মাতাল শিশু(ধারাবাহিক উপন্যাস)১৬পর্ব- মোয়াজ্জেম আজিম

  
    
মোয়াজ্জেম আজিম

১৬তম পর্ব:
খবিশ চলে যাওয়ার পর আমি মনে মনে বেশ স্বস্তিতে ছিলাম। মাকেও আমার মনে হয়েছে খুব একটা খারাপ নাই। অন্তত খবিশের জন্যে মন খারাপ করেনি। এক বেলাও ওর জন্যে না খেয়ে থাকেনি। একদিনের জন্যেও অফিস কামাই করেনি। সুতরাং বলা যায় বেশ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল ঘরে। মুন্নিকে আমার একটু উতলা মনে হয়েছে। কিন্তু ওর তো আর বলার কিছু নাই, তাই না? কাজের লোক যতটুকু পাত্তা পাচ্ছিস তা তো তোর নতুন বয়সের জন্যে। মাকে এখন একটু অন্যরকম লাগে। মা পারতপক্ষে ওনার পুরোনো বান্ধবীদের সাথে ফোনালাপ করে না। কিন্তু কখনও কখনও ওরা তাকে ফোন করে। নানারকম ইনফরমেশন দেয়। একজন একদিন ফোন করে কী কী যেন বলছে, আর মা শুধু তাই নাকি তাই নাকি করছে। শেষ পর্যন্ত বলছে যে সাগর আর এখন আমার সাথে থাকে না। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। সো, দয়া করে ওর কোনো ইনফরমেশন আমাকে দেয়ার জন্যে ফোন করিস না। আমি তোদের দোয়ায় বেশ ভাল আছি। তুই ভাল থাকিস। বলে মা ফোন রেখে দিলো। সেদিন মাকে একটু বেশ মনখারাপ করা মুখ দেখলাম। সন্ধ্যাটাই মাটি করে দিলো মাতারি। কোন আন্টি আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে মাতারি যে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। মার বান্ধবীগুলো সবই শয়তানের হাড্ডি। মার আড়ালে সারাক্ষণ খবিশের সাথে টাঙ্কি মারতো। আর মাঝে-মধ্যে আসলে যেতেই চাইতো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলবে। আর সবই হলো ছেলেদের নিয়ে। কে কবে তাকে চোখ মেরেছে। কে কবে চিঠি দিয়েছে। কে কবে এসএমএস করেছে, কে কবে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে এবং সে না করে দিয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার শুনে গা জ্বালা করতো, মার করতো কিনা কে জানে। আমার মনে হয় মা এনজয়ই করতো। দুইজনের সে কী হাসি! আমার মনে হতো ছেলেদের নিয়ে সেক্সি-সেক্সি কথা বলার মধ্যে মনে হয় দুনিয়ার মজা। যাগগা, এই শয়তানগুলোর কথা মনে হলেও আমার রাগ হয়।

ইদানীং আমার নতুন করে নানা অসুখ-বিসুখ দেখা দিচ্ছে। পেটের সমস্যায় কিছুই খেতে পারছি না। খেতে পারছি তো হজম করতে পারছি না। হজম করতে পারছি তো হাগু করতে পারছি না। হাগু করতে পারছি তো বেশী করে ফেলছি। সর্দিজ্বরও লেগেই আছে। মাঝে-মধ্যে মনে হয় খোদার কাছে প্রার্থনা করি Ñ আমারে উঠায়ে নাও খোদা। আবার মনে মনে ভয়ও হয়, যদি সত্যি সত্যি কবুল করে বসে তো আবার মহা ঝামেলা! মার এত হাজারো-রকম চেষ্টা, দেখা গেল এক দোয়াতেই খতম। যদিও আল্লার কাছে কিছু চাইলেই পাওয়া যাবে অত সোজা না। তবে এই ব্যাপারটা ঘটে যেতে পারে। কারণ মানুষতো আর সত্যি সত্যি এটা চায় না। ভুল করে চায়। আর ভুল করে কিছু চাইলে উনি আবার না করতে পারে না। ওনার দয়ার শরীর, ওনারে দিয়া কোনো বিশ্বাস নাই, অঘটন-ঘটানোর মহা উস্তাদ!
মা তো খুবই চিন্তিত। কী করবে। চিন্তা ছাড়া আর তো কিছু করারও নাই। মবিন সাহেব বলেছে, এইসব ছোটখাট অসুখ-বিসুখে তো ওষুধ খেতে হবে। কিচ্ছু করার নাই। তাই তিনি বলেছেন, আবারও তালুকদারের কাছে একবার যেতে। মা ঠিক করেছে, আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই যাবো। এদিকে মুন্নিও মার সাথে বেয়াদবির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। যখন-তখন মার সাথে তর্ক জুড়ে দেয়। মা ধমক দিলেও থামে না। শেষ পর্যন্ত মা হাত তুলতে বাধ্য হয়। যখনই দেখে মা মারমুখী তখনই সে মাকে হুমকি দেয় চলে যাবে বলে। তার গায়ে যদি হাত পড়ে তাহলে সে আর এক মুহূর্তও এই বাসায় থাকবে না। সে কালই চলে যাবে এমন থ্রেট খাওয়ার পর মাও কেমন যেন চুপসায়ে যায়। না গিয়ে কোনো উপায় আছে? মুন্নি যদি এখন চলে যায় তো আমাদের না খেয়ে মরতে হবে! মা তো আর আমাকে একা বাসায় রেখে কাজে যেতে পারবে না। মা অবশ্য খোঁজখবর নিচ্ছে কোথাও কোনো বাসায় ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। মার বস বলেছে উনি বাড়তি কিছু টাকা না-হয় আমার জন্য দেবে। আমারও কেন যেন মনে হচ্ছে যে-কোনদিন মুন্নি চলে যেতে পারে। ঐ আইসক্রিমওলা ছেলেটার সাথে উড়াল দিতে পারে। কিন্তু কোনো কথা তো বলতে দেখি না! আমি তো সারাক্ষণ ওর সাথে! শুধু উতলা মন নিয়ে রুম আর বারান্দা, বারান্দা আর রুম করতে দেখি! খবিশের চলে যাওয়াটা ওকেই বেশী জ্বালাতন করছে। আজব দুনিয়া, মার বয়ফ্রেন্ড, প্রেমের অনলে জ্বলে মুন্নি ! অবশ্য মুন্নির সাথেও তো প্রেম ছিল। সত্যমিথ্যা যা-ই হোক, প্রেম যে ছিল তার সাক্ষি তো আমি নিজেই। আমার খুব অবাক লাগে, মা এতকিছু জানার পরও খবিশকেই বিশ্বাস করতো! অবশ্য খবিশ খুব বড় বড় কথা বলতো সব সময়। সারাক্ষণ কসম কেটে কথা বলতো। ও যে-কোনো বিষয়কে চমৎকারভাবে বোঝাতে পারতো। ওর সাথে কথা বলার পর মার আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। খারাপ মানুষ খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। আর কখনই নিজের দোষ স্বীকার করবে না। সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, ও যা-বলবে তা-ই ঠিক। যা-ই হোক, ওকে নিয়ে আমি এত চিন্তা করছি কেন! আসলে আমি ওকে নিয়ে চিন্তা করছি না, করছি মুন্নিকে নিয়ে। ও না আবার চলে যায়! খবিশ এসেও ওকে ভাগাতে পারে কি? না মনে হয়। মাকে ঘাটাতে আসবে না। তাইলে তার খবর আছে। কিন্তু মুন্নির চিন্তা আমার মাথায় কেন এত জেঁকে বসেছে তা তো বুঝতে পারছি না। ওকে কি আমি ভালবাসি? মনে হয় বাসি। ওকে কি আমার ইচ্ছা হয়? কিন্তু ওকে আমি তো কোনদিন পাবো না এটাও তো ঠিক। তাহলে চিন্তা করি কেন? চিন্তার উপর কি আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই? মাথা কি যা-খুশি তা-ই ভাবতে পারে? এমন বেশরা-মাথাকে থেঁতলে দিলে কেমন হয়? অবশ্য আমি তো মনে মনে কত কিছুই চিন্তা করি। খবিশকে তো কত গালাগালি করি। তা যদি সত্যি সত্যি মুখে বলতাম তাহলে খবিশ নিশ্চয় আমাকে খুন করে ফেলতো। এবং মাও নিশ্চয় তাতে সায় দিতো। দিতো কী? কী জানি বাবা!
যাগগা, বেহুদাই নানা কুচিন্তা করতেছি। তার চেয়ে ববং টিভি দেখা ভাল। উঠে ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিলাম। এখন অ্যাড হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হবে দুপুরের খবর। খবর হবে শুনে মুন্নি এসে দাঁড়ালো এককোনায়। আমি বললাম, কী ব্যাপার মু্িন্ন, তোর কোনো কাজ নাই? তুই যে এখন টিভির সামনে এসে দাঁড়ালি?
-আমাকে খবর দেখতে হবে।
-খবর দেখা শুরু করলি আবার কবে থেকে? আমি তো জানি তুই খালি সিনেমা আর হিন্দি সিরিয়াল দেখিস!
-না, আমি এখন খবরও দেখি। খবর দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। দুই দল মারামারি করে। বড় বড় মানুষগুলা কুত্তার মতো লেজ গুটায়ে দৌড় দেয়। আমার মজা লাগে।
-কিন্তু আমি তো মারামারি দেখতে পারি না। দেখলে ভয় লাগে। পুলিশ লাঠি যেই উঠায়, মনে হয় আমার মাথায় বাড়ি পড়বে এখনই।
মুন্নি শুনে হাসে।
-এই গুলান তো টিভিতে। মাথায় বাড়ি পরবো কেমনে? হিহিহি!
-এই হাসবি না। এটা কোনো হাসির কথা না।
মুন্নি আরো হাসে। হিহহিহিহি!
আমি টিভি দেখা রেখে আবার বেডরুমে চলে যাই।
কিছুক্ষণের মধ্যে খবর শুরু হয়।
প্রথমেই শিরোনাম।
-চিলমারীতে জামাত ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ। নিহত এক, আহত অর্ধ শতাধিক।
-বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের হাতে ৩২ জেলে খুন। ১৮টি লাশ উদ্ধার।
-গার্মেন্টসে আগুন। জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে চারজন নিহত। আহত শতাধিক।
আমি আর শুনতে পারছিলাম না। চিৎকার করে উঠি। মুন্নি সাথে সাথে দৌড়ে আসে। কী হয়ছে, ভাইয়া?
-আমাকে ড্রিংস দে, আমার নেশা ছুটে গেছে।

মুন্নি অন্যসময় হলে সময় দেখতো ড্রিংস দেওয়ার সময় হয়েছে কিনা। আল্লার রহমত এখন সে কোনো প্রশ্ন না করে ড্রিংস নিয়ে আসে। আমি একটা চুমুক দিতেই মেজাজটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এখন দেখতে পারবো সবই, মজাও পাবো মনে মনে। এরপর মনোযোগ টিভি স্ক্রিনে দিয়ে খবর এনজয় করা শুরু করি। এখন আমারও মারামারি দেখতে খুব ভাল্লাগতাছে। মুন্নি আর আমি মোল্লা আর পুলিশের মারামারি দেখে হেসে খুন। টুপি মাথায় পায়জামা পরা লোকগুলো লাটিসোটা নিয়া দৌড়াদৌড়ি খেলে। মুন্নি কয়, গোল্লাছুট খেলে। আমি ওরে জিগায়, গোল্লাছুট কী? মুন্নি কয়, দৌড়াদৌড়ি খেলা। মনে হয় পুলিশের সাথে ওরা গোল্লাছুট খেলতেছে। এক জায়গা থৈক্কা আর-এক জায়গায় যাইতে হয়, কেউ যেন না ছুঁইতে পারে। যদি ছুঁয়ে ফেলে তো হেরে গেল। আমার মনে হচ্ছে পুলিশ কিন্তু ভাল গোল্লাছুট খেলতে পারে না। তার চেয়ে বরং মৌলবী-সাহেবরা ভাল গোল্লাছুট খেলতেছে। তবে এদের খেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি নাই, আছে ঠেঙ্গাঠেঙ্গি। বেশীরভাগ মৌলবী-সাহেব ঠেঙ্গানি খাচ্ছে। পুলিশ ভাইরা খাচ্ছে মাঝে-মধ্যে। হঠাৎ দেখি একজন বোটকা পুলিশকে তাড়া করতেছে বেশ কয়েকজন মৌলবী। পুলিশটা দশ গজ দৌড়ানোর পরই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। আর মৌলবীর দল ওনার উপর ঝাঁপায়ে পড়ে লাঠিসোটা নিয়ে। পুলিশ ভাইরে এমন পাবলিকের মতো কইরা পিটাইতে এর আগে দেখি নাই। কিন্তু মুশকিল হলো এই টেলিভিশনের শয়তান মেয়েগুলি। যখন একটা মারাত্মক ইমপোর্টেন্ট দৃশ্য দেখানো শুরু করে তখন সেটা শেষ না করেই উনাদের কথা বলার খায়েস হয় এবং উনারা বকরবকর করতে শুরু করে দেয়। ধ্যাৎ! পুলিশের কী হইল তা শেষ হওয়ার আগেই টিভির এই মহিলার জন্যে আর দেখতে পারলাম না।
চলবে।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments