।
আমি কথা বলি না। দাঁড়িয়েই থাকি।
আব্বা এবার নরম গলায় বলেন, কি অইছে? ঘরে যাও আব্বা, আসনের সময় তোমাগো লইগ্যা কিছু আনতে পারি নাই। তয় হাঁটে বড় বড় আউখ উঠছে, বোম্বাই আউখ। একেকখান কুড়িটেকা দাম। ষাইট টেকা দিয়া তিন তিন খান আউখ নিয়াসছি। যাও ঘরে গিয়া আউখ খাও!’
আমি এবারও কোন কথা বলি না। হতভম্ব হয়ে আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রবল বৃষ্টির তোড়ে হাত খানেক দূরের আজন্ম চেনা মানুষটার মুখও কেমন আবছা লাগে। কেমন অচেনা লাগে! আমি সেই আবছা দৃষ্টি মেলে পুকুরপাড়ের কদম গাছটার দিকে তাকাই। সেখানে সন্ধ্যার ম্লান আলোয়েও যেন ঝলমল করছে শুভ্র কদমের দল। যেন রহস্যময় চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ওই ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো বিশাল কদম গাছটা। আমি আব্বার দিকে ফিরে তাকাই না। ধীর পায়ে হেটে কদমগাছটার শরীর ঘেঁসে দাড়াই। দাঁড়িয়েই থাকি। তুমুল বৃষ্টিতে মিশে যাই অদ্ভুত এক আবছায়ায়।
কাছেই মানুষটা বিভ্রান্ত চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। তার চোখভর্তি অপার বিস্ময়।
আজ, এই মুহূর্তে, প্রায় কুড়ি বছর পর, সেই কদম গাছটার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেই সন্ধ্যায়, সেই বর্ষায়। এই আমি, আর সেই কদম গাছ।
সে কি আছে? আছে এখনও?
সাদাত হোসাইন
কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক
আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা।
ঢাকা, বাংলাদেশ।