বিশ্বের ‘গণতন্ত্রের মহানায়ক’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্প সস্ত্রীক ভারত সফর করে গেলেন। দু’দিন ব্যাপী এই সফরে ভারতকে বিপুল পরিমাণে আধুনিক অস্ত্রের সরবরাহের চুক্তিও স্বাক্ষরিত হলো ভারতকে এশিয়ার সামরিক প্রধান বানানোর লক্ষ্যে। যদিও এশিয়ারই ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী পাকিস্তান ছাড়া ভারতের আর কোন দেশের সাথে কদাপি যুদ্ধ-বিগ্রহ বাধার আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ট্রাম্প যা যা বললেন তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ প্রতিরোধে উভয় দেশ (যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আন্তরিক ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও এই সফর উপলক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এই সফর উপলক্ষ্যে ভারত সরকার, প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারি তহবিল থেকে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন তা নজিরবিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক। ঐ বিপুল ব্যয় যে উদ্দেশ্যমূলক – তার প্রমাণও হাতে নাতেই পাওয়া গেল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণায়।
অপর পক্ষে এই সফর উপলক্ষ্যে দিল্লীর মানুষও হয়ে ওঠেন সরব। তাঁরা হাজারে হাজারে রাস্তায় নামে সিএএ বা সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নামক মোদি সরকার কর্তৃক প্রণীত ও পাসকৃত এক ঘোর সাম্প্রদায়িক আইনের বিরুদ্ধে। সবারই জানা, ঐ সংবিধান সংশোধনী পাশের লক্ষ্য হলো বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদেরকে ভারত থেকে বিতাড়ন করা। এমন একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার বিরোধী আইন প্রণয়নের কথা আজকের সভ্য দুনিয়া কল্পনাতেও আনতে পারে না।
আইনটি গত বার যখন প্রণীত হয় তখন থেকেই তার বিরুদ্ধে ভারতের সকল প্রান্তের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ, ভারতে হাজার হাজার বুদ্ধিজীবী, ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ ঐ সংশোধনী বাতিলের দাবীতে পথে নামেন। সে আন্দোলন চলেছে সমগ্র ভারত জুড়ে। একের পর এক রাজ্য বিগত কয়েক মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বি.জে.পিকে “না” বলেছে বিজেপি বিরোধী শক্তিসমূহকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। অতি সম্প্রতি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপি শত চেষ্টা সত্বেও গো-হারা হেরে যায়। নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের দল পায় মাত্র ৭টি আসন-আর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল বাকী ৬৩টি আসনে বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয়ী হয়ে তৃতীয় দফার মত সরকার গঠন করেছে। রাজধানী দিল্লীতে অবস্থানরত মোদি সবকার প্রত্যাখ্যাত হলো খোদ দিল্লীতেই।
তার ওপর আবার ভারতে অর্থনীতির ক্রমাবনতি। দক্ষিণ-ভারতে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন বহু কৃষকের আত্মাহুতি। সর্বত্র মানুষের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান। হিন্দুত্বের শ্লোগান আর যেন মানুষকে আকৃষ্ট করছে না। ভাতের দাবী, কাজের দাবী মুখ্য দাবীতে পরিণত হচ্ছে। বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মানের অনুকূলে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণাতেও ভারতরে মানুষের মনে কোন উল্লাস দেখা যায় নি। ঐ সময় কলকাতায় ছিলাম-চেষ্টা করেছিলাম মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে। কিন্তু না। যা ভেবেছিলাম তা আদৌ ঘটলো না।
বিজেপি’র তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল প্রভাবশালী কোন দেশের সার্টিফিকেট আদায়ের। সেই কাজে ডোলাল্ড ট্রাম্পের সফরকে ব্যবহারের মতলব থেকেই তাঁর সম্বর্ধনার এহেন আয়োজন। ট্রাম্প-মেলানিয়া উভয়েই পরিতুষ্ট। ট্রাম্প-মোদির আন্তরিকতাপূর্ণ গদ গদ আলিঙ্গনের ছবি দেখে তেমনটাই মনে হয়।
এর পটভূমিতে সমরাস্ত্র ক্রয়ের বিশাল চুক্তি। আজকে দেখানো ভারত একটি শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। সাথে সাথে অর্থবহ ঘোষণা “উভয় দেশ ইসলামি সংগ্রাম প্রতিরোধে পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করবে। অর্থাৎ ঐ কাজে আমেরিকা ভারতকে সহায়তা করবে।
সন্ত্রাস দমনেরও সাম্প্রদায়িকতার লেবাস ছাপানোর মাধ্যমে আবারও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ার চেষ্টা এক ঢিলে বহু পাখি মারার উদ্যোগ। তার মধ্যে জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাই প্রদান যদিও সেটা অপ্রকাশ্য।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী-মুসলিম বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার অবতার। তাঁর নির্বাচকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক প্রচারণা লক্ষ্য করা গেছে। বিজয়ের পর ট্রাম্প সরকারের গৃহীত বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপ সেখানকার উচ্চ আদালত বাতিল ও বে-আইনী ঘোষণা করেছিলো।
সেই সাম্প্রদায়িক প্রেসিডেন্টের ভারত সফরকে ভারতে জনগণ ভাল চোখে দেখেনি। তাই বিক্ষোভ চলছিল তাঁর ফিরে যাওয়ার দাবীতে। জবাব পুলিশী পদক্ষেপ। ক্রোধান্বিত সিএএ বিরোধী দিল্লীবাসী ঐ কুখ্যাত সম্প্রাদয়িক আইন বাতিলের দাবীতে একই সাথে হাজারে হাজারে মোদিও বিজেপি বিরোধী শ্লোগান নিয়ে মাঠে নামলে ট্রাম্পের নিরাপত্তা রক্ষার নামে কঠোর পুলিশী ব্যবস্থা নিয়ে দিল্লী নগরীর বিরাট পুলিশী ব্যারিকেডের আওতায় আনা হয়। সৃষ্টি হয় এক যুদ্ধের আবহ।
ভারত সরকার যেন দিল্লীবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ঘন্টায় ঘন্টায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলো। মানুষের মৃত্যু তার দেহে আঘাত লাগা প্রতি মুহুর্তের ঘটনায় পরিণত হলো।
এ পরিস্থিতিতে বিজেপির কতিপয় নেতা সাম্প্রদায়িক উসকানীমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করার সুযোগে সেখানে আগুন নিয়ে খেলা শুরু হলো। বিজেপির সন্ত্রাসী হিন্দু গুণ্ডারা একটি মসজিদও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলো। প্রতিবাদী মুসলিমদের কয়েকজনকে হত্যা এবং লুটপাট শুরু হলো। পুলিশ যথারীতি নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে যথারীতি সন্ত্রাসীদের সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে সহযোগিতা করলো।
বিষয়টি মুহুর্তে আগুনের মত দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করলো। বহু হিন্দু প্রতিবেশী মুসলিমদের অনেককে বাঁচালেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দিল্লীর জনতার প্রতিরোধ নতুন মাত্রা পেল।
কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির ক্রম অবনতি থামলো না কিছুতেই। প্রতিবাদী হিন্দুদের অনেকের জীবন আহুতিও দিতে হলো-হিন্দু-মুসলিম নির্বিচারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করতে থাকলেন, তারমধ্যে পুলিশের গুলি ভাইয়ে ভাইয়ে গুলি উভয়ই চলল উম্মাদের মত।
এ পরিস্থিতিতে এলো আদালতেরে হস্তক্ষেপ। দিল্লী হাইকোর্টের একজন বিচারক মুবলিধর উসকানী মূলক বক্তৃতা বিবৃতি দেওয়া বিজেপি নেতাদেরকে গ্রেফতারের আদেশ দিলেন। পুলিশ গ্রেফতার তো করলোই না রাতের গভীরে সংগোপনে ঐ বিচারককে দিল্লী হাই কোর্ট থেকে পাঞ্জাব হাইকোর্টে বদলি করে এক অভূতপূর্ব আদেশ দেওয়া হলো। ভারতের এতকাল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটা সুনাম ছিলো। এই আদেশ দিয়ে তাকে ভূলুষ্ঠিত করা হলো।
বিরোধী দলগুলি-কংগ্রেস, বাম দলগুলি সহ সকল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনৈতিক দল তীব্র প্রতিবাদ জানালেও পরিস্থিতির কোন উন্নতির খবর এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত জানা যায় নি। পরিস্থিতির বরং অবনতিই ঘটে চলেছে নিরন্তর, কলকাতা টিভির ভাষ্য অনুযায়ী। ঐ টিভির খবরের শিরোনাম “দিল্লী জ্বলছে”, “দিল্লীতে মৃত্যুর মিছিল”।
বলা মুসকিল, এ আগুন আর কয়দিন জ্বলবে-দিগ্বিদিক কতটাই বা ছড়িয়ে পড়বে-কতই না প্রাণ নাশ ঘটবে-কতই না বাড়ীঘর-দোকানপাট-বিপণী পুড়ে ছাই হবে।
একটি খবর অবশ্য কিছুটা স্বস্তি আনে। দিল্লী হাইকোর্ট দিল্লীর পুলিশ-প্রধানকে আদালতে তলব করেছেন-উস্কানীমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দানকারী বিজেপি নেতাদেরকে গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া সত্বেও পুলিশ তা কেন কার্য্যকর করল না তার কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য পুলিশ প্রধানকে আদালতে তলব করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: কংগ্রেস নেত্রী মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বে মনোমহন সিং সহ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ বিজেপি পরিচালিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হাইকোর্টের জজ বদলি প্রভৃতির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং এগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাত করে তাঁদের দাবী সম্বলিত একটি স্মরকলিপিও অর্পন করেছেন।
কলকাতায় তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে মহিলারা একটি বিশাল মিছিল করেছেন দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিচালনাকারী বিজেপির বিরুদ্ধে।
হয়তোবা শীঘ্রই দাঙ্গা থামবে। থামতেই হবে। কিন্তু অকস্মাৎ এই ঘটনার ফলে নতুন করে যে দগদগে ঘা ভারতবাসীর দেহে গজিয়ে উঠলো সে ঘা সারানো যাবে কিভাবে কত দিনে? অথবা আদৌ কি তা সম্ভব হবে?
ইসলামের নামে হিংস্রতা-অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাস, জঙ্গীপনা বিশ্বব্যাপী আতংকের সৃষ্টি করেছে, বিশ্ব সভ্যতা ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। তার চাইতে ভারতের এই হিন্দু সন্ত্রাস, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু জঙ্গীপনা কি কিছু কম? কোন ক্রমে বা কোন অজুহাতেই তাকে কি ছোট করে দেখার কোন অবকাশ আছে?
দিল্লীর চার চারটি জনপদ-জাফরাবাদ, মৌজপুর, চাঁদবাগ ও করোলবাগের অবস্থা এখনও ভয়াবহ। সেই এলাকাগুলিতে ১৪৪ ধারা জারী আছে। দিল্লীতে ৪৫ কোম্পানী এবং ৮০০ বাড়তি জোয়ান মোতায়েন করা হয়েছে।
তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে-চলমান দাঙ্গা বন্ধও হবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে দাঙ্গা বন্ধ হবে কি?
ভারতে বাম মন্দির নির্মাণ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল সে ক্ষত কি পুরাপুরি শুকিয়েছে। অনেকটা শুকিয়ে আসছিল বটে। কিন্তু তা হতে না হতেই আবারও দাঙ্গা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যা বাতিলের দাবীতে এই আন্দোলন সেই কুখ্যাত আইনটি বাস্তবায়নের জিদ তাদের। এই জিদ থাকলে সংঘাত বন্ধ হওয়া অসম্ভব।
এখন সব কিছু দেখে শুনে বলতে ইচ্ছে হয়, “ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু”।
আসলেই সাম্প্রদয়িকতাজনিত রক্তাক্ততা, দাঙ্গা-জনিত লাশের মিছিল, আর্তজনের কান্না কোটি কোটি মানুষের চোখের অশ্রু আর অসহায়তা দেখতে দেখতে বা তাঁদের সেই গগণ বিদারী আর্তনাদ শুনতে শুনতে এই উপমমহাদেশের মানুষেরা ক্লান্ত।
সাম্প্রদায়িক সংঘাত চলছে চল্লিশের দশক থেকে। তা থামানো দাওয়াই হিসেবে পাকিস্তান নামক দানবকে পয়দা করা হলো। আবার তা থেকে রক্তের সমুদ্রের বিনিময়ে বাংলাদেশ আনা হলো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার প্রত্যায়ে। এক দেশ ভেঙ্গে তিন দেশ হলো। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা কি গেল? দাঙ্গা কি বন্ধ হলো? দাঙ্গাকারীরা কোন দেশেই কি শাস্তি পেল?
না, সাম্প্রদায়িকতা যায়নি-বেড়েছে? দাঙ্গা বন্ধ হয়নি-মাঝে মাঝেই তা হানা দিয়ে চলেছে। দাঙ্গাকারীরা কোথাও সাজা পায়নি বরং পুনর্বাসিত হয়েছে।
তাই স্থায়ীভাবে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধে সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। ভুলে যেন না যাই। হিন্দু মরছে না, সুসলমান মরছে না, বৌদ্ধ-খৃষ্টানও মরছে না। মরছে মানুষ।
রণেশ মৈত্র
কলামিস্ট, লেখক, রাজনীতিক।
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।