আমাদের কৈশোরের দিনগুলোতে বিনোদনের অন্যতম একটি অংশ ছিল রেডিও (বাংলাদেশ বেতার) শোনা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কখন কোন অনুষ্ঠান হতো আমাদের রীতিমত মুখস্ত ছিল। দুপুরের দিকে ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান, রাতে সৈনিক ভাইদের জন্যে ”দূর্বার” সবই চান্স পেলেই শুনতাম। বলা যায় গোগ্রাসে গিলতাম…
আমাদের সিনিয়র যারা রেডিও অনুষ্ঠানের ভক্ত ছিলেন, তাঁদের প্রিয় শিল্পীর তালিকা তখনও আমাদের ঠিক ঠাক বুঝে উঠার বয়স, জ্ঞান, গরিমা হয়ে উঠেনি। তারপরও মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম আমাদের মা, বাবা, খালা, মামা, চাচারা বিশেষ করে শিল্পী মাহমুদুন্নবী, আব্দুল জব্বার, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, রুনা, সাবিনা, নিলুফার ইয়াসমিনের মত শিল্পীকে যারা শুনতেন, পছন্দ করতেন, তাঁদের প্রিয় তালিকায় সব সময়ই যে শিল্পী থাকতেন তিনি সুবীর নন্দী।
শুরু থেকেই শুদ্ধ ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত ধারার একজন শিল্পী এবং গানের মানুষ।
‘’চাঁদে কলঙ্ক আছে যেমন,
ভালোবাসায় বদনাম তেমন’’
তাতে টললো কোথায় কবে প্রেমেরও আসন, প্রেমিকের মন’’
কী ভীষণই মন ছোঁয়া।
আমার যতদূর মনে পড়ে, আম্মা আব্বার সাথে সিনেমা হলে যেয়ে প্রথম দিকে যে সিনেমাগুলি দেখেছি, তার মাঝে একটি ছিল, ‘শুভদা’। সেই সিনেমার যে গানটা আমার অবুঝ মনকে অন্যরকম এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করেছিল, ঘোরে নিয়ে গিয়েছিলো সেটি হচ্ছে ‘’তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’’। আহা কী দরদ কী দরদ !
বলা যায় রেডিও শুনতে শুনতেই আমি গান শোনায় আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিটা দিনের বড় একটা অংশ গান না শুনলে পার হতোনা যেন। আধুনিক বা সিনেমার গানের মাঝে অন্য সব শিল্পীর মাঝে যখনই রেডিওতে শিল্পী সুবীর নন্দীর কন্ঠ উঠে আসতো। নড়েচড়ে বসে শুনতাম, মাথায় ঢুঁকে গিয়েছিলো, তাঁর গান মানেই এটা শুদ্ধতম সুরের খেলা। মন দিয়ে শোনার মত কিছু, উপভোগ করার।
কী এক অদ্ভুত কারণে তাঁর গলায় একটা বিষণ্ণতা কাজ করতো। সুবীর নন্দী যখন গাইতেন, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ মনে হতো ও তাহলে নেই!
যখন গাইতেন, বুকের ভিতর রক্ত ক্ষরণ, ভালোবাসা, মনেই হতো, তাই বুঝি!
যখন গাইতেন, কথা দাও, কথাগুলো ফেরত নেবেনা, আহা মনে হতো কী করে সম্ভব!
অন্য রকম সুবীর নন্দীকে পাই আমরা ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে এই গানে’’!
মূলতঃ মৌলিক গানেই তিনি ছিলেন অসাধারণ। রোমান্টিক ডুয়েটে খুব বেশী পাওয়া যায়না তাঁকে। তারপরও বেশ কজন শিল্পীর সাথে আছে অসাধারণ জনপ্রিয় কিছু গান, ‘’ঐ রাত জাগে ঐ চাঁদ জাগে, হায় তুমি কোথায়’’? ‘’বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাব’’ ‘’বল কে বা শুনেছে এমন পিরিতি কথা’’ রুনা লায়লার সাথে। যেন ঐ গান তাঁর সাথেই গাওয়া না হলে হতোইনা এবং মনে যথারীতি গেঁথে যাওয়ার মত।
তাঁর আরেক জনপ্রিয় গান, ‘দিন যায় কথা থাকে’ যখন প্রথম শুনি, স্কুলে পড়ি। আমার ছোট ভাই, বেশ ছোট ৩/৪ বছর হবে। ওকে সেই রেডিও থেকেই শুনে শুনে কিছু গান গাইতে শোনা যেত। কোন কারণ ছাড়াই সে প্রথম শিখলো ‘’ওগো সিংগাপুরি মেম, তুমি কব্বা (সে তাই বলতো) নাকি পেম’’ এবং আর যেটা খুব মন দিয়ে গাইতো, তা হচ্ছে ‘’দিন যায় পতা কাথে’’ (কথা থাকে, বলতে পারতোনা) এই স্মৃতি আজও মধুর স্মৃতি আমার পরিবারে।
সুবীর নন্দী যা ইচ্ছে তাই গাইতেন না। মূলত সুর নিয়ে কাজ করা যাবে এমন গানই বেশী করে গেছেন এবং তাঁর বেশীর ভাগ গান তাই শুধু তাঁরই হয়ে আছে, থাকবে। ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’ আরো অনেকে গাইতে চেষ্টা করলেও তাঁকে ছাপিয়ে যাওয়াটা আর চোখে পড়েনি।
সম্ভবত, চ্যানেল আই এর সেরা কন্ঠের এক অনুষ্ঠানে অতিথি বিচারক হয়ে এলেন একবার। ‘নদী’ নামেই বোধ হয়, এক গায়িকা গান করলো, একটা সিনেমার গান। গান শেষ হওয়ার পর বিচারকেরা যথারীতি প্রশংসা করলেন। সুবীর নন্দী মেয়েটিকে বললো, তোমার সুর আছে, গান গেয়েছো, কিন্তু আমার শব্দটা কেন বারবার ‘’আমমার বলছো’’। আসলে সুবীর নন্দীরা যে সময়ে গান করেছেন তাঁরা সুর বা শব্দকে বিকৃত করে জনপ্রিয়তা আদায় করবেন এমন ভাবনা কল্পনাও করতে পারতেননা বোধ হয়।
সুবীর নন্দী আজ ৭ মে ২০১৯ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, অপার অনন্ত যাত্রায়… অসুস্থ ছিলেন, তাঁকে সুস্থ করতে শেষ সময় পর্যন্ত দেশের মানুষের ভালোবাসা, রাষ্ট্র ছিলো তাঁর পরিবারের পাশে। তাঁরপরও নিষ্ঠুর সময় ছিনিয়েই নিল তাঁকে আমাদের কাছ থেকে, মায়াজাল ছিন্ন করে। বাংলাদেশের গানের ভুবন হারালো আরেক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।
সুবীর নন্দী চলে গেছেন, পরিবার এবং রাষ্ট্র হারালো একজন গান অন্তপ্রাণ মানুষ, বিনয়ী এবং সহজাত শিল্পী। এই শোক থেকেই যাবে, ছোট্ট কিছু সান্ত্বনা জীবদ্দশায় তাঁকে কিছুটা হলেও মূল্যায়ন করা হয়েছে। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’।
কিছুটা বলছি, কারণ তাঁর কণ্ঠকে আমরা আরো অনেক মহিমান্বিত করার মত গানই সৃষ্টি করতে পারিনি।’একটা ছিল সোনার কন্যা’ ‘ও আমার উড়াল পংখী রে’’ এমন গান দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সিনেমায় যেমন উঠিয়ে এনেছেন সুবীর নন্দীকে আমাদের গানের ভুবনে।
সুবীর নন্দী সঙ্গীতপ্রিয় মানুষদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর গান আশা করি খুব ভালোবেসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যত্ন করে কন্ঠে তুলে নেবে। আমি তাঁকে শুনি, সময় পেলেই, আরো প্রিয় শিল্পীর মাঝে তিনিও একজন আমার, এবং শুনেই যাব আমৃত্যু।
যে বিষয়টি বলে আজ শেষ করতে চাই, হালের জনপ্রিয় ইউ টিউব বাংলা চ্যানেল ‘’গান বাংলা’’ উইন্ড অব চেঞ্জ এর প্রধান কৌশিক হোসেন তাপস বাংলাদেশের বিখ্যাত সব শিল্পীর গানগুলো বেশীর ভাগ শিল্পীদের স্বকন্ঠেই রিএরেঞ্জ করছে। ফিউশন যাকে বলে… মূল সুর ঠিক রেখে। অনেকগুলো কাজ রীতিমত প্রশংসার দাবী রাখে।
তবে আমার কাছে তাপসের এ পর্যন্ত করা যে দুটো গান মূল গান মানে প্রথম করা গানকেও ছাড়িয়ে গেছে তাঁর দুটো সদ্য প্রয়াত এই শিল্পী ‘সুবীর নন্দীর’’
১। আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
২। পাখিরে তুই দূরে থাকলে, কিছুই আমার ভালো লাগেনা।
আমি নিশ্চিত বাংলা গানের ভক্তদের শোনা হয়ে গেছে গান দুটোই। আবার শুনে দেখবেন। শিল্পী স্বার্থক তাঁর নিজের গানকেই কী দরদ ঢেলে দিয়ে আরো এক অন্যরকম সুন্দর জায়গায় রেখে যেতে পেরেছেন। আমরা তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে এই গান শুনতে পারবো বারবার অসংখ্যবার।
‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানে গানে করেছেন মিনতি, কিন্তু আজ তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে হৃদয় আর মানছে কই।
সুবীর নন্দী, আপনার চলে যাওয়া পথ ধরে আকুল নয়নে চেয়ে চেয়ে কেন যেন গাইছি,
‘’আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়…
কখনো নদীর মত তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়’’।
নাদিরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, রেডিও বাংলা
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
৭ মে, মেলবোর্ন।