মাতাল শিশু(১০ম পর্ব)/ ধারাবাহিক উপন্যাস -মোয়াজ্জেম আজিম

  
    
মোয়াজ্জেম আজিম

দশম পর্ব:
আমার মনে হয় আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। মাকে আর ইদানীং সহ্য হয় না। বরং মুন্নির উপস্থিতি এক ধরনের পুলকের মাঝে আমাকে ডুবিয়ে রাখে। এই ব্যাপারটা ধরতে পেরে নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। আমি যত বড় হচ্ছি ততই কেমন যেন অন্য মানুষকে সহ্য হচ্ছে না। সবার মধ্যেই দেখি বিরক্তিকর সব বিষয়-আশয়। আমার মনে হয় সবাই আমার শত্রæ। সবাই উপরে-উপরে খাতির করে কথা বললেও তলে-তলে সবাই আমার ক্ষতি করার ধান্দায়। আমার মনে হয় সন্দেহ বাতিক হইছে। বয়স হলে কি মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়? নাকি এটাও আমার কোনো নতুন ধরনের অসুস্থতা? দুনিয়াতে যত অদ্ভুত রকমের অসুখ আছে সবই দেখি আমার মধ্যে!
আজকাল কেমন যেন উদাস-উদাস লাগে। দুঃখ-দুঃখ ভাব নিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে। মাঝে-মাঝে ভালোমন্দ না বুঝেই বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেমন যেন সারাক্ষণ প্রেম-প্রেম ভাব মনে চাগান দেয়। মনে হয়, কী যে হয় তাও-ও ঠিকমতো ধরতে পারি না। শুধু এইটুকু বুঝি মনের মধ্যে কী যেন নাই-নাই ভাব। কী নাই তাও জানা নাই। বয়স আমার ১৪ মাস। কিন্তু ডাক্তারী হিসাবে ১১ বছর ৪ মাস। এখন শুধু মুন্নিকে কাছে পেতে ইচ্ছা করে। এই ব্যাপারটা যেন বাড়াবাড়ি না হয়ে যায় সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু আমি যতই খেয়াল রাখি না কেন মা মনেহয় কিছু একটা টের পাচ্ছে। ইদানীং মুন্নিকে কারণে-অকারণে গালমন্দ করে। আর মুন্নিও কেমন যেন বেয়াড়া হয়ে উঠছে।
এরই মধ্যে মা খুঁজে পেল একটা ছেঁড়াখোড়া বই। খবিশের বাপ এই বইটা ফেলে গেছে। বইটার নাম লজ্জাতুননেচ্ছা। এটা তাবিজের বই। মুন্নি এই বইটা লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু মা যেন কী খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে পেয়ে যায়। উনি তো খুব অবাক এই বই কোত্থেকে আসলো। আমাকে জিজ্ঞেস করাতে আমি বলে দিই, এই বই বুড়া চাচার। এই যে কয়েকদিন আগে আসছিল তেনার। উনি এই বই দেখে দেখে মানুষকে তাবিজ দেয়। উনি বলেছে এই বই উনি পেয়েছে উনার পীর সাহেবের কাছ থেকে। এরই মধ্যে মুন্নি এসে দাঁড়ায় আমাদের মাঝে। মা সাথে সাথে একজন বিচারকের ভ‚মিকায় চলে যায়। আর মুন্নি আসামী। আমি কি উকিল? কার উকিল? মুন্নির, না মার?
মা প্রশ্ন করে, মুন্নি নির্বিকারভাবে উত্তর দিয়ে যায়। আজকাল মুন্নির মধ্যে ভয়ডর একেবারেই কমে গেছে। ও মার সাথে শুধু তর্কই করে না, বেয়াদবিও করে। আমি জানি ও কেন এত সাহস পায়। খবিশ ওকে সাহস দিচ্ছে। মা তো তার কিছুই জানে না। আমিও তো বলতে পারি না। আমি জানি, যদি বলি তাহলে মা আর মুন্নিকে একদিনও রাখবে না। আমি চাইনা মুন্নি চলে যাক। যত বেয়াদবিই করুক ওকে তো আমি ভালবাসি। আর ভালবাসার মানুষের বেয়াদবি একটু সহ্য করতেই হয়। মা তো কত বেয়াদবি করে খবিশের সাথে, খবিশ তো তাও রাগ করে না! মা বকা দিলে খবিশ হাসিহাসি আর কান্না-কান্নার মাঝামাঝি একটা চেহারা বানিয়ে বসে থাকে। আমার তখন হয় বিরাট সমস্যা। না পারি হাসতে, না পারি হাসি থামাতে। খবিশ যে তলে-তলে মুন্নিকে এক্সট্রা পাওয়ার দিচ্ছে তা আমি জানি। আর এই জন্যে মুন্নির এত বাড় বাড়ছে।
-মুন্নি, এই বই তুই লুকায়ে রাখছিলি কেন?
-এই বই উনি আমারে গিফট করছে।
-তুই কি পড়তে পারছ?
-পড়া শিখবো।
-এই বই পড়ার জন্যে।
-হ।
-তারপর।
-তাজিব দিয়ে মানুষের উপকার করবো।
-কী উপকার করবি?
-সব ধরনের উপকার। যার যা লাগবে তা-ই এই তাবিজের বদৌলতে পাওয়া যাবে।
আমি এক ফাঁকে বলি, উনি মুন্নিরে বড়লোক হওয়ার তাবিজ দিছে।
-কথা কি সত্যি মুন্নি?
-জ্বি।
-আমাকে বলিসনি কেন?
-বললে তাবিজের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কাউরে বলতে নিষেধ আছে।
-এই তাবিজ দিয়ে কী হবে।
-তাবিজ গলায় পরতে হবে। তাহলে বড়লোক হওয়া যাবে।
-উনি কি এই কথা তোরে কইছে?
-হ, কইছে।
-উনি এই বই কই পাইছে?
-উনার পীর উনারে দিছে।
-পীরটা কে?
-পীর এ কামেল, হয়রত বদরুদ্দিন চিশতি, গৌরীপুরী।
-উনি কে?
-উনি হয়রত বড় পীর সাহেবের ভাতিজা।
-হযরত বড় পীরকে তুই চিনিস?
-হ, চিনি।
-ক’ তো কে?
-উনার বাড়ি শিবপুর। গৌরিপুরের পাশের গ্রাম।
-এই কথা তুই কই পাইলি?
-নানা-ই কইছে।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা

মার এতক্ষণ ধরে রাখা রাগান্বিত চেহারায় একটা হাসির ঝিলিক খেলে যায়। কিন্তু মা হাসতে পারছে না। হাসলে মুন্নি আবার বেশী লাই পেয়ে যায়। অগত্যা চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে, যা কামে যা! শয়তানের বাচ্চা কোথাকার! আর শোন, বড়পীর হলো বাগদাদে জন্ম নেওয়া মানুষ। এই ফাজিল লোকদের কথায় কান দিবি না। তাবিজ দিয়ে কেউ বড়লোক হয় না। বুঝলি?
মুন্নি যে মার কথা বুঝবে না বা বোঝার কোনো ইচ্ছা নাই, সেই বেয়াদবি মুখে এনে মার দিকে তাকিয়ে বলে, জ্বি।
-যা, সবজি কাট। কেটে আমাকে ডাক দিস।
মুন্নিকে বকা দিয়ে মা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বসে আছে। মা কী এত চিন্তা করছে? খবিশের বাপ কি আবার আসবে এই বই নেয়ার উছিলায়? বইটা তো উনি মুন্নিকে দিয়ে দিয়েছে। আমার সামনেই দিয়েছে। এটা উনি নিতে আসবে বলে মনে হয় না। আমি কি মাকে বলবো যে এত চিন্তা কোরো না। বুড়া চাচা এই বই নিতে আসবে না। আমি জানি। মনে মনে এসব বলি আর মার পাশে চুপচাপ বসে থাকি। মাকে কেন যেন খুব অসহায় মনে হয়। এত শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে নিজের মা-বাবা-ভাইবোনদেরকে গ্রামের বাড়ি রেখে ঢাকা শহরে এসে কতই না কষ্ট করে মা শেষ পর্যন্ত একটা চাকরী আর একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। কতকিছুর বিনিময়ে যে এইসব নাগরিক সুযোগের নাগাল মা পেয়েছে তা প্রায়শই আমার খুলনার খালাকে শোনায়। খালার যখনই মন খারাপ করে তখনই মাকে ফোন করে। চাকরী করতে গিয়ে বসের কুনজরে পড়ে চাকরী ছাড়তে বাধ্য হয় তখনই মাকে ফোন করে। আর মা খালাকে তার জীবনের সব দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী শোনায়। আমারও মনে হচ্ছে মাকে একটা দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনাই। বলি যে ভয়ের কিছু নাই। মা নিজেই খালাকে বলছে যে, উনি সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকে। উনার ভয় শুরু হয়েছে সেই প্রথম যেদিন ঢাকার দিকে রওযানা করেছিল সেদিন থেকে। মা খালাকে সেই গল্প বলে। তোর নিশ্চয় মনে আছে, বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর। আমি তখন কলেজে ভর্তি হইছি। হঠাৎ একদিন সকালবেলা একটা ফেইচ্ছা পাখি ভোরবেলা আইসা চিৎকার করা শুরু করলো আমার জানালায় বসে। গত ছয়-সাত মাসে ভোরে ওঠা ভুলেই গেছিলাম। বাবাই আমাদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যে ভোরে উঠতো আর সবাইরে ডেকে ডেকে ওঠাতো। বাবার মৃত্যুর পর আর কেউ ডাকেও না, ঘুম থেকে ভোরে ওঠার তাড়াও নাই। হঠাৎ করেই একদিন এই ফেইচ্ছাটা আসা শুরু করলো এবং প্রত্যেকদিন একই সময়ে, ভোর ছয়টায়। ফেইচ্ছার ডাকে মেজাজটা তিরিক্ষি করে উঠলাম। খেদাইলাম ওইটারে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যখন দেখলাম ছয়টা বাজে হঠাৎ করে বাবার জন্যে মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে হলো বাবাই যেন ফেইচ্ছাটারে পাঠায়ছে আমারে ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্যে। মনে হলো বাবা যেন আমাকে ডেকে তুলে চাদর গায়ে দিয়ে হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের উঠান। বুকের মধ্যে একটা বাবা ডাক কেমন যেন রেডি হয়ে বসে আছে বাইর হওয়ার জন্যে। কিন্তু আমি সেটা কষ্ট করে আটকায়ে রাখতেছি। সেই ডাক বুকে নিয়ে বাবার চলে যাওয়ার দিকে তাকায়ে আছি। বাবা তুমি শুধু ডাকতেই আসবা দেখা দিতে আসবো না। বুক ফেটে কান্না আসলো। সেদিন যত কাঁদছিলাম বাবা মারা যাওয়ার পর আর কোনদিন এত কাঁদি নাই। মা মনে করছিল আমি বাবারে স্বপ্নে দেখে কাঁদছি। সবাইরেও তাই কইছিলাম। স্বপ্নে বাবারে দেখছি। আসলে ফেইচ্ছার ডাক আর বাবার হেঁটে চলে যাওয়ার দৃশ্য যে আমার চোখে লেগে আছে তা কাউরে কই নাই। তারপর থেকে সেই ফেইচ্ছা প্রত্যেকদিন আসে। আসে একই সময়ে, একই জায়গায় বসে গলা ছেড়ে চিৎকার করে। আমার ঢাকায় আসার আগ দিন পর্যন্ত পাখিটি নিয়ম করে আসলো। আমি ঢাকায় আসার আয়োজন করছিলাম। আর মনে মনে ভাবতেছিলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া যত সহজই হোক পাখির কাছ থেকে বিদায় নেয়া যেন বাবাকে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি নেয়ার মতোই কঠিন হবে। মনে হচ্ছে পাখিই যেন আমার বাবা এবং আমাকে ঢাকা যাওয়ার অনুমতি দেবে না। বাবাতো কোনদিন কোথাও আমাকে একা যেতে দিতে চাননি। এমনকি একমাত্র মামা চাকরীসূত্রে তখন টাঙ্গাইল থাকে। উনার বাসায় মেট্রিক পরীক্ষার পর বেড়াতে যাবো তাও বাবা দেবে না। শেষ পর্যন্ত মামীকে দিয়ে বলিয়েছি বাবাকে। তারপর রাজি হলো এই শর্তে যে মামা এসে নিয়ে যাবে এবং দিয়ে যাবে। একা কোথাও যেতে দেবে না। কী যে সমস্যা ছিলো বাবাকে নিয়ে। সেই নাটকের পর আর কোথাও যাওয়া হয়নি বাবা জীবিত থাকা অবস্থায়। এখন বাবার অনুপস্থিতিতে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার প্রত্যয় নিয়ে ঢাকা যাওয়ার সময়ে যেন বাবা এসে আবার সামনে দাঁড়িয়েছে। আমি হাজারো পরিকল্পনা করছি বাবাকে বোঝানোর, রাজি করানোর। সময় যতই কাছে চলে আসছে ভয়টাও ততই বাড়তেছে। প্রত্যেকদিন রাতে শুয়ে শুয়ে রিহার্সেল দেই, বাবার কাছ থেকে কিভাবে বিদায় নেব। কী বলবো বাবাকে। প্রত্যেকদিন রাতে ভাবি কাল সকালে পাখিটি চলে যাওয়ার আগেই তাকে ঢাকা চলে যাওয়ার কথাটা বলবো। কিন্তু পারি না। এই করে-করে ঢাকা যাওয়ার ফাইনাল দিন চলে আসলো। আর তো কাল বলার সুযোগ নাই।  আজ সকালে বলতেই হবে। গত দুই বছরেরও বেশী সময় ধরে নিয়ম করে আসা ফেইচ্ছা পাখির ডাকই আমাদের এলার্ম ঘড়ি হিসাবে কাজ করেছে। তাই আমরা এখন আর ঘড়িতে এলার্ম দেই না। আর এলার্ম ঘড়িটার ব্যাটারী শেষ হইছে সেই কবে তা আর কেনাও হয় নাই। মার পক্ষে এখন সংসারের খরচ সামলানোই কঠিন। তার উপর বাড়তি কোনো আবদার যেন না যায় সেইদিকে আমরা দুইবোনই বেশ সতর্ক। সেই সকালেও পাখির অপেক্ষা করে-করে, নাকি সারারাত জেগে থেকে ভোর করলাম। বাইরে দেখি বেশ ফর্সা হয়ে আসছে। আমি উঠছি না। ফেইচ্ছা এসে ডাক দেবে এই ভরসায় শুয়ে আছি। শেষ পর্যন্ত মা এসে ডাকলো, কিরে, উঠোস না কেন? সাড়ে ছয়টাতো বাজে। আমার বুকে মোচর দিয়ে উঠলো। বলো কী! সাড়ে ছয়টা বাজে পাখিটা আজ এখনও আসলো না! মাকে বলেই ফেলি, মা, পাখিটা আসলো না আজ ডাকতে? ওকে না-বলে আমি চলে যাবো? মা বলে আসবে। তুই ওঠ। হাতমুখ ধো, আমি নাস্তা দিচ্ছি। ট্রেইনের সময়ের কথা মনে হওয়াতে আর দেরি করার কথা চিন্তাও করতে পারলাম না। তাড়াহুড়া করে উঠেই বাথরুমে। প্রাতঃকাজ, নাস্তা, রিকশা ডাকার ব্যস্ততার ভিতরও সারাক্ষণ বারান্দা আর জানালার দিকে তাকিয়ে আছি পাখিটাকে দেখবো বলে। ওর কাছে বিদায় নেব বলে। সব কাজ শেষ করে যখন রওয়ানা করবো তখনও পাখি আসলো না। আমার মনে হলো তবে কি ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করতেছি? বাবা কি আমার ঢাকা যাওয়াটাকে পছন্দ করতেছে না? আমি কি ইচ্ছা করে ঢাকায় যাচ্ছি? তিনটা মানুষের তো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। চাকরী করতে হলে তো ডিগ্রিটা কমপ্লিট করতে হবে। এলাকার কলেজে যতটুকু করা যায় তা তো করছি। কিন্তু তা দিয়ে তো আর চাকরী হবে না। আর সব চাকরীওতো ঢাকাতেই। মফস্বল শহরে তো আর কোনো চাকরী নাই। বাবা কি সেটা বুঝবে না? নিজে নিজেই হাসি। অপেক্ষা করছি পাখির জন্যে আর চিন্তা করছি বাবার কথা। এই করে-করে রিকশায় এসে উঠলাম। আমার চোখ তখনও দক্ষিণ আকাশের দিকে, যদি ও আসে। আমার সাথে শেষ দেখা ও করবে না? ওকি আমার পথ আগলে দাঁড়াবে না? বলবে না, যাওয়ার দরকার নাই? নাকি এটা কোনো অশুভ কর্মের পূর্বাভাস? কথাটা মনে হতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাহলে আমি কি ভুল করছি? আমি কি পথিমধ্যে এক্সিডেন্টে মারা যাবো? অথবা মারা যাব না কিন্তু হাত-পা হারাবো? পঙ্গু হয়ে মানুষের দয়া-দক্ষিণার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবো সারাটা জীবন? তারপর সারাটা পথ প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার রিকশাটা উল্টায়ে যাবে, এই বুঝি ট্রেনটা হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়ে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে! এই বুঝি টেক্সিটা এক্সিডেন্ট করবে! এই মৃত্যুর ভয় নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় এসে পৌঁছাইছিলাম। কিন্তু প্রতি মুহূর্তের এক্সিডেন্টের ভয় আমার মন থেকে আর কোনোদিন গেল না। আজ অবধি কেবল একটা ভয়ই আমাকে তাড়া করে রাতদিন।
ঢাকায় এসেও তো কত কষ্ট করলাম! একটা টিউশনির জন্যে কত মানুষকে বলছি! প্রথম প্রথম যারেই বলি সে-ই বলে যোগাযোগ রাইখো। তারপর আর খবর নাই। আবিদ চাচার কথা তোর মনে আছে? আহারে, খুব ভালো মানুষ ছিল। আব্বার দূর-সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। কিন্তু আমার জন্যে অনেক করছে। উনার বাসায় এসে উঠছিলাম। ছিলাম মনে হয় মাস-তিনেক। শুইতাম উনাদের বারান্দায়। সরকারী কোয়ার্টার, দুইটা রুম। সবাই আমারে ডিঙ্গায়ে যায় বাথরুমে। কোনো রাতেই ঠিকমতো ঘুমাইতে পারি নাই। ওমা একদিন দেখি কি, কে যেন আমার গায়ে হাত দিচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে একটা কষ্টের ছোরা ঢুকে যায়। আবিদ চাচা? চোখ খুলে দেখি উনার বড় ছেলেটা আমার কাছে শুইতে চেষ্টা করতেছে! আমি আসার আগে এটাই ওর বিছনা ছিল। আমি বলি কী ব্যাপার? বলে, আপু, আমি একটু ঘুমাই। আমি একটু জায়গা করে দিতেই সে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। সকালে আমার বিছনায় ছেলেকে দেখে চাচীর সে কী চেচামেচি! তখন ছেলেটার বয়স আর কত, ধর নয়-দশ বছর। চাচী যেমন করতেছিল মনে হচ্ছিল উনার ছেলের সাথে আমি শুইছি ঐটা করার জন্যে। আমি তো লজ্জায় মনে হইছিল মরে যাই। তারপরও মাসখানেক উনাদের বাসায় ছিলাম। অথচ আমার কী মনে হইছিল জানোস? ছেলে মনেহয় ঘুম ভেঙ্গে চাচাচাচীর কিছু একটা করা দেখে আমার বিছানায় চলে আসছিল। ঢাকা শহরে এক রুমের বাসায় ছেলেমেয়ের সামনেই তো সেক্স করতে হয়।
বলে আর মার সেকি হাসি!
সেখান থেকে গেলাম একটা মেয়েদের মেসে। সেখানেও কি শান্তি আছে! কোনোকিছু রেখে তুই শান্তি পাবি না। এমনকি তোর পাওডারটা যদি সামনে দেখে তো ওমনিই আর-একজনের মনে পড়বে একটু পাওডার লাগানোর কথা। কে কার উপর দিয়ে চলবে এর হলো প্রতিযোগিতা। কী যে কষ্ট লাগতো! তারপর একসময় কখন যেন সব কিছু সয়ে গেছে। কিন্ত মনের মধ্যে সেই যে ভয়টা ঢুকছিল তা আর বাইর করতে পারলাম না।
কত স্বপ্ন দেখতাম একটা সুন্দর বাসা থাকবে। একটা ফুটফুটে বাবু থাকবে। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে থাকবো। খুব বেশী কিছু চাইবো না, শুধু বেসিক হলেই চলবে। তারপর কী থেকে কী হয়ে গেলো। কুত্তার বাচ্চা রাসেলটার সাথে দেখা হয়েই আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। ভয় তাড়ানোর জন্যেই তো মদ খেতাম রাসেলের সাথে। ও-ই বলতো, খাও একটু একটু, দেখবে মনে অনেক সাহস পাবে। সামান্য খেয়ে দেখলাম কথা মিথ্যা না। সাময়িক ভয়ডর আসলেই পালায়। কিন্তু নেশার ঘোর কেটে গেলে যে দ্বিগুণ হয়ে ফেরৎ আসে তা তো রাসেল আমাকে বলে নাই। প্রথম প্রথম মনে হলো ও কি উপকারটাই না করতেছে! প্রত্যেকদিন বোতল বোতল মদ, তারপর ফেনসিডিল, তারপর ইয়াবা এনে খাওয়াতো। এই করতে করতেই কখন যেন প্রেগনেন্ট হয়ে গেলাম। বাচ্চা পেটে আসার পর ভয়ে আমার কোনো রাতে ঘুম হতো না। ভয়ে কখনও মদ ছুতাম না, যদি বাচ্চাটার ক্ষতি হয়। কিন্তু হায়, যা হবার তা তো হবেই! আমার কী সাধ্য আছে তা ঠেকানোর? রসেল শুয়োরের বাচ্চা তো মদ না হয় একটা কিছু ছাড়া ঘুমাতেই পারে না! আমাকেও সাধাসাধি করতো, না খেলে মাঝেমধ্যে রেগেও যেতো। তখন আবার অন্য ভয়, যদি রাগ করে চলে যায়। এতবড় বাপের পোলা আমার সাথে দয়া করে যে থাকে তা তো আমার কপাল। তার উপর যদি ওর কথা না শুনি তাহলে তো ও চলে যেতেই পারে। সে দুনোমনোর মধ্যেই মাঝে মাঝে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারতাম না। তাতে লাভের লাভ কি হইলো, যা হবার তো তাই হলো। রাসেল চলে গেল আমাকে ৭ মাসের প্রেগনেন্ট রাইখা। ভয়ে ঘুমাতে না পাইরা খবর দিয়ে নিয়ে আসলাম সাগরকে।
বাবুর জন্যে খুব কষ্ট লাগে। এ মাসুম বাচ্চাটার তো কোনো দোষ নাই। মজা করলাম আমরা আর সাফার করবে বাবু? আল্লার কাছে তো এখন কত কান্নাকাটি করি, মাফ চাই, হায় আল্লা যা দোষ করার আমি করছি! মাসুম বাচ্চাটা তো কিছু করে নাই! তারে তুমি এই কষ্ট থেকে রেহায় দাও। শাস্তি যদি কোনো পাওনা থাকে তো আমারে দাও। আবার পরক্ষণে এও মনেহয়, আমাকে সবচেয়ে বড় শাস্তিটা দেওয়ার জন্যেই আল্লা বাবুকে বাইছা নিছে। আমারে দিলে তো আর এত কষ্ট পাইতাম না যতটা বাবুরে দিলে পাই। আল্লার মাইর জগতের বাইর গো বোন। সেই যে ভয় ঢুকলো আর সেই ভয় থেকে বাইর হইতে পারলাম না।
মা এইসব বলে আর চোখ মোছে। মা এমনিতে কিন্তু খুবই শক্ত এবং কঠিন মনের মানুষ। অথচ খালার সাথে বা নানুর সাথে কথা বলতে গেলেই কাঁদে। মার জন্যে তখন আমার অনেক কষ্ট হয়। মনে হয় কবে বড় হয়ে মার এইসব কষ্ট দূর করবো। কষ্টে মার মুখটা দিন দিন অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে। আজকাল হাসি দিলেও মনে হয় অনেকগুলো কষ্ট ঝরে পড়ছে।
চলবে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments