মাতাল শিশু(২৫ পর্ব)/ ধারাবাহিক উপন্যাস- মোয়াজ্জেম আজিম

  
    
মোয়াজ্জেম আজিম

২৫ তম পর্ব:
মা আর আমি এখন খুব গল্প করে কাটাই। মিথিলাও কখন কখনও আমাদের সাথে থাকে। কিন্তু ঘুমানোর সময় মিথিলা থাকে না। তখন মা শুধু আমাকে গল্প শোনায়। আমি আগে গল্প শুনতাম না। আমি তো বড় হয়ে গেছি, তাই গল্প শুনতাম না। কিন্তু এখন মিথিলার সাথে দুই একবার শুনে গল্প আমারও ভাল লেগে গেছে। মাকে সারাক্ষণই বলি, মা গল্প শুনাও। ঘুমানোর সময় বলি, খেতে বসে বলি। যখন সময় পাই তখনই বলি। সবচেয়ে বেশী গল্প হয় নানাভায়ের বারবিকিউ সেডে। নানাভাইও আমাদের সাথে বসে গল্প করে। এছাড়া আমাদের আর কিছু করারও নাই। মাঝে মাঝে ক্ষেতে কাজ করি। কাজ শেষ হয়ে গেলে গল্প করি। আবার গল্প শেষ হয়ে গেলে মিথিলা আর আমি খেলি। মা আর নানাভাই বসে চা খায়। আমাকেও চা দেয়। কিন্তু মিথিলাকে দেয় একটু। আধা কাপ। আমি খাই পুরো এক মগ। কিন্তু এই বাড়ি আসার পর থেকে আমার ড্রিংক্স প্রায় বন্ধ। শুধু আমি ঘুমানোর আগে মা এক পেগ দেয়। তালুকদার বলেছে একদম বন্ধ করে দেয়া ঠিক হবে না। তবে যতটা কম পারেন সেটা ভাল। আমি এখানে আসার প্রথম দিন সকাল বেলায় এক পেগ মেরেছিলাম। তাতে মিথিলা আমার সাথে খেলতে এসে নাক ধরে দৌড় দিয়ে চলে যায়। বলে, তোমার মুখে কী বিশ্রি গন্ধ! তাই মা বলেছে, থাক বাবা, এখন আর দিনের বেলায় খাওয়ার দরকার নাই। শুধু রাতের বেলায় খাও। আবার তোমার নানীজান টের পেলে আমাদের বাসা থেকে বাইর করে দেবে। তাহলে আমাদের রাস্তায় গিয়ে থাকতে হবে। মা আমাকে খুব করে বুঝিয়েছে, আমিও বুঝেছি। তাই এখন নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি। মাও নানা ব্যবস্থা করেছে আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্যে। ডাক্তারও বলেছে, সবসময় কোন-না-কোন একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে অসুবিধা কম হবে। তারপরও যদি হয় তাহলে যেন তালুকদারের সাথে যোগাযোগ করে। আর এখন তো একজন প্রাক্তন ডাক্তার বাসায় আছে। মা তো সারাক্ষণই নানাভায়ের সাথে পরামর্শ করে করে কাজ করে। আজ সকালে নানাভাই খুব সুন্দর একটা গল্প শুনিয়েছে মাকে। আমরা তখন খেলি। আমি তো খেলি আর যাই করি, কান সবসময় উনাদের দিকে ফিট করা থাকে। নানাভায়ের মতো করেই তার একটা গল্প বলি।
আমার এক ফ্রেন্ড, নাম শাহাব। শাহাবুদ্দিন চৌধুরী। আমরা শাহাব বলেই ডাকতাম। ও ইন্টার পাশ করার পর জয়েন করলো আর্মিতে। পরে সে খুব ভালও করলো। আমি যখনকার কথা বলছি তখন ও বিগ্রেডিয়ার। সাভার সেনানিবাসের জিওসি। ওর একমাত্র ছেলে। অনেক চেষ্টা করেছিল আরো ছেলেমেয়ে নেয়ার কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আমার রেফারেন্সে একবার আমেরিকা পর্যন্ত ঘুরে আসলো তাও কিছু হলো না। যা-ই হোক, সেটা বলা আমার উদ্দেশ্য না। ছেলে ক্যাডেটে পড়ে। ম্যাট্রিকে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করলো কুমিল্লা বোর্ড থেকে। একই ক্যাডেটে শুরু করলো ইন্টারমিডিয়েড। চাকরী, সংসার, ছেলে নিয়ে বেশ সুখের সংসার। আমার সাথে সমসময় যোগাযোগ রাখে। হঠাৎ একদিন ফোন করে হাওমাও করে কান্না। শাহাব তোর কী হয়েছে? আগে বল, কাঁদবি তো পরে! আমি নিশ্চিত ছিলাম ছেলেটা বা বউটা মারা গেছে সেই সংবাদ দেবে। কান্না একটু থামার পর বলে যে ছেলের ক্যান্সার ধরা পড়ছে। আমি তখন লন্ডনে। তারপরও একবার দেশে আসলাম ওর জন্যে। সিএমএইচ-এ বসলাম সব ডাক্তারদের নিয়ে।

আমার যারা ছাত্র ছিল সবাইকে রাখলাম মিটিংয়ে। সবাই বললো, এখন তো কেমোর স্টেজ, কাজেই সিঙ্গাপুরে নিয়ে যান। সবচেয়ে ভাল হবে। এমনকি সিঙ্গাপুরের ট্রিটমেন্ট আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার চাইতেও ভাল। ওর একটা বাড়ি ছিল উত্তরায়, ৫ কাঠার উপর জায়গা। কী সুন্দর করে নিজের মনের মতো করে ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছিল। সেই বাড়ি বিক্রি করে দিলো। গেল সিঙ্গাপুর, তিন মাস থেকে সব কেমো-টেমো সাকসেসফুলি শেষ হওয়ার পর যখন ফাইনাল টেস্টের জন্যে পাঠালো, রিপোর্ট আবারও নেগেটিভ। তার মানে আর কোনো আশা নাই। আমি লন্ডন থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললাম সিঙ্গাপুরের ডাক্তারদের সাথে। সবাই বললো, দেখো মবিন, চিকিৎসা-বিজ্ঞান যতদূর এগিয়েছে তার পুরো বেনিফিটই পেশেন্ট পেয়েছে, এরপর আর আমাদের বা তোমার কিছু করার নাই। এখন তোমার বন্ধুকে বলো বাড়ি গিয়ে রিলাক্সলি সময় কাটাতে। মেক্সিমাম আমরা আর ওকে তিনমাস বাঁচিয়ে রাখতে পারবো। এর বেশী চিকিৎসাবিজ্ঞানের আর কিছু করার নেই। আমিও শাহাবকে তাই বললাম। আল্লার উপর ভরসা করে বাড়ি চলে যা। আর আমাদের কিছু করার নাই। বাড়ি যা, ও যা খাইতে চায় তাই খাইতে দে। ও যা করতে চায়, তাই করতে দে। ওর সামনে কখনও মন খারাপ করে থাকিস না। ওর মনে ফুর্তি যেন থাকে সেই দিকে লক্ষ্য রাখিস। চেষ্টা করিস সবসময় রিপ্রোডাক্টিভ বিষয়-আশয়ের মধ্যে ইনভল্ব থাকতে। এই ধর গরুছাগল, হাসমুরগী, কুকুরবিড়াল Ñ যা সে পছন্দ করে তার সাথে খেলাধুলা করতে। গাছপালাও রিপ্রোডাক্টিভের মধ্যে পড়ে, তবে ইমিডিয়েট রেসপন্স যারা করে তারা বেশী কার্যকর। আমি নিজেও ততদিনে ন্যাচারো থেরাপীর উপর বিস্তর পড়াশোনা শুরু করেছি। এবং এই কথা মিথ্যা না যে, যেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যর্থ সেখানেই ন্যাচারো থেরাপী কার্যকর। আমি চায়নিজ, জাপানিজ, আফ্রিকান, সাউথ-আমেরিকান, আর আমাদের সাব-কন্টিনেন্ট তো আছেই, সবার উপর পড়াশোনা করা শুরু করলাম। এবং দেখলাম এই ক্যান্সার নামে না হলেও এই ধরনের অসুখ কিন্তু দুনিয়াতে বহুদিন যাবৎই আছে। এবং আয়ূর্বেদ তার চিকিৎসা দিয়ে আসছে। আবার কিছু অসুখ আছে, যা শুধু চিকিৎসা দিয়ে কাভার করা যায় না। চিকিৎসা বলতে যে আমরা শুধু ওষুধপত্র বুঝি তাতো আর প্রাইমারী চিকিৎসা না; চিকিৎসা-বিজ্ঞানে সেটাকে তো সেকেন্ডারী চিকিৎসা বলা হয়। আর প্রাইমারী চিকিৎসা হলো সঠিক পরিবেশ, নিয়মিত এক্সারসাইজ, সঠিক খাবারদাবার এবং বিশ্রাম। উচিত হলো প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারী চিকিৎসার সমন্বয়। এক্সারসাইজও যে চিকিৎসার মধ্যে পড়ে তাতো প্রায় আমাদের ডাক্তারদের মুখে শোনাই যায় না। সঠিক পরিবেশে বসবাস করতে পারলে শরীর নিজেই রিপেয়ারের পথ বের করে নেয়। যাইহোক শাহাবকে সব বললাম। শাহাবও মন শক্ত করে ছেলে নিয়ে একদম ওর দেশের বাড়ি পঞ্চগড়ে চলে গেল। শাহাব তো খুব দাপুটে লোক ছিল! ঘরে তো বটেই, এমনকি এলাকায় বলে দিলো ছেলের সামনে যেন কেউ ইমোশন না দেখায়, কান্নাকাটি না করে। ছেলেকে নিয়ে ও সারাক্ষণ বানবাদাড়, জঙ্গল, নদীনালা, খালবিল ঘুরে বেড়ায়। ছেলেও এমন গ্রামীণ পরিবেশ পেয়ে বেশ তরতাজা। এক সপ্তা যেতে-না-যেতেই শাহাব আমাকে টেলিফোন করলো। ছেলের চেহারা-স্বাস্থ্য আগের থেকে ভাল। আমি তো শুনে ভয় পেলাম। মৃত্যুর আগে তো একটু ভাল মনে হয় সবার। যা-ই হোক, মুখ ফুটে কিছু বললাম না। বললাম বেশ, আনন্দ কর, ফুর্তি কর। আমোদফুর্তি এমন এক জিনিস তা পেলে শরীর-মন শীতের সবজির মতো তরতাজা হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ছেলে দুই জায়গায় বেড়াতে গিয়ে খুঁজে পায় দুইটা অনাথ বিড়ালের বাচ্চা। একটাকে সে কুড়িয়ে আনে ড্রেন থেকে। পানিতে পড়ে মিউমিউ করছিল। এইসময় ওর ছেলে দেখে দৌড়ে গিয়ে বিড়াল ছানাটাকে উদ্ধার করে। সেটা নিয়ে সে কী উল্লাস! এক সপ্তাহ পার করে দিলো বিড়ালছানাকে যতœআত্তির মধ্যেই। সপ্তাহখানেক পর পায় আরো একটা। এবারেরটার অবস্থা আরো খারাপ। কিভাবে যেন বিড়ালছানাটা পুড়ে গেছে। ওর শরীরে লোম বলতে কিছু নাই। শরীরের নানা জায়গায় পুড়ে ঘা হয়ে গেছ্।ে সেটাকেও উদ্ধার করে নিয়ে এলো ছেলে আর বাপ মিলে। তারপর ডাক্তার-ওষুধ মিলিয়ে বাপ আর ছেলে এত ব্যস্ত যে, ছেলে যে ওর অসুস্থ তা নাকি শাহাব নিজেও ভুলে গেছিল। সেটাকেও সুস্থ করে তুললো। তারপর বাপ আর ছেলের মিশন হলো বিড়াল উদ্ধার করে বেড়ানো। শুধু কি তাই? বিড়াল খুঁজতে গিয়ে ওরা সাপও বাঁচিয়েছে জাল থেকে, তারপর ছেড়ে দিয়েছে। কাউকে মারতে দেয়নি। এলাকাবাসীও নাকি ওদের কাজকারবার দেখে খুব খুশি। ওরাও ওদের সাহায্য করতে লাগলো নানারকম খবর দিয়ে। তিন মাসে ওরা উদ্ধার করলো ১৮টা বিড়াল আর দুইটা খুবই অসুস্থ কুকুর। পশুহাসপাতাল চালানোর দায়িত্ব এখন বিগ্রেডিয়ার শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর হাতে। বোঝো অবস্থা! থানার ওসি, দারোগা, টিএনও সবাই এসে খবর নেয়, স্যারের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। এই করে করে কোনদিক দিয়ে দুইমাস চলে গেল শাহাব টেরও পায়নি। কিন্তু ওর বউও সারাদিন নামায-কালাম আর কোরআন শরীফ নিয়েই ছিল। তারপরও শেষের একমাস মা-বাপ দুইজনেই গোনে। প্রত্যেকদিন যায় আর ওদের কষ্ট যেন দ্বিগুণ হয়ে বুকে চেপে বসে। এদিকে ছেলের কিন্তু খেয়ালই নাই যে ও অসুস্থ, এতবড় একটা ঝড় যাচ্ছে বা গেছে ওর উপর দিয়ে! ও মহা আনন্দে আছে বিড়াল নিয়ে। দিন যায়, সপ্তা যায় এই করে-করে একদিন সত্যিই তিনমাস শেষ হয়ে গেল। খুব নীরবে শুধু শাহাব একবার ওর বউকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠেছিল, এইটুকুই। ভাবী ততদিনে অনেক শক্ত হয়ে গেছে। বলে, দেখো, আমার সোনারচাঁদের কিচ্ছু হবে না। আল্লার রহমতে ও ভাল আছে। এই কুকুর-বিড়ালের দোয়ার বরকতেই আমার ছেলে ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকবে। ও বেঁচে না থাকলে ওর বিড়ালের কী হবে? মানুষের এই দায়িত্ববোধই মানুষকে বাঁচায়ে রাখে। আল্লা নাকি সেই ব্যক্তিকেই উঠায়ে নেয় যার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু আমার ছেলেকে দেখো, ওর কত কাজ! এত কাজ রেখে কি কেউ মরতে পারে? ওর মরার সময় কই? শাহাবের খুব ইচ্ছা করছিল কাঁদতে। কিন্তু ফ্যামিলির অন্যরা টের পেয়ে যাবে বলে কান্নাকটি করে নাই। তবে দুপুরে জোহরের নামাযের পর অনেকটা সময় ও মসজিদে কাটিয়েছে চোখের পানি ফেলে ফেলে। সেই ছেলে এখন দুই সন্তানের জনক। এখনও ওর বাড়িতে বিড়ালের খামার। ২০-২৫টা বিড়াল সবসময় থাকে। আবার কিছু আছে, শুধু খাবার সময় নাকি আসে। খেয়েদেয়ে চলে যায়। ও ওদের দেখে আর হাসে। বলে, খোদার খাসি, বাদাম্মে বিড়াল!

সেই ছেলে আর ঢাকায় আসেনি। সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ ভাল আছে। আমি গেছিলাম কয়েক বছর আগে। ওর এখন একটা অটো রাইসমিল আছে। বিরাট জায়গা নিয়ে একটা মাল্টিফার্ম করছে। ওর ফার্মে সবই আছে। গরু, ছাগল, হাস, মুরগী, মাছ, শাক-সবজি। নিজে খায়, আবার লোকাল মার্কেটে বিক্রিও করে। দেখো মা, সবকিছু ছাড়তে হয়, কিন্তু আশা ছাইড়ো না। আশা আর স্বপ্নই মানুষকে বাঁচায়ে রাখে।
এমন একটা সুন্দর গল্প শুনে মা কাঁদছে কেন বুঝলাম না। গল্পটা শেষ করে নানাভাইও উঠে গেল। আর মা বসে বসে কাঁদছে তো কাঁদছেই। আমি একবার ভাবলাম, মার পাশে গিয়ে বসি। কিন্তু মার এই কান্নার মুহূর্তে হঠাৎ করে সামনে গিয়ে পড়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে চিন্তা করে গেলাম না। আমি মিথিলাকে খেলায় তাল দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি এখন কেমন যেন বড় মানুষের মতো হয়ে গেছি। ছোট মানুষ মিথিলার সাথে খেলি, কিন্তু চিন্তা করি মার জন্যে, চিন্তা করি মুন্নির জন্যে, চিন্তা করি খবিশের জন্যে। সবকিছু কেমন উলট-পালট হয়ে গেল। খবিশের চলে যাওয়াটাই মনে হয় সব সমস্যার শুরু। খবিশ চলে না গেলে তো মুন্নি এই পাড়ার দোকানদারটার সাথে প্রেম করার সুযোগ পেত না? এখন আমার নিজের উপর রাগ হয়। মা যে খবিশকে বসিয়ে-বসিয়ে খাওয়াতো তা-ই দেখি ভাল ছিল। ওকে কাজ করতে দিয়ে যত ঝামেলা বাঁধলো। এখন তো ঝামেলা বেড়েই চলেছে। দিন-দুয়েকের মধ্যে যাব নানাভাইয়ের গ্রামের বাড়ি। সেখানে গিয়ে কী দেখি আল্লা মালুম!

চলবে..

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments