মন কেন যে এমন, মানেনা বারণ । পিয়ারা বেগম

  
    

একঘেঁয়েমী জীবন কেউ পছন্দ করে না। একই রকম খাবারও বার বার কেউ খেতে চায় না। তেমনি একই রকম লেখা পড়েও পাঠকেরা আনন্দ পায় না। মনীষীরা বলেন, একঘেঁয়েমীতে বিরক্ত হয়ে ওঠাই নাকি মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। তাই তো নিজের অজান্তেই আমাদের অনেকেরই মন চায় একটু পরিবর্তন।
চাই নতুনত্বের আমেজ। চাই আলাদা শখের কোন অনুষঙ্গ। কিংবা রহস্য, রোমান্স বা ট্রাজেডি বা ভিন্ন মাত্রার কোন লেখা।

আজ আমার মনটা খুব ভালো লাগছে।
তাই ভাবছি, আজ নতুন কিছু নিয়ে লিখব। কিন্তু কি সেটা? ভেবে পাচ্ছি না। মহা মুশকিলে পড়লাম তো? এখন উপায়? মনটা হঠাৎ  খারাপ হয়ে গেল। আচ্ছা, এই যে নিজের অজান্তেই আমাদের অনেকেরই মন চায় এটা করি। ওটা পেতে চাই। আবার মন যে কখন কি চায় তাও বুঝি না। তাহলে, মন আসলে কি? আর মনের চাওয়া পাওয়ার রকমফের, অনুভূতিই বা কেন হয়? কিংবা এই মন ভালো, হঠাৎ খারাপ? এমন কেন হয়? আজ না হয় এটা নিয়েই লিখি।
ভাবছি, মাঝে মাঝে এমনটি তো আমার ক্ষেত্রেও ঘটে। মন যে কি চায়, কেন চায় সেটা নিজেও বুঝি না। একেক সময় কি যেন পাওয়ার আশায় মনটা কেমন যেন ছটফট করে। আবার কখনো কি যেন পাওয়ার তৃষ্ণায় মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। যা কোন কিছুতেই মনটাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। কিন্তু কি সেটা? নির্দিষ্ট প্রাপ্তি, প্রত্যাশা বা চাহিদা কি তাও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। কখনো বা না পাওয়ার বেদনায় মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। কখনো ধুকে-ধুকে পুড়ছে মনটা। কিন্তু কার জন্য পুড়ছে? কে সে রাজপুত্র ? সেটাও স্পটত দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে মাঝেমধ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চিকন সুতার মতো একটা রিনরিনে ব্যথা অনুভূত হয় হৃদয়ের গভীরে। এ ব্যথা কমেও না, বাড়েও না। অসহ্যও নয়, আবার সহনীয়ও নয়। কখনো এমনটা হয়, একটা দুর্দমনীয় ব্যথা সমস্ত শরীরটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। আসলে সেটা বা কেন হচ্ছে ? মানসিক কারণে এমনটি হচ্ছে। তাই তো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ছে না। তবে উপলব্ধির শিরায় শিরায় তা কেমন যেন ব্যথায় টনটন করছে।

শুনেছি, মনকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আজ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানী নাকি মনকে ধরতে বা ছুঁতে পারেননি বা কোন ল্যাবরেটরিতে টেস্ট টিউবে ভরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেন নি। তবে হাজার বছরের পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা হলো  “মন সকল শক্তির উৎস”।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া এক নিবন্ধে বলেছেন, “মন সম্পর্কে নানা জনের নানা মত। গতানুগতিক ধারনা হচ্ছে মানুষের দুটি সত্তা। মানবদেহ বস্তুগত সত্তা ও মন হচ্ছে অবস্তুগত সত্তা। যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। মন সম্পর্কে বিশ্লেষণ মানব জ্ঞানের দুর্জ্ঞেয় বিষয়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে মনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনায় ঐক্যমত্য নেই বললেই চলে। তবে সবাই এ ব্যাপারে কম-বেশি একমত যে, “মন মানুষের বিশ্বাস ও শক্তির উৎস।” তাত্ত্বিক কথা! তা না হয় বিশ্বাস করলাম। কিন্তু এমনটি হবে কেন? কখনো কখনো কিছু না পেয়েও মন কত শান্ত-স্নিগ্ধ-স্থির, কোমল ও প্রসন্ন থাকে। মনে হয় প্রাপ্তির পূর্ণতায় জীবন ভরপুর। প্রশান্তির আমেজে পরিতুষ্ট। তাই তো ভালো লাগার উষ্ণতায় চনমনে হয়ে উঠে মন। তাতে মন-মননে জাগে একটা অসাধারণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আর সেই আনন্দঘন অনুভূতির স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ ঘটে সংসারে, ব্যক্তিজীবনে বা কর্মক্ষেত্রে। শুনেছি, মন ভালো থাকলে গ্রীষ্মের দাবদাহকেও মনে হয় বসন্তের রঙিন বাতাস। তাছাড়া শরীরটাও বেশ প্রাণবন্ত লাগে। আর পৃথিবীটাকে মনে হয় সেরা বিনোদন ক্ষেত্র। তাই তো ফুরফুরে আমেজে আনন্দ ঝংকারে আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মন। আর জীবনটা?
জীবনটা যে কেমন তা বলছি, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগড় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের ভাষায়, “একটা অসম্ভব সুন্দর, অসম্ভব আনন্দে ভরা, সৌন্দর্যে ভরা, আলোয় ভরা আমাদের জীবন।” আসলেও তাই। ঠিক সেই মুহূর্তে জীবনটা এমনই মনে হয়।

সুপ্রিয় পাঠক, তাই তো আমরা অসম্ভব ভালো লাগার অনুভূতিতে উৎফুল্লিত হয়ে বলি, বসের মনটা আজ বেশ ভালো দেখছি, ফাইলটা নিয়ে যাই, সাইন করিয়ে আনি। কিংবা বান্ধবীকে ফোন করে বলি জানিস, আজ আমার মনটা আনন্দে-আহলাদী মনে হচ্ছে। তাই দিনটাও খুব ভাল কাটছে রে। এই যে মনটা ভালো, দিনটা ভালো যাচ্ছে তার অর্থ এই নয় যে, সেই মুহূর্তে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য এসে আমাকে পৃথিবীর সেরা ধনী বানিয়েছে। আর আমিও বিত্ত-বৈভবে, প্রমোদ বিলাসে আকণ্ঠ মগ্ন আছি। কিংবা ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে স্বপ্নীল আবেশে উড়ে বেড়াচ্ছি। আসলে অবস্থা বা পরিস্থিতির আদৌ কোনোই পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে কেবল মনের। মূলত সেই মুহূর্তে আমি যেই লাউ ছিলাম সেই কদুই রয়ে গেছি। অথচ মনের মধ্যে আমি আর আমাতে ছিলাম না। আহা রে! এই এক অন্যরকম সুখানুভূতির অনুরণনে যেন আপ্লুত হয়ে আছি।

ধরে নিচ্ছি, যেভাবে ছিলাম  মানে পরিতুষ্ট থাকা ভালো। এতে মনের প্রশান্তি বজায় থাকে। কিন্তু এমনটি কেন হয়? সবকিছু পেয়েও মন অতৃপ্ত  থাকে। ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। একটা অজানা শূন্যতায় হৃদয়টি খাঁ খাঁ করে। মনে হয় কি যেন ছিল, এখন নেই। সে বিরহকাতর মনে যেন একটা তীব্র অভাববোধ মনকে আলোড়িত করছে।
ভাবছি, হয়তো এটাই জীবন! কখনো আনন্দ, কখনো বেদনা। আরো ভাবছি, এমন পাগলাটে মন নিয়ে কেমন করে এতগুলো বসন্ত অতিক্রান্ত করে এলাম? এই দীর্ঘ সময়গুলো কি এক পাগল-পারা নেশায় মেতে থেকেছি চুর হয়ে। আর বুঁদ হয়ে মোহচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে পড়ে থেকেছি সংসারের মায়াঘোরে। আবার হঠাৎ করে কীভাবে-ই-না সেই নেশার ঘোর কেটে গেছে বুঝতেই পারি নি। হায়-রে জীবন! মেঘে-মেঘে কখন যে বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। এমন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন যেন টেরই পেলাম না। এই যে কত বড় শূন্যতা, কত বড় বেদনা, যাকে বলে পেয়ে হারানোর বেদনা আহা! তা মনে হলে মাথা-মগজের ভেতরটা দপদপিয়ে উঠে। কোন কিছুর বিনিময়ে কী আর ফিরে পাব আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই মধুর শৈশব? সেই কৈশোরের জ্যোতির্ময় মুহূর্তগুলো? যৌবনের বাঁধনহারা উপভোগ্য সেই মধুঝরা মাহেন্দ্রক্ষণ?

সত্যিই পৃথিবীটা যেন অবাক করা, বিস্ময় করা, রহস্যময় এক অচেনা দিগন্ত। যা হবার তা হচ্ছেই। আর যা হওয়ার নয়, তা যেন কিছুতেই হচ্ছে না। কেমন করে সময়ের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিকতা যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হচ্ছে। মনেরও তো পরিবর্তন হচ্ছে। আসলে পৃথিবীটা যেন শুধুই রুপান্তরের।
শিশু যেমন দিনে দিনে নিজস্ব বলয়ে বেড়ে উঠে আর তা কেউ দেখতে পায়না। চাঁদ যেমন ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পূর্ণতার পর আবার ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। কিন্তু কেউ কী চাঁদের বেড়ে উঠা বা ক্ষয়ে যাওয়া স্পষ্ট করে দেখতে পায়? কিন্তু হঠাৎ দেখি আজ পূর্ণিমা আবার হঠাৎ দেখি আজ অমাবস্যার রাত।

তেমনি মানুষের জীবনটাও। প্রকৃতিও এমনি করে বদলাচ্ছে তার গতি, প্রকৃতি সবকিছু।  মূলত সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলে যায়। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির প্রতিটি সত্তা যেমন অহরহ বদলায় মানুষ তেমনি প্রতিনিয়ত বদলায়। তাই তো অনেকেই বলেন, পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে পরিবর্তনই যখন দুনিয়ার রীতি তাহলে প্রতিশ্রুতির-ই-বা পরিবর্তন হবে না কেন? তাই তো অভাবনীয় পরিবর্তনের আলামত দেখতে পাচ্ছি সর্বক্ষেত্রে। আর শিহরিত হচ্ছি।

তবে এই প্রতিশ্রুতির পরিবর্তন হওয়া বা পরিবর্তন করার মানে প্রকান্তরে প্রতারণারই শামিল। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হচ্ছে প্রতারণা। যা একটি নিষ্পাপ মন ভেঙ্গে দেয়। বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় আর দু’চোখের সাজানো স্বপ্ন চোখের জলে বন্যার মতো ভাসিয়ে দেয়। হায় রে মন, তুই কেন করিস এমন? মনের এমন স্বেচ্ছাচারীতার জন্য মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। মন নামক অদৃশ্য এক রহস্যময় শক্তির উচ্ছৃঙ্খলতায় আমিও ক্ষুদ্ধ! কিন্তু হলে কী হবে? তবুও মানুষ বাঁচতে চায় এই মায়াবী পৃথিবীতে। তাইতো মানুষ বেচেঁও থাকে জীবনে কতশত প্রার্থীত চাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে। বেঁচে থাকে না পাওয়ার বেদনার ভার বুকে নিয়ে। কারণ, মানবজীবনে শত সহস্র দুঃখ-বেদনা, হতাশা-ব্যর্থতা, বিরহ-যন্ত্রণা থাকবেই। তবুও জীবন! তাই তো অসংখ্য-অজস্র ভুল ত্রুটির ভেতরেও জ্বলজ্বল করে যে সত্য তা হচ্ছে মানুষের জীবন! জীবনের চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই!!

লেখার শুরুটা যা লিখব ভেবেছিলাম তা আর হলো না। চেয়েছিলাম কি আর লিখলাম-ই-বা কি ? বেমালুম পরিবর্তন। আমারই বা দোষ কি? আমিও তো মানুষ! বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের মধ্যে আছে মন নামক এক রহস্যময় অস্তিত্ব। এই শক্তি রহস্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার সামর্থ্য না কী কম লোকেরই আছে। সুতরাং আমার মতো চুনোপুঁটির উপলব্ধি করার প্রশ্নই আসে না। তবে প্রকৃতির সাথে সাথে যেহেতু মনেরও পরিবর্তন হচ্ছে। হয়তো বা আমারও তাই হচ্ছে। শুনেছি, মনকে সবসময় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মন বুঝে না চোখের ঠাহর। মানে সে বারণ, না মানে অনুশাসন! মন অস্থির, সঞ্চারণশীল। মন চোখের পলকে ঘুরে আসতে পারে, আকাশে, বাতাসে,পাতালে,পাহাড়ে, সাগর-অতলে। কী সাংঘাতিক ব্যাপারস্যাপার! দূরছাই! এই বিচ্ছু মনটাকে নিয়ে এ মুহূর্তে আর ভাবতে চাই না। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব টা তো পেলাম না। মন কেন একেক সময় একেক রকম হয়? মন আসলে কি? মনের শক্তির উৎস্য কোথায়? আর কেন-ই-বা আমাদের ওপর এতটা শক্তির দাপট দেখাচ্ছে?

মনের এমন অগোছালো ছ্যাঁড়াবেড়া অবস্থায় প্রবোধ কুমার সান্যালের একটা লেখা মনে পড়ে গেল। “মনের মানুষ মেলে না সংসারে, মানুষের মন তাই সঙ্গীহীন। আসলে আমরা সবাই একা। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন হয় বাইরের প্রয়োজনে-বন্ধুর প্রয়োজন। সৃষ্টির প্রয়োজন, স্বার্থের প্রয়োজন।” সম্ভবত এই কারণেই হয় তো একজন সুখী দম্পতিও কখনো আনমনা হয়, উদাসীন হয়। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দুজনে ভালোবাসার মৌতাতে মত্ত হলেও যখন একটি বিরহের গান শুনে তখন তাদের কারো মনই আর কারো আয়ত্তে থাকে না। এত পুলকিত থেকেও দুজনার দু’টি মন ছুটে যায় দুদিকে! সেই দূর দিগন্তের অচেনা জগতের নি:সীম নি-রা-লা-য়। কে জানে, কোথায়, কোন মায়া মরিচীকার পানে ধায় !
০৯/১১/২০২০।

পিয়ারা বেগম
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments